!! ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে সংসদ ভবনে কর্মরত থাকা অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বাসভবন সংলগ্ন তার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার গণপূর্তের টাকায় নির্মাণ করেন এবং গরুর ঘাস সরবরাহের নামে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুদকে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এদিকে অষ্টম জাতীয় সংসদে অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে (ডেপুটি স্পিকার) প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের ৩ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিন প্রকৌশলী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন !!
বিশেষ প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদ পেতে ২০ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে মাঠে নামার অভিযোগ উঠেছে প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সাম্প্রতিক দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েও গণপূর্ত এর প্রধান প্রকৌশলীর পদ বাগিয়ে নিতে জোর তদবির অব্যহত রেখেছে মোসলেহ উদ্দিন। গণপূর্তের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার এর চাকরির মেয়াদ দেড় বছর থাকলেও এখনই তাকে সরিয়ে এই পদে বসতে চান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। যিনি বহুল আলোচিত-কুখ্যাত জি কে শামীম সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল) পদে আছেন মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী পদের জন্য বড় অংকের বাজেট নিয়ে মাঠে নেমেছেন এই কর্মকর্তা এবং এ বাজেটের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন গণপূর্তের একাধিক সূত্র।
জানা গেছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের আস্থাভাজন লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, সচিব আরেক দফায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন । সচিব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলেই এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধান প্রকৌশলী পদে বসবেন, এটা গোটা গণপূর্তের ভেতরে চাউর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিণতিতে হয়ে ওঠেনি। তবে মোসলেহ উদ্দিন মোটেই হাল ছাড়েননি। তিনি এখন নতুন কৌশল নিয়ে ওই মিশন বাস্তবায়নে তৎপর রয়েছেন বলে জানা গেছে।
সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ না বাড়ায় নতুন কৌশলে হাঁটতে দেখা গেছে। তবে তাকে এই কাজে সহায়তা করতে সাবেক মন্ত্রী ও সচিবের সুবিধাভোগী গণপূর্ত অধিদপ্তরের চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীর নাম জানা গেছে। প্রকাশ পাবে পরবর্তী সংখ্যায়। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দিন ১৯৯৫ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে ফেনী ও শেরেবাংলা নগরে দায়িত্ব পালন করেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর শেরেবাংলা নগর ও দীর্ঘ সময় প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে সমন্বয় বিভাগে ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে চট্টগাম জোনেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সব জায়গাতেই দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় ওই ভবন থেকে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, এফডিআর, আগ্নেয়াস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
অভিযানে জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জি কে শামীম যাদের নাম বলেছিলেন, তার মধ্যে মোসলেহ উদ্দিন অন্যতম। প্রথম সারির গণমাধ্যমে তখন এ তথ্য প্রকাশিত হয়। মোসলেহ উদ্দিন ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার আমলে তিনি বিএনপিপন্থি প্রকৌশলী হিসেবে পরিচিত ছিলেন বটে। তবে হাইব্রিড উপাধির পদ ছাপিয়ে এই আমলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থক পরিচয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবাইকে দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।তার কৌশলবাজের কাছে সবাই ছিলেন জিম্মি।
কে এই জি কে শামীম ? যুবলীগের সমবায় সম্পাদক হিসেবে পরিচয়দানকারী জি কে শামীমের পূর্ণ নাম এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম। নারায়ণগঞ্জ শাখা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও তিনি। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদক ছিলেন। জি কে শামীম বিএনপির প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেও জানা গেছে। প্রভাবশালী ঠিকাদার জি কে শামীম রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার সরকারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। গণপূর্ত ভবনের বেশির ভাগ ঠিকাদারি কাজ তার নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে গণপূর্ত বিভাগে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র পর্যন্ত শামীমের ঠিকাদারির হাত বিস্তৃত। যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে জি কে শামীম পরিচয় দিলেও উভয় সংগঠন অবশ্য তা অস্বীকার করেছে।
২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হিসাবে সংসদ ভবনে কর্মরত থাকা অবস্থায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বাসভবন সংলগ্ন তার গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার গণপূর্তের টাকায় নির্মাণ করেন এবং গরুর ঘাস সরবরাহের নামে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুদকে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এদিকে অষ্টম জাতীয় সংসদে অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়াকে (ডেপুটি স্পিকার) প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। ওই কমিটি গণপূর্ত বিভাগের ৩ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল ওই কমিটি। কিন্তু সুপারিশ অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তর। তদন্ত কমিটির সুপারিশে সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার ও ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট আখতার হামিদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তিন প্রকৌশলী ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন।
ক্ষমতাবান এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ আমলেও শুরু থেকেই ক্ষমতার যাদুকাঠি পেয়ে যান, কারণ তিনি ছিলেন সাবেক আওয়ামীলীগের প্রেতাত্মা চিহ্নিত ছাত্রলীগ নেতা। তিন দফা পদোন্নতি পাওয়ার পর মোসলেহ উদ্দিনকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হতে সহায়তা করেন কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীম। তিন কোটি টাকা খরচ করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত জোন থেকে ঢাকা গণপূর্ত জোনে বদলি হয়ে আসেন মোসলেহ উদ্দীন। গণপূর্ত অধিদপ্তরে কমিশনভোগী ‘ফিফটিন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি করেছেন তিনি। ঢাকা ও কুমিল্লায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে তার। জানা যায়, জি কে শামীম সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির কারণে মোসলেহ উদ্দীনকে ১৩ জানুয়ারি, ২০২০ তলবি নোটিশ পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত নোটিশে বলা হয় ‘সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন ঠিকাদার জি কে শামীমসহ অন্য ব্যক্তিরা।
এর মধ্য দিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ক্যাসিনোকাণ্ডের না সঙ্গে জড়িয়ে শত শত কোটি টাকা আয় করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের ঘটনা ঘটেছে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য নেয়া জরুরি।’
এজন্য ১৬ জানুয়ারি, ২০২০ রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছিল মোসলেহ উদ্দীনকে। সেই অনুযায়ী হাজির হলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় গণপূর্ত অধিদপ্তরে ঠিকাদার- প্রকৌশলী সিন্ডিকেট, অতীতের অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার ও বাড়ির মালিক হওয়া, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করা হয় তাকে। জিজ্ঞাসাবাদে নেতৃত্ব দেন দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন। সে অতি কৌশলী হয়ে অর্থের প্রভাবে দুদকের সেই তদন্তও ধামাচাপা দিতে সক্ষম হন মোসলেহ উদ্দীন।