জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার ধারা বাংলাদেশই প্রথম

অপরাধ রাজধানী

জঙ্গিবাদ থেকে ফিরে আসা দুই নারীর গল্প

 

 

 

বিশেষ প্রতিবেদক : আবিদা জান্নাত আসমা ওরফে রাইসা (১৮)। ফেসবুকে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয়, এরপর গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। বাবা-মাকে না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেন ওই যুবককে। এরপর বিদেশে পড়তে যান। একপর্যায়ে স্বামীর উৎসাহে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অন্ধকার জগতের প্রতি এক সময় চলে আসে তার অনীহা। স্বাভাবিক জীবনে বাবা-মায়ের আদর স্নেহ ভালোবাসা সবকিছু ছেড়ে বস্তি ও বন্দীর জীবন-যাপন করতে হয় রাইসাকে। এই অবস্থা ও জঙ্গিবাদের অভিযোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে র‌্যাবের আহবানে সারা দিয়ে ফিরে এলেন আলোর পথে স্বাভাবিক জীবনে।
বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদরদপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে আসমা ও ডা. নুসরাত আলী জুহি’সহ (২৯) ৯ জঙ্গি আলোর পথে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। ‘নব দিগন্তের পথে’ স্লোগানে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
আত্মসমর্পণ করা জঙ্গি সদস্যদের মধ্যে জেএমবি’র ছয়জন এবং আনসার আল ইসলামের তিনজন সদস্য। তারা হলেন, শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত (৩৪), ডা. নুসরাত আলী জুহি (২৯), আসমা ওরফে রামিসা (১৮), মোহাম্মদ হোসেন হাসান গাজী (২৩), মো. সাইফুল্লাহ (৩৭), মো. সাইফুল ইসলাম (৩১), মো. আবদুল্লাহ আল মামুন (২৬) মো. সাইদুর রহমান (২২), আবদুর রহমান সোহেল (২৮)।
জঙ্গিবাদে জড়ানো ও অন্ধকার জগত থেকে ফিরে আসার গল্প জানান আবিদা জান্নাত আসমা। তিনি বলেন, গত ‘২০১৯ সালে আমি এসএসসি পাস করি। তার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে পরিবারকে না জানিয়ে তার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় দেখা করতাম। এরপর গত ২০১৮ সালে পরিবারকে না জানিয়ে তাকে বিয়ে করি। আর এসএসসি পাসের পর পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পড়াশোনার জন্য বিদেশে যাই। আমার স্বামীও আমার সঙ্গে বিদেশ যান। আর এই বিদেশ যাওয়াটা ছিল আমার স্বামীর পরিকল্পনা।
তিনি আরো বলেন, বিদেশ যাওয়ার ছয় মাস পরই আবার দেশে ফিরে আসি। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকি। মূলত এই সময়ে জানতে পারি আমার স্বামী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তিনি আমাকে তার জঙ্গিবাদের কাজে সহযোগিতা করতে বলেন। তার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু আমি যে ভুলপথে পা বাড়িয়েছি তা ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। একটি স্বাভাবিক জীবনে বাবা- মায়ের আদর স্নেহ ভালোবাসা সবকিছু ছেড়ে বস্তি ও বন্দীর জীবন-যাপন করতে হয়।’
আবিদা আরো বলেছেন, যে মানুষটি ভালোবেসে স্বপ্ন দেখিয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়, তিনিও কষ্টের জীবনযাপন করছিল। সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিল। একপর্যায়ে এই পথ থেকে পরিত্রাণের সিদ্ধান্ত নিই। পরে আমি পালিয়ে এসে একাই র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করি। তাই র‌্যাবকে ধন্যবাদ। আমার স্বামীকেও আত্মসমর্পণ করার জন্য আহ্বান করছি। সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আবিদা জান্নাত আসমা বলেছেন, ‘আমাদের কাউকে যেন ফাঁদে পড়তে না হয়। নিজের যেন একটা জাজমেন্ট থাকে। আমরা নিজেরা যেন জাজ করতে পারি। অন্যদের কথা যেন আমরা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করি।’
প্রায় দুই বছর পর আসমার মা তার মেয়ের দেখা পান। অনুষ্ঠানে আসমাকে তার মায়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়। র‌্যাব বলছে, আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিদের প্রতিনিয়ত নজরদারি করবে তারা। মেয়েকে ফিরে পেয়ে আসমার মা শাহিদা সুলতানা বলেন, ‘আজ আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমরা আসমাকে ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালোবাসতাম। কিছু দিন আগে জানতে পারি, আসমা যাকে পালিয়ে বিয়ে করেছে সে একজন জঙ্গি। সে তাকেও জঙ্গি বানিয়েছিল। একজন জঙ্গির মা হওয়া অনেক কষ্টের। আমি সব মা-বাবাকে অনুরোধ করবো, আপনাদের সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখুন, সময় দিন।’
র‌্যাব জানায়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জঙ্গিদের সঠিক প্রক্রিয়ায় ডি-রেডিক্যালাইজেশন করে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেছেন তারা। দীর্ঘসময় কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে তাদের উগ্র আদর্শকে ধ্বংস করা হয়েছে। শাওন মুনতাহা ইবনে শওকত সর্ম্পকে র‌্যাব জানায়, সিলেটের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হিযবুত তাহরিরে যুক্ত হন তিনি। তিনি হিযবুত তাহরিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। ২০০৯ সালে আনসার আল ইসলামে যোগ দেন। পরে ২০১১ সালে মেডিক্যাল শিক্ষার্থী ডা. নুসরাতকে বিয়ে করে। স্ত্রী নুসরাতও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ। পরে সংগঠনের নির্দেশনায় তিনি ঢাকায় চলে আসে। ২০১৭ সাল থেকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জোড়ালো অভিযানে গ্রেফতার আতঙ্কে তিনি ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় বাসা বদল করতে থাকেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘শুধু দমন নয়, জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চাই। সরকার জঙ্গিবাদ শুধু কঠোরহস্তে দমন করছে তাই নয়, পাশাপাশি ডিরেডিকালাইজশনের মাধ্যমে তাদের ভুল পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করছে।
মন্ত্রী জানান, জঙ্গিদের ভুল পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আহ্বান করা হচ্ছে। তারা ফিরে এলে তাদের পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা হবে। বাংলাদেশ কখনো জঙ্গিবাদকে আশ্রয়- প্রশ্রয় দেয় না। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন জিরো টলারেন্সের কথা। এটা আমরা কখনো বলি না জঙ্গিবাদকে মূলোৎপাটন করেছি। বলেছি জঙ্গিবাদকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি অনেক দেশেই গিয়েছি। জিজ্ঞাসিত হয়েছি যে, তোমরা কীভাবে জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করছো? বলেছি, বাংলাদেশের জনগণ কখনো জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না বলেই আমরা জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ জঙ্গিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, যারা এখনো জঙ্গিবাদের মতো ভুল পথে আছে তারা দ্রুত ফিরে এসো। কারণ, তোমরা ওই ককটেল, জর্দার কৌটা বা এ জাতীয় জিনিসপত্র দিয়ে কারও বিরুদ্ধেই বিজয়ী হতে পারবে না।
আইজিপি বলেন, ওই ককটেল, জর্দার কৌটা বা এ জাতীয় জিনিসপত্র দিয়ে তোমরা কারো বিরুদ্ধেই বিজয়ী হতে পারবে না। বরং ওই পথে গিয়ে তোমরা পরিবার-সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছ। বেঘোরে প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। এই অন্ধকার জগত তোমার নিজেকে, পরিবারকে এবং রাষ্ট্রকে বিপদে ফেলতে পারে। তবে এর কোনোটাই বাংলাদেশ থেকে সৃষ্টি হয়নি। প্রতিবারই বাইরের দেশ থেকে এসেছে, প্রতিবারই শান্তিপ্রিয় মানুষের সহায়তায় আমরা তাদের পরাস্ত করেছি। এখনো যারা এ ধরণের কাজে জড়িত, তাদের প্রতি আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে। র‌্যাব, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজমসহ একাধিক টিম তাদেরকে নজরদারিতে রেখেছে। আমাদের গোয়েন্দা কমিউনিটিও এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। হয়তো পরিপূর্ণভাবে সব ঘটনা শুরুতে বিনষ্ট করতে পারিনি। ১০০ ভাগ না হলেও অন্তত ৯০ ভাগেরও বেশি ঘটনা শুরুতেই বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়েছি। যারা সমাজের মূলধারায় ফিরে এসেছে, তাদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, তোমরা আলোর পথের অভিযাত্রী, তোমাদের অভিনন্দন। জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার এই ধারা বাংলাদেশই প্রথম চালু করেছে।
আইজিপি বলেন, হলি আর্টিজানের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদেরকে নানা বিধিনিষেধ দিয়েছে। অনেকে বলেছে বাংলাদেশ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ আমাদের তখন সহায়তা করেনি। কিন্তু দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে আমরা জঙ্গিবাদকে পরাজিত করেছি।


বিজ্ঞাপন