বিশেষ প্রতিবেদক : বিশ্ব ব্যাংকের ঋণের অর্থে ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস)’ প্রকল্পে অনিয়মের নতুন নতুন খবর আসছে।
প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম, বিদেশ সফর, প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপশি এবার এ প্রকল্পে যন্ত্র কেনা নিয়ে সই জালিয়াতির খোঁজ পেয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
ঢাকার বায়ু মাত্রাতিরিক্ত দূষণের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি সংসদীয় কমিটিতে বায়ুর মান নিয়ে আলোচনার সময় সামনে আসে কেস প্রকল্প।
গত জুলাই মাসে এই প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল সংসদীয় কমিটি। ওই সময় প্রকল্পটি মূল্যায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) পাঠাতে মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছিল।
২৮৪ কোটি ৭৮ লাখ ৯৮ হাজার টাকার কেইস প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২২১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৩৩ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে পরামর্শক নিয়োগে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নয়, এমন খাতেও অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে সংসদীয় কমিটিতে অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে শুরু হয়ে গত জুন মাসে শেষ হয় এই প্রকল্প।
প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের নামে গত ১০ বছরে ২৯৯ জন বিদেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ ১০/১২ বারও বিদেশ সফর করেছেন। এছাড়া প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন অনেকেও বিদেশে গেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছে সংসদীয় কমিটি।
প্রকল্পের টাকায় বিদেশ গিয়ে দেশে ফিরে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। ফলে তাদের প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি।
সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী জালিয়াতির প্রসঙ্গে বলেন, এই প্রকল্পে যেসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, তার দামের চেয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেশি।
আমাদের কাছে তথ্য এসেছে, যারা বিভিন্ন সময় এই কেনাকাটায় সই করেছে, সেখানে জালিয়াতি হয়েছে। যে কনসালটেন্টের সই দেখানো হয়, সেই সময় তিনি ঢাকাতেই ছিলেন না। আমরা যখন এ নিয়ে আলোচনা করেছি, তখন এ তথ্য আমাদের সামনে আসেনি। এখন নতুন করে খবর পেয়েছি।
এই প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ফুটব্রিজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের।
তিনি বলেন, এই প্রকল্পের একটি অংশে সিটি কর্পোরেশনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন। কিন্তু যেভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে উদ্দেশ্যের সঙ্গে অসঙ্গতি আছে।
বায়ু মানের সঙ্গে ফুটওভার ব্রিজ, যাত্রী ছাউনি, এসবের জাস্টিফিকেশন দেখি না। সিটি কর্পোরেশনকে ঢুকিয়ে এসব কাজ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মানুষের মোবিলিটি বাড়লে গাড়ির ব্যবহার কমবে। ফুটওভার ব্রিজ নিয়ে একথা যৌক্তিক নয়।
বিশ্ব ব্যাংক অনেক অনেক কথা বলতে পারে। তাদের সব কথা মেনে নিতে হবে, এমন নয়। ঢাকার বায়ুর মান উন্নয়নে কেন এ ধরনের বিষয়? সমালোচনার সুরে বলেন সাবের।
তিনি জানান, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে এই প্রকল্প নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালানো হবে। সাবের ওই সংসদীয় কমিটিরও একজন সদস্য।
কেইস প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মঞ্জুরুল হান্নান খান। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সংসদীয় কমিটির কাছে এই প্রকল্পের যেসব নথিপত্র পাওয়া গেছে, তা থেকে জানা যায়, কেস প্রকল্পের আওতায় কেনা ১০টি গাড়ির মধ্যে পাঁচটিই বর্তমানে অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে।
প্রকল্পের আওতায় সরকারি সংস্থা হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) থেকে না পুড়িয়ে ইট বানানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কথা ছিল। সরকারি এই সংস্থাও তা করতে পারেনি।
প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে ১৬টি বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর এখন সেগুলো কীভাবে চলবে, তা নিশ্চিত করা হয়নি।
এই প্রকল্পে ৩৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছে। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৪৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিয়ান রিসার্চ অ্যান্ড ডিজাইন ইনস্টিটিউট ওয়াল অ্যান্ড রুফ ম্যাটেরিয়ালস নামে চীনের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দুটি গবেষণার কাজ শেষ করেনি।
এ প্রকল্পে গাড়ি কেনার জন্য ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। ৭২ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে ভবন নির্মাণে। রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
এসব খাতে ব্যয় ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটি মনে করে, এখানে অনিয়ম হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক বলেছে, বায়ুর মান বাড়ানো এবং মানুষের বাইরে চলাফেরা নিরাপদ করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। আর তা অর্জনে ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত এবং ইটভাটায় ইট পোড়ানোর পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব করা ছিল লক্ষ্য।
গত মার্চ মাসে সংসদীয় কমিটির সভায় বায়ু দূষণের মাত্রা ৩০০ এর ওপরে উঠলে হেলথ অ্যালার্ট জারির সুপারিশ করা হয়। এর পরে একাধিকবার ঢাকার বায়ুর মান খারাপ হলেও হেলথ অ্যালার্ট জারি হয়নি।
সাবের বলেন, সংসদীয় কমিটি এ নিয়ে আলোচনা করে সুপারিশ করেছিল। সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।
কেস প্রকল্পে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। তবে সেটা কতটুকু কার্যকর? বায়ুর মান নিয়ে তথ্য আসছে পরদিন। তখন ওই তথ্য নিয়ে কাজ কী? লাইভ তথ্য নয়। প্রেজেন্ট ইনফরমেশন থাকলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আজকের দিনের তথ্যটা আমরা আজকেই দরকার। মার্কিন দূতাবাস লাইভ তথ্য দেয়। গতকালের তথ্য নিয়ে আজকে কাজ কী? এর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
সাবের বলেন, আর একটা বিষয়, এই যে তথ্য আসছে সেটা নিয়ে কী করছে? কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? একবারও আমরা বলি নাই। মন্ত্রণালয়ের উচিৎ ছিলো দূষণ নিয়ে মানুষকে জানানো।