করোনায় বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক, মৃত্যু বেড়ে ৫৮৩৯
ডেস্ক রিপোর্ট : চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারি এখন বিশ্বজুড়ে এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম। প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে শত শত নতুন মুখ এবং আক্রান্ত হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। শনিবার পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আরও ৪১৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে কোভিড-১৯ ভাইরাসে (করোনার আরেক নাম) আক্রান্ত হয়ে সর্বমোট ৫৮৩৯ জন মারা গেল।
বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ১৩০ জন। আর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৫ হাজার ৯৩৩ জন।
চীনের সীমানা পেরিয়ে এই ভাইরাস থাবা বসিয়েছে ইউরোপ, এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। অর্থাৎ বরফে আচ্ছাদিত এন্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের সবক’টি মহাদেশেই হানা দিয়েছে ভয়াবহ করোনা। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ইউরোপের। যে কারণে এ অঞ্চলটিকে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্রস্থল হিসাবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ডব্লিউএইচও)।
চীনের চেয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে প্রতিদিন এ ভাইরাস দ্রুত ছড়ানো ও মৃত্যুহার বাড়ায় শুক্রবার এ ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের। গত ৭২ ঘণ্টায় স্পেনে করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের ঘটনা দ্বিগুণ হওয়ায় দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী এদওয়ার্ড ফিলিপ্পে। ফলে দেশটির ৬ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার সবাইকে ঘরে থাকতে হচ্ছে। শনিবার পর্যন্ত সেখানে মোট ৯১ জন মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন আরও সাড়ে ৪ হাজার মানুষ। তবে এ অবস্থার মধ্যেও সেখানে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রোববারের স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্টিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ্পো।
এর আগে সোমবার থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এবং ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইমানুল ম্যাক্রো।
ইউরোপে ইতালির পর সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রামণের ঘটনা ঘটেছে স্পেনে। ফলে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে শুক্রবার দেশজুড়ে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট প্রেড্রো সানচেজ। এই ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তার স্ত্রী ও স্পেনের ফাস্ট লেডি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে খবর এসেছে।
দ্য স্ট্রেইটস টাইমস জানায়, প্রেসিডেন্ট সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজের করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তবে তিনি কোথায় কোয়ারেন্টাইন আছেন এবং কোথায় তাকে চিকিৎসা হচ্ছে এ বিষয়ে কিছুই জানায়নি পত্রিকাটি।
স্পেনে করোনায় শনিবার পর্যন্ত ১৯৩ জন মারা গেছে এবং মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬২৫০। এদের মধ্যে কেবল শুক্রবারই প্রাণ হারিয়েছেন ১২০ জন এবং রাতারাতি আক্রান্ত হয়েছেন ১৫০০ জন।
এর আগে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তুতি হিসাবে শুক্রবার দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট সানচেজ।
ইতালি যেন মৃত্যুপুরি : করোনার কারণে দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর দেশটিতে আজই প্রথম রোববার। কিন্তু সাপ্তাহিক এই ছুটির দিনটিতেও নিস্তব্ধ গোটা দেশ। রোববার সকালেও সাটার খোলেনি শহরের কোনও দোকানপাট, বন্ধ রয়েছে ঘরবাড়ির জানালাগুলোও । অর্থাৎ কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া মেলেনি। যেন গোটা দেশটাই এখন মৃত্যুপুরি।
আগেই বলেছি ইউরোপে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ইতালিতে। এ পর্যন্ত সেখানে ১২৬৬ জন মারা গেছে এবং মোট আক্রান্ত হয়েছে ১৭৬৬০ জন।
যুক্তরাজ্য: দেশটিতে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ জন মারা গেছেন। ফলে সেখানে করোনায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ২১য়ে গিয়ে দাঁড়ালো। এছাড়া করোনায় আক্রান্তের মোট সংখ্যা ১১৪০ জন। দেশটিতে করোনা সংক্রামণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ড ওপরও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো ট্রাম্প প্রশাসন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা থেকে যুক্তরাজ্যকে বাদ দেয়া হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশ থেকে আগতদের ১৪ দিন বাধ্যতামুলক সেল্ফ আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। রোববার এক টেলিভিশন ভাষণে তিনি এই নির্দেশ দেন। এছাড়া আগামী এক মাস অস্ট্রেলিয়ায় কোনও বিদেশি ক্রুজ শিপ ভিড়তে দেয়া হবেনা। এর আগে সরকার পাঁচ শতাধিক লোকের জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যদিও দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও বন্ধ করা হয়নি। অস্ট্রেলিয়ায় এ পর্যন্ত ২৫০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন মোট তিনজন।
ইউরোপের অন্যান্য দেশে: জার্মানিতে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৭৫ এবং মারা গেছে ৮ জন। সুইজারল্যান্ডে আক্রান্ত ১ হাজার ১৩৯ এবং মৃত্যু ১১। নরওয়েতে আক্রান্ত ৯৯৬ এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে। সুইডেনে আক্রান্ত ৮১৪ এবং মৃত্যু ১। নেদারল্যান্ডসে আক্রান্ত ৮০৪ এবং মৃত্যু ১০। ডেনমার্কে আক্রান্ত ৮০৪, বেলজিয়ামে আক্রান্ত ৫৫৯ এবং মৃত্যু ৩, অস্ট্রিয়ায় আক্রান্ত ৫০৪ গ্রিসে আক্রান্ত ১৯০ এবং মৃত্যু ১। ফিনল্যান্ডে করোনায় আক্রান্ত ১৫৫, চেক প্রজাতন্ত্রে ১৪১, স্লোভেনিয়ায় ১৪১, আইসল্যান্ডে ১৩৪, রোমানিয়ায় ৯৫, আয়ারল্যান্ডে আক্রান্ত ৯০ ও মৃত্যু ১।
করোনায় মৃত্যুর শীর্ষে চীন : চীনে শনিবার নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন আরও ২০ জন। এদের মধ্যে ১৬ জনই বহিরাগত। মাত্র একদিন আগে দেশটিতে করোনায় সংক্রামণের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১টি। অর্থাৎ দেশটিতে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাসের প্রবণতা শনিবারও অব্যাহত ছিল।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক হচ্ছে শনিবারও উহানে নতুন করে কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি। গত ১০ দিন ধরেই করেনা সংক্রমণের বাইরে রয়েছে এ শহরটি। হুবেই প্রদেশের রাজধানী এই উহান থেকেই করোনা মহামারি আকারে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ চীনে করোনা সংক্রামণের খবর প্রকাশ পায় এবং দ্রুত এটি ছড়িয়ে পড়ে। মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে এখনও বিশ্বের প্রথম স্থানে অবস্থান করছে এশিয়ার এই দেশটি। চীনের মূল ভূখ-েই ৮০ হাজার ৮৩২ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৩ হাজার ১৭৭ জন।
দক্ষিণ কোরিয়া: দেশটিতে রোববার ৭৬ জন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত এবং মারা গেছে আরও দিনজন। গত তিন সপ্তাহের মধ্যে সেখানে এটিই সবচেয়ে কম আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। চীনের পর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি করোনয় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। সবমিলিয়ে সেখানে ৮১৬২ জন করোনায় আক্রান্ত এবং ৭৫ জন মারা গেছেন। এর আগে গত শনিবারও (৭ মার্চ) দেশটিতে নতুন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০৭ জন। আর গত ২৯ ফ্রেব্রুয়ারি এই সংখ্যা ছিল ৯০৯ জন।
এদিকে রোববার থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন,স্পেন ও নেদারল্যান্ডস থেকে দর্শণার্থীদের আটকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারি চালাতে শুরু করেছে সিউল সরকার। এর আগে চীন, ইতালি ও ইরান থেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল সে দেশের সরকার।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে থাইল্যান্ডে আক্রান্ত ৭৫ এবং মৃত্যু ১, জাপানে আক্রান্ত ৭৩৪ এবং মৃত্যু ২১। জাপানে নোঙ্গর করা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসে আক্রান্ত ৬৯৬ এবং মৃত্যু ৭। সিঙ্গাপুরে আক্রান্ত ২শ হংকংয়ে ১৩২, হংকংয়ে ১৩২, ভারতে আক্রান্ত ১০০ এবং মৃত্যু ১।
ইরান: চীনের পর এশিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অন্তর্গত ইরানে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এশিয়ার এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১১ হাজার ৩৬৪ এবং মারা গেছে ৫১৪ জন। শনিবার ইরান দাবি করছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৪ হাজার ৩৩৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় ফিরে গেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে আক্রান্ত ৩২০, বাহরাইনে ২১০,ইরাকে আক্রান্ত ১০১ এবং মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। কুয়েতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ১শ, বাহরাইনে ২১০, সৌদি আরবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৮৬ জন, আরব আমিরাতে ৮৫ এবং লেবাননে আক্রান্ত ৭৭ এবং মৃত্যু ৩।
করোনায় আক্রান্ত নন ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টও এতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এরই প্রেক্ষিতে অবশেষে করোনা পরীক্ষা করালেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সেই পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ করোনায় আক্রান্ত হননি ট্রাম্প, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন।
ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে শুক্রবার হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে তার মেডিকেল টেস্ট সম্পন্ন হয়। কিন্তু পরীক্ষায় তার দেহে করোনাভাইরাস সনাক্ত হয়নি এবং তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে।
শনিবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউজে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এসময় তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক শন কনলি বলেন, ট্রাম্পের মেডিকেল রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে।