সিলেট সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সিলেটের সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার চিলাই নদীর পূর্বপাড়ে দুই কিলোমিটার ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এলজিইডি’র অধীনে ও হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমিতির বাস্তবায়নে নির্মিত এই অপরিকল্পিত বাঁধটি এখন কৃষকের গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। কৃষকদের অভিযোগ সরকারি টাকা হরিলুট করতে নির্ধারিত স্থানে বাঁধ নির্মাণ না করে পূর্বে নির্মিত রাস্তার উপর সামান্য মাটির প্রলেপ দিয়ে দায়সারা কাজ করছেন সংশ্লিষ্ঠরা। এতে বাঁধটি বোরো ফসলরক্ষায় কৃষকের কোন কাজেই আসবে না বলে জানান স্থানীয়রা। এছাড়াও অপরিকল্পিত এ বাঁধটির কারনে আগামী বর্ষা মৌসুমে স্থানীয়দের ঘরবাড়ি জলাবদ্ধ থাকাসহ আমন চাষ নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।

জানা যায়, দোয়ারাবাজার উপজেলার চিলাই নদীর পূর্বপাড়ে কৃষকের বোরো ফসল রক্ষায় বেরিবাঁধ নির্মাণের জন্য ৯৭ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ দেয় সরকার। উপজেলা এলজিইডি’র অধীনে ও হকনগর পানি ব্যাবস্থাপনা সমিতির বাস্তবায়নে প্রকল্পের কাজের শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ তোলেন স্থানীয় কৃষকরা। কৃষকের বাঁধা-নিষেধ অমান্য করে যেদিকে বেরিবাঁধটি নির্মাণ হলে কৃষকের উপকার হবে সেদিকে বাঁধ নির্মাণ না করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করতে পূর্বে নির্মিত রাস্তার উপর দিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করেন সংশ্লিষ্ঠরা।

উপজেলা এলজিইডি’র যোগসাজশে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার ভূইয়া ও সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার মিলে সরকারি প্রকল্পের অর্থ হাতিয়ে নিতে অনিয়মকে নিয়মে পরিনত করছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এদিকে অকেজোঁ এ বাঁধ নির্মানেও রয়েছে নানা অনিয়ম দুর্র্নীতির অভিযোগ। হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়ন হলেও এ বিষয়ে কোন কিছুই জানেন না সমিতির বাকি কয়েক শতাধিক সদস্যরা। পারিবারিক মিটিংয়ের মাধ্যমে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরবে চলছে লুঠপাটের কাজ এমন অভিযোগ করেন সমিতির অধিকাংশ সদস্য।
এছাড়াও জোরপূর্বক স্থানীয়দের ফসলি জমির টপ সয়েল ও বাঁধের গোড়া থেকে এক্সভেটর দিয়ে পুকুরের মত গর্ত করে বাঁধটি নির্মাণ করা হচ্ছে। কেউ বাঁধা-নিষেধ দিলেও সরকারি কাজে মাটি দিতে হবে বলে স্থানীয়দের মাটি দিতে বাধ্য করছেন হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি, সেক্রেটারিসহ স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী।
মাটি নেয়ার পর আবারো জমি ভরাটের শর্তে ভোক্তভোগীরা মাটি দিলেও বাধে মাটি ফেলার পর লাপাত্তা হয়ে যান তারা। পরে যোগাযোগ করলেও তাদের কিছু করার নেই বলে জমির মালিকদের সাথে রূঢ় আচরণ করেন। পরবর্তীতে ঘন্টাপ্রতি তিন হাজার করে টাকা দিলে গর্ত ভরাট করে দিবেন বলে জানান সংশ্লিষ্ঠরা। অসহায় বিধবা মহিলার জমির মাটি ভরাট করে দিতেও আদায় করা হয়েছে ঘন্টাপ্রতি তিন হাজার টাকা।
এদিকে অপরিকল্পিত বাঁধের কাজটি সম্পন্ন করতে স্থানীয় কৃষক এমদাদুল হকের পুকুর পাড়ের ৬০টি গাছ কর্তন করে প্রায় লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। এভাবে আরো একাধিক কৃষককের নানা ধরনের শাক-সবজি বাগানের ক্ষতি সাধন করে সেখান থেকে মাটি উত্তোলন করে বাঁধ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে বাঁধ নির্মাণ করলেও কাউকে দেয়া হয়নি কোন ধরনের ক্ষতিপূরণ। উল্টো সরকারি কাজ চলছে বলে কাজে বাঁধা দিতে গেলে নানা ধরনের ভয়ভীতি ও হুমকি দেন প্রকল্প বাস্তবায়নকারীরা। কৃষকের উপকারের নামে অপরিকল্পিত এ বাঁধ নির্মাণ স্থানীয়দের দুঃখের কারন হয়ে দাড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভোক্তভোগীরা।
এদিকে বাঁধের কাজে এসব অনিয়ম-দুর্নীতি ডাকতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করাসহ সাংবাদিক ম্যানেজের ব্যবস্থাও করেছেন সংশ্লিষ্ঠরা। এতে নিরভেই চলছে সরকারি কোটি টাকা লুটপাটের কর্মযজ্ঞ।
গ্রামের প্রবীণ মুরুব্বি আব্দুল হামিদ জানান, অপরিকল্পিত এ ফসলরক্ষা বাঁধের কারনে আমাদের বর্ষাকালে সাতার কেটে মরতে হবে। অন্যত্রে যাওয়ার আমাদের সাধ্য নাই। পূর্বের রাস্তার উপর সামান্য মাটি ফেলেই তারা বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে।
এই বাঁধে আমাদের কোন লাভ হবে না বরং সবদিক দিয়ে আমাদের ক্ষতি হবে। এই বাঁধের কারনে আমাদের আমন রোপন নিয়ে ও শঙ্কা রয়েছে। আর বর্ষাকালে আমাদের ঘরবাড়ি পানিতে নিমজ্জিত থাকবে। কৃষকের স্বার্থে রাস্তাটি যেদিকে হওয়ার কথা ছিলো সেদিকে হয়নি। কাজের শুরুতে আমরা বাঁধা দিলেও তারা আমাদের বাঁধা নিষেধ উপক্ষো করে বাঁধটি নির্মাণ করে।
শফিক মিয়া নামের এক ব্যাক্তি বলেন, এই বাঁধটির কারনে আমাদের বাড়িঘর হুমকিতে থাকায় আমরা আতঙ্কে রয়েছি। বাপ-দাদার আমলে নির্মিত রাস্তা দিয়ে বেরিবাধটি নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি টাকা হরিলুট করতে কৃষকের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে নিজেদের পকেট ভারী করতে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়েছে।
যেদিকে বাঁধটি নির্মাণের কথা সেদিকে কাজটি হলে বেশি মাটির প্রয়োজন হতো, এতে করে সংশ্লিষ্ঠদের পকেট ভারী করার মত অর্থ অবশিষ্ঠ থাকতো না। রাস্তার উপর বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় অল্প মাটি দিয়ে কাজ করে অবশিষ্ঠ টাকা হরিলুটে মেতে উঠেছে সংশ্লিষ্ঠরা। এই প্রকল্পের কাজে কৃষকের কোন উপকার হবে না। যারা কাজটি বাস্তবায়ন করছে শুধু তাদের পকেট ভারী হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, হকনগর পানি ব্যাবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি আনোয়ার ভূইয়া, সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার ও মোতালিব ভূইয়াসহ কয়েকজন জোরপূর্বক আমাদের জমিকে পুকুরে পরিণত করে বাঁধে মাটি ফেলে।
আমরা প্রথমে মাটি দিতে রাজি না হলেও তারা আমাদের মাটি দিতে বাধ্য করে। সরকারি কাজে সবাই মাটি দিচ্ছে বলে আমাদেরকেও মাটি দিতেই হবে বলে জোরপূর্বক মাটি নেয়। আমরা অসহায় মানুষ বাঁধা নিষেধ দিয়েও কোন লাভ হয় নি। এ বাঁধটির কারনে আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। বর্ষাকালে আমাদের ডুবে মরা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছি না।
ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক ছালিক মিয়া বলেন, বাঁধের কাজটি করতে গিয়ে আমার পুকুরের ৬০টি গাছ কেটে ফেলছে। এতে আমার প্রায় লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। অনেকের টমেটো ক্ষেত, সবজি ক্ষেত নষ্ট করে জমিকে পুকুর বানিয়ে মাটি আনা হয়েছে।
মাটি নেয়ার সময় তারা গর্তগুলো ভরে দিবে বলে কথা থাকলেও পরবর্তীতে তাদের আর দেখা মিলে না। তাদের সাথে দেখা করার পর গর্ত ভরাটে ঘন্টাপ্রতি তিন হাজার টাকা দিলে তারা গর্ত ভরাট করে দেবেন বলে জানান। গ্রামের বিধবা অসহায় মহিলার জমি ভরাটেও তাদের টাকা দিতে হচ্ছে। সরকারি এ কাজে কৃষকের উপকারের বদলে আমরা ক্ষতিগ্রস্থই হয়েছি।
এ ব্যপারে হকনগর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সাধারন সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ উরফে বাবুল ডাক্তার জানান, সরকারি প্রকল্পের কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই কৃষকের সুবিধার্তে আমরা কাজটি করছি। কৃষকের কাছ থেকে যে মাটি আমরা আনছি সেটা আবার ভরাট করে দেয়ার কথা বলেই আনছি।
অসহায় তিন মহিলাসহ কৃষকের কাছ থেকে কে ঘন্টা প্রতি তিন হাজার করে টাকা আনছে সেটা আমি জানি না। তবে এই দ্বায়িত্ব সাংবাদিক মোতালিব ভূইয়ার বলে স্বীকার করেন তিনি। এছাড়াও সাংবাদিক হিসাবে কাজের তদারকি ও সাংবাদিকদের ম্যানেজের দ্বায়িত্ব মোতালিব ভূইয়ার উপর দেয়া হয়েছে বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।
কৃষকের স্বার্থে নির্মিত বাঁধে মাটি ভরাটের কাজ ও তদারকির দ্বায়িত্ব সাংবাদিক মোতালিব ভূইয়া কেন পালন করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে আমরাই তদারকি করছি স্থানীয় সাংবাদিক হিসাবে তিনি দেখবাল করছেন বলে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চান তিনি। যার ভিডিও রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
এদিকে কৃষকদের অভিযোগের কথা অস্বীকার করে দোয়ারাবাজার এলজিইডি’র উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, আমরা শিডিউল মোতাবেক কাজটি করছি। এছাড়া নির্দিষ্ঠ দূরত্ব বজায় রেখেই বাঁধে মাটি ফেলা হচ্ছে।
জোরপূর্বক বা হুমকি দিয়ে কারো জমি থেকে মাটি আনা হয় নি। আমরা তাদেরকে বুঝিয়ে সেখান থেকে মাটি আনা হচ্ছে। এর পরেও যদি কাজে কোন অনিয়ম হয় তাহলে সংশ্লিষ্ঠাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।