চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীন ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োঃনিষ্কাশন কাজে চলছে লুটপাট

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত চট্টগ্রাম জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সারাদেশ

চট্টগ্রাম নগরবাসীর আধুনিক জীবনধারা বজায় রাখার লক্ষ্যে স্যানিটেশন ফ্যাসিলিটিজ নির্মাণ করার মাধ্যমে মহানগরীর জন্য পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- দৈনিক ১০ কোটি লিটার ক্ষমতার ১টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার ক্ষমতার ১টি ফিকেল স্ল্যাজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ ও বিভিন্ন ব্যাসের (২১০০ মি.মি হতে ১১৫ মি.মি) ট্রাঙ্ক মেইন ও কালেকশন পয়ঃপাইপলাইন স্থাপন ২০০ কিলোমিটার এবং ফ্যাকল স্ল্যাজ ম্যানেজমেন্ট যন্ত্রপাতি ক্রয়। আর এসব সম্পন্ন করার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা।  এরমধ্যে ৫০ কোটি টাকা দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং বাকি টাকা দিচ্ছে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক।১৯৬৩ সালে ওয়াসা সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োঃনিষ্কাশন কাজ শুরু করলেও এখনো পানি সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে শহরের ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পাইপ স্যুয়ারেজ এবং ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ইন্টারসেপ্টর ও পাম্পের আওতায় এনে মোট ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে উন্নত অন-সাইট স্যানিটেশনের আওতায় এনে শহরকে পয়ঃজনিত দূষণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যাবে। এর জন্য ৬টি ক্যাচমেন্টে সর্বমোট বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়েছে ২৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা।


বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি   :  চট্টগ্রাম ওয়াসার অধীন ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের ফলে দেয়ালের কয়েকটি স্থানে ফাটল দেখা গেছে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করছেন ওয়সার কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা। ফাটলের কারণ ও প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা না করে বিষয়টিকে অসত্য দাবি করে একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবাদ পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রতিবাদলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন ওয়াসার জনসংযোগ কর্মকর্তা নুরজাহান শিলা। তবে প্রতিবাদের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ওই কর্মকর্তাকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের রিটেননিং দেয়ালে ফাটলের কারণ অনুসন্ধানে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের সাথে আলাপ করে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো :

যেসব কারনে ফাটল : নির্মাণ সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একাধিক কারণে দেয়ালে ফাটল দেখা দিতে পারে। তারমধ্যে নিম্নমাণের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার অন্যতম। এছাড়া ঢালাই কিংবা আস্তরে ১ দশমিক ৮ থেকে ২ দশমিক ৫ পরিমাপের সিলেট স্যান্ড উত্তম। এর নিচে হলে বালুতে মাটির পরিমাণ বেশি থাকে, সেগুলো ব্যবহার করলে স্ট্রাকচার মজবুত হবে না। আবার ব্যবহারের আগে বালু ভালো করে ছেঁকে নিতে হবে, যাতে মাটি না থাকে। মাটি থাকলে ঢালাই ফেটে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারের বালুতে লবণের মিশ্রণ থাকে, সেগুলো ব্যবহারের ফলে দেয়ালে ফুস্কুরি পড়তে পারে, যা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। মেটেরিয়ালস মিশ্রণের ক্ষেত্রে সিমেন্ট-বালি ও পাথর ১:১.৫:৩ হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড মানের। কেউ কেউ ১:২:৪ পর্যন্ত দিয়ে থাকে। তবে এই মিশ্রণ ১:৩:৬ পরিমাণে মিশ্রিত করে থাকলে স্থাপনা টেকসই হবে না। আবার আস্তরের ক্ষেত্রে ১/৪ থেকে ১/৬ শতাংশ পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড। সিমেন্টের পরিমাণ যদি আরো কম হয়, তবে ফাটল ধরতে পারে।

ছোট ফাটলের কারনে হতে পারে বড় সমস্যা : রিটেইনিং দেয়ালে ছোট ছোট ফাটল থাকলে পর কী ধরনের সমস্য হতে পারে- এমন প্রশ্নে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা জানান, ফাটল আস্তে আস্তে বড় হতে পারে। তাছাড়া ওয়ালের একপাশ যখন ভরাট করা হবে তখন অপর পাশে চাপ বৃদ্ধি পাবে। এই চাপের ফলে এক সময় ফাটলগুলো বড় আকার ধারণ করে ভেঙে পড়তে পারে। ফাটল দিয়ে যদি রডগুলো কোনোভাবে পানির সংস্পর্শে আসে, তাহলে রড ফুলে যাবে এবং দেয়ালের ওপর পেশার পড়বে। ফলে ভেঙে যাওয়াসহ দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।

জানা যায়, ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নগরীর হালিশহর এলাকায় নির্মাণাধীন স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি নির্মাণের পর ১০০ বছরের গ্যারান্টির কথা বলা আছে। কিন্তু সম্প্রতি দেয়ালে ফাটল নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আরো কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্পকাজের মূল ঠিকাদার কোরিয়ার তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড হলেও এর সবকিছুই দেখাশোনা করতেন নাজমুল করিম চৌধুরী শারুন। মালামাল সরবরাহের কিছু অংশের দায়িত্বে ছিলেন নগর আওয়ামী লীগ নেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু, যার বিরুদ্ধে দখল-ভাংচুর হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তারা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে কাজের অতিরিক্ত টাকা তুলে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে। এসব ঠিকাদার সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের মোটা অংকের কমিশন দিয়েছিলেন বলে অপর একটি সূত্র জানায়। আর এই কমিশনের ফলে কাজের মান নিয়ে কথা বলার সাহস করেনি কেউ।

এসব অনিয়ম ও প্রতিবাদে দেয়া নিজের বক্তব্যকে অস্বীকার করার বিষয়ে জানতে প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুল ইসলামের মোবাইলে কল দিলে তিনি মোবাইল রিসিভ না করায় তার কোন প্রকার বক্তব্য প্রকাশিত হলো না।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটির সভাপতি এসএম নাজের হোছাইন বলেন, যেহেতু দেয়ালে ফাটল দেখা গেছে, তাই প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের উচিত ছিল ফাটলের কারণ খুঁজে বের করা। কিন্তু তারা তা না করে সাংবাদিকের ওপর চোখ রাঙাচ্ছে। মনে হয় নিজেরদের অপকর্ম আড়াল করতে ভয় লাগানোর চেষ্টা করছে।

উল্লেখ্য, নগরবাসীর আধুনিক জীবনধারা বজায় রাখার লক্ষ্যে স্যানিটেশন ফ্যাসিলিটিজ নির্মাণ করার মাধ্যমে মহানগরীর জন্য পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- দৈনিক ১০ কোটি লিটার ক্ষমতার ১টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার ক্ষমতার ১টি ফিকেল স্ল্যাজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ ও বিভিন্ন ব্যাসের (২১০০ মি.মি হতে ১১৫ মি.মি) ট্রাঙ্ক মেইন ও কালেকশন পয়ঃপাইপলাইন স্থাপন ২০০ কিলোমিটার এবং ফ্যাকল স্ল্যাজ ম্যানেজমেন্ট যন্ত্রপাতি ক্রয়। আর এসব সম্পন্ন করার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৫০ কোটি টাকা দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং বাকি টাকা দিচ্ছে কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২০ লাখ মানুষ পয়ঃসুবিধা ভোগ করবে। এর জন্য মাথাপিছু খরচ পড়ছে ১৯ হাজার টাকা। প্রকল্পের কাজ ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। মালয়েশিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এরিনকো এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শোধনাগার নির্মাণে একটি কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান আর পাইপলাইন নির্মাণকাজ করবে দুটি চীনা প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা অনুমোদন হয়নি।

১৯৬৩ সালে ওয়াসা সুপেয় পানি সরবরাহ ও পয়োঃনিষ্কাশনকাজ শুরু করলেও এখনো পানি সরবরাহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে শহরের ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পাইপ স্যুয়ারেজ এবং ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ইন্টারসেপ্টর ও পাম্পের আওতায় এনে মোট ৯০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে উন্নত অন-সাইট স্যানিটেশনের আওতায় এনে শহরকে পয়ঃজনিত দূষণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যাবে। এর জন্য ৬টি ক্যাচমেন্টে সর্বমোট বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা হয়েছে ২৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা।

এরমধ্যে হালিশহর ৩ হাজার ৮০৮, কালুরঘাট ৪ হাজার ১৮৪, ফতেয়াবাদ ১ হাজার ৭০০, পূর্ব বাকলিয়া ৫ হাজার ৩৩৮, উত্তর কাট্টলী ৩ হাজার ৪৮৫ এবং পতেঙ্গা ক্যাচমেন্টের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রথম পর্যায়ে হালিশহর ক্যাচমেন্ট-১-এর বাস্তবায়নের জন্য ১৬৩ একর জায়গার ওপর ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। বাকি ক্যাচমেন্ট এরিয়া বাস্তবায়নে জাপান, কোরিয়া, ফ্রান্স ও জাইকা স্যুয়ারেজ প্রকল্পের বাস্তবায়নে অর্থায়ন করবে। ক্যাচমেন্ট এরিয়া-১ ছাড়া বাকিগুলোর ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *