বিশেষ প্রতিবেদন : ১৭৮৯ থেকে ১৯৬৯, ফরাসী বিপ্লব থেকে ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, যদি ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এবং ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এর মধ্যে তুলনা করি, তবে আমরা অনেক মিল খুঁজে পাব। ১৯৬০-এর দশকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং ১৭৮০ এর দশকে ফ্রান্সের পরিস্থিতি প্রায় একই রকম ছিল। উভয় দেশের মানুষই শাসক শ্রেণীর অবিরাম শোষণের শিকার হয়েছিল। উভয় ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী শ্রেণীর লোকেরা কম বেতনের ছিল এবং তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনও খুব কম ছিল। উভয় দেশের মানুষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর দ্বারা আধিকার বঞ্চিত হয়েছিল। বিপ্লব ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে আর কোন বিকল্প ছিল না। ফরাসি বিপ্লবের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন মারকুইস ডি লাফায়েতে আর বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীর অবিসংবাদিত নেতায় প রিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ফরাসি বিপ্লবের গল্প ১৭৮৯ : ১৭৮৯ এ ফ্রান্সের স্বৈরাচারী শাসক, কিং লুই ষোড়শ সঠিকভাবে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছিলেন, যার ফলে ফ্রান্স জুড়ে দারিদ্র্য উদ্বেগজনকভাবে উঠেছিল। তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন যার ফলে বিশাল আর্থিক ঘাটতির মধ্যে পরে ফ্রান্স। এই ঘাটতি মেটাতে জনগনের উপর ট্যাক্স চাপানো হয়। কিং লুই ষোড়শ কৃষি ও শিল্প উতপাদনকে উত্সাহিত করার জন্য কোনও পদক্ষেপ নেননি এবং ফলস্বরূপ, ফ্রান্সের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছিল এবং দিন কে দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও ফ্রান্সের কিং লুই ষোড়শ জনগণের উপর কর আরোপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর জনগণ কর হিসাবে যা দিত, তা দিয়ে তিনি ভোঁগ বিলাস করতেন । ইতিমধ্যে যারা কিং লুই ষোড়শ এর ব্যর্থতা আর অত্যাচারী শাসনের বিরোধে বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল সেই সাধারণ মানুষ জনের উপর চলছিল দমন নীতি। কিং লুই এর অনুগত সৈন্যরা ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাজার হাজার নারী পুরুষদের গ্রেপ্তার করেছিল। নিয়মিত জেলখানায় বন্দী সংকুলানে ব্যর্থ হওয়াতে ‘বাস্তিল’ নামের দুর্গ কে কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। আর সেখান থেকে এক এক করে নেতাদের ধরে ‘গিলোটিন’ নামক মেশিনে হত্যা করত। এক সময় বাস্টিল কারাগারেও ধারন ক্ষমতার অধিক বন্দী রাখা হল এবং বন্দীরা কারাগার অভ্যন্তরে আরেকটি আন্দোলন শুরু করলেন ।যেহেতু তারা প্রায় প্রতিদিনই বন্দীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাই তারা ততই উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা অপেক্ষায় ছিল একজন নেতার, যে তাদের মুক্তি দিবে দেখাবে এবং কারাগারের বাইরের ও ভিতরের আন্দোলন কে একিভূত করে সঠিক পথ দেখাবে। এসময় তাদের সাথে যোগ দিলেন,মারকুইস ডি লাফায়েতে, লাফায়েত ছিলেন একজন ‘ফরাসি সামরিক কর্মকর্তা, যিনি আমেরিকা বিপ্লবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে লড়াই করেছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি হয়ে ওঠেন ফরাসি বিপ্লবের মূল ব্যক্তিত্ব।
মুক্তির জন্য মারিয়া ফরাসী জনগণ লাফায়েতের সামরিক দিক নির্দেশনায় ১৪ জুলাই ১৭৮৯ তে বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করে সকল বন্ডীদের মুক্ত করে এবং সম্মিলীতভাবে রাজকীয় বাহিনীকে পরাজিত করে, ফ্রান্সের কিং লুই ষোড়শ এর পতন ঘঠে। সেই থেকে ১৪ জুলাই দিনটি ফ্রান্স তাদের জাতীয় দিবস হিসাবে পালন করে।
বাস্তিল ১৪ জুলাই ১৭৮৯ এবং ঢাকা ২২ ফিব্রুয়ারী ১৯৬৯ এর মধ্যে মিল-অমিল : ফরাসী বিপ্লবের সাথে পূর্ব পাকিস্থানের ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের এক অবাক করা মিল পাওয়া যায়। প্যারিসের সাধারণ মানুষদের নেতৃত্বে বাস্তিল দুর্গের পতনের ইতিহাস যেন বাঙালী জনগণের মনে গেথে গিয়েছিল। অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলায় আটক করে ঢাকা সেনানিবাসে প্রহসনের বিচার করছিল আইয়ুব খানের সামরিক আদালত। ঢাকা সেনানিবাস যেন বাস্তিল দুর্গ, আর আইয়ুব খান যেন অত্যাচারী কিং লুই ষোড়শ । ২২ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা অমান্য করে বাংলার জনতা ঢাকার রাস্তায় নেমে এসে অবিরাম সমাবেশ, বিক্ষোভ ও অবরোধ করতে থাকে। পাক-পুলিশ বহু জায়গায় বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু, মানুষ আইয়ুব খানের গুলি দেখে ভয় পায়নি, কারণ তারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কে মুক্ত করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল। হয়ত ফরাসীদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানত জনতা।
আক্ষরিক অর্থেই ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বাস্তিল দুর্গের মতোই ঢাকা সেনানিবাসেরও পতন হয়, তখন আওয়ামী লীগ নেত্রত্তাধীন আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পাকিস্থান শাসকদের বাধ্য করা হয়। ঢাকা সেনানিবাস অভিমুখে সেদিন যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী, আইনজীবী, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা যাত্রা করেছিল, তা যেন বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে ফরাসীদের রোড মার্চ। সেদিন যখন মিছিলের সামনের অংশটি ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেইটের কাছে, তখন মিছিলের শেষ ভাগ শাহবাগে ছিল। তবে পার্থক্য হচ্ছে ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে ফরাসী ঝড় থামে, আর ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে ঢাকা সেনানিবাসের যে পতন হয় সেটা ছিল ঝড়ের পূরবাভাস, মূল ঝড়ে পশ্চিম পাকিস্থানের পতন হয়েছিল।জনতা শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধী তে ভূষিত করল, বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি শাসনের অবসানের রোড ম্যাপ তৈরী করলেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ, কিন্তু পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং সর্ব পরি তিনি ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটান। নয় মাসের ভয়াল যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
ফরাসী বিপ্লবের মতো, আমরা বাঙালীরাও স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছি আর সে ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বিপ্লবের এই ডাকেই বাঙ্গালীরা ঝাপিয়ে পরেছিল মক্তির নেশায়, ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়ের লাল সূর্য। বিপ্লবী লাল সালাম জানাই হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মানে। জয় বাংলা, জয় বংগবন্ধু।
লেখক : স্কোয়াড্রন লিডার(অব) সাদরুল আহমেদ খান সাবেক ডেপুটি সার্জেন্ট-এট-আর্মস। সদস্য,অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ-কমিটি,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।