মাসে ৩০ কোটি টাকার বাণিজ্য
মহসীন আহমেদ স্বপন : ফুটপাত তুমি কার? কথাটা যেন বারবার মনে পড়ে রাজধানীবাসীর। বিভিন্ন সময় ফুটপাত থেকে হকারদের তুলে দেয়া হলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আবারও দখল হয়ে যায়। এ যেন এক লুকোচুরি খেলার মত অবস্থা। ফুটপাতগুলো দখল হয়ে যাওয়ায় চলাচলের পথে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। চলছে রমরমা ব্যবসা। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন পথচারীরা। রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর, দিলকুশা, দৈনিক বাংলাসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় শাপলা চত্বর থেকে দৈনিক বাংলা, দিলকুশার রাস্তাগুলোর ফুটপাত দখল করে বিভিন্ন কাপড়, কসমেটিক্সসহ রকমারি সব পণ্যের দোকান দিয়ে বসেছেন হকাররা। ফলে পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে না পেরে বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন। এতে করে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট, বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এ নিয়ে দৈনিক সকালের সময় পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্ম তৎপরতা দেখালেও কয়েক দিন পর পুরনো অবস্থা ফিরে পায় ফুটপাত।
জানা গেছে ঢাকার ফুটপাত ঘিরে সক্রিয় তিন শতাধিক চাঁদাবাজ। এরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে লাইনম্যান হিসাবেই পরিচিত। এই লাইনম্যানরা লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দিনে ৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে। এ হিসাবে দিনে কম করে হলেও এক কোটি টাকার চাঁদা আদায় হয়।
ভুক্তভোগীদের একটি সূত্র জানায়, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং কিছু সন্ত্রাসীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি এসব লাইনম্যান নিয়ন্ত্রণ করছেন। এ ছাড়া প্রতিটি এলাকায়ই পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হয়। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে চাঁদাবাজরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁক গলে জামিনে বেরিয়ে আসে। আবার শুরু করে চাঁদাবাজি।
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এমএ কাশেম বলেন, রাজধানীতে এক লাখের বেশি হকার রয়েছে। লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না। এসব চাঁদাবাজকে স্থানীয় কতিপয় রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশ শেল্টার দেয়। স্থানভেদে ৫০ থেকে শুরু করে ৮০, ১০০, ১৫০, ২০০ এবং ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। তিনি বলেন, গড়ে ১০০ টাকা করে চাঁদা হিসাব করলেও দিনে এক কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। আর মাসে এ অঙ্ক দাঁড়ায় ৩০ কোটিতে। তার মতে, মাসে এ হিসাবের দ্বিগুণ চাঁদা আদায় হয়। চাঁদাবাজ দমন করে সরকার যদি এ টাকা নিত, তবে বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতো। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে পুলিশ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছিল। তারা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও চাঁদাবাজিতে নামে। দুই সিটি করপোরেশন যদি প্রকৃত হকারদের কাছে ফুটপাত ইজারা দিত, তাহলে এমন অবস্থা হতো না।
জানা যায়, শুধু ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে এমন গডফাদার গুলিস্তানে চার, সদরঘাটে তিন, নিউমার্কেটে তিন, মতিঝিলে তিন, ফার্মগেটে তিন, মিরপুর-১ নম্বরে দুই, ১০ নম্বরে দুই, উত্তরায় দুই, বাড্ডায় দুই, কুড়িলে দুজন রয়েছেন।
নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, এ এলাকায় একজন নিয়ন্ত্রক হকারদের রক্ত চুষতে চুষতে যাত্রাবাড়ীতে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ি তৈরি করছেন। এ ধরনের বেশ কয়েকজন রয়েছেন এ এলাকায়। এদের চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। তিনি বলেন, এরা ছাড়াও ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কিছু ক্যাডার চাঁদা তোলে। এদের উৎপাত সারা বছরই সইতে হয়। এর বিরুদ্ধে কথা বললে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। গুলিস্তান খদ্দের মার্কেট এলাকার এক হকার বলেন, ‘এখানে চাঁদা দিয়েই ব্যবসা করি। ব্যবসা না করলে খাব কী? আমাগো নাম লিখবেন না, লিখলে কাল থেকে আর বসতে দেবে না।’ গুলিস্তান হকার্স, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, খিলগাঁও তালতলা, মিরপুর শাহ আলী, ১ নম্বর, গুলশান-১ ও ২, মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার, মুক্তবাংলা, উত্তরা ও পুরান ঢাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও একই রকম তথ্য দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বায়তুল মোকাররম জিপিও লিংক রোডে হলিডে মার্কেটে খোকন মজুমদার, আবুল হাসেম, মজিবর, পোটল, নসু, হারুন ও তার সহযোগীরা চাঁদা আদায় করে। উত্তরগেট এলাকায় দুম্বা রহিম, সাজু চাঁদা তোলে। শাপলা চত্বরে আরিফ; পল্টনে দুলাল ও তার সহযোগী; গুলিস্তানে আহাদ পুলিশ বক্স ও রাস্তায় আমিন, সাহিদ ও লম্বা হারুন; জুতাপট্টিতে সালেহ; গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে ঘাউড়া বাবুল ও শাহীন টাকা তোলে। এ ছাড়া ওসমানী উদ্যানের পূর্ব ও উত্তর অংশে লম্বা শাজাহান; গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটের পশ্চিমে কাদের ও উত্তরে হান্নান, পূর্বে সালাম, আক্তার ও জাহাঙ্গীর; গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় লাইনম্যান সর্দার বাবুল; সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় জজ মিয়া, পূর্ব পাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া; মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে মো. আলী, আবদুল গফুর ও বাবুল ভুঁইয়া; শাহবাগে ফজর আলী, আকাশ, কালাম ও নুর ইসলাম; যাত্রাবাড়ীতে সোনামিয়া, তোরাব আলী, মান্নান টাকা তোলায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। জুরাইন-পোস্তগোলায় খায়রুল, সিরাজ তালুকদার ও গরু হানিফ; লালবাগে আবদুস সামাদ, চানমিয়া ও ফিরোজ; মিরপুর-১-এ ছোট জুয়েল, আলী, বাদশা ও মিজান; মিরপুর-১১-এ আবদুল ওয়াদুদ, শফিক ও হানিফ; গুলশানে হাকিম আলী; কুড়িলে আবদুর রহীম ও নুরুল আমিন; এয়ারপোর্টে আকতার, মনির, ইব্রাহিম, জামাল ও বাবুল; উত্তরায় টিপু, নাসির ও হামিদ চাঁদা তোলে।
এ প্রসঙ্গে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় ফুটপাতের চাঁদাবাজরা অনেকটাই কোণঠাসা। পুলিশ অভিযোগ পেলে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে, আমরা ফুটপাত হকার এবং চাঁদাবাজমুক্ত রাখতে অভিযান চালাচ্ছি।