নিজস্ব প্রতিবেদক : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালা জন্য, যিনি সমগ্র জগতসমূহের প্রতিপালক তিনি এক ও অদ্বিতীয়। অগণিত দরুদ-সালাম নজরানা রাসূলে মাকবুল রাউফুর রাহীম নূরনবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর, যিনি সমগ্র জগতসমূহের নবী ও রাসূল এবং রাহমত। সকলের প্রতি আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালার দরবারে কামনা সালাম, রাহমত ও বারাকাত।
ইসলাম হলো দ্বীনের বহু শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট সমষ্টিগত বাহ্যিক এবং ভিতরগত রূপের নাম, যার ভাবার্থ শান্তিময় বিধান। ঈমান হলো এমন এক ধরণের প্রত্যয় বা বিশ্বাস যাতে কোন দ্বিধা, দ্বন্দ ও সন্দেহ নেই। আর শরীয়াহ হলো দ্বীনের বাহ্যিক রীতিনীতিময় বিধান। যা নির্দিষ্ট সীমারেখায় সীমাবদ্ধ। ইহসান বা মা’রিফাত কিংবা তৌহিদ হলো ইসলামের পূর্ণতা ও মহত্বে অন্তর ক্রিয়া পরিস্ফুটিত দ্বিধামুক্ত এবং সন্দেহের অতীত জ্ঞান। এটি কল্যাণকর পবিত্র জ্ঞানও বটে। মা’রিফাত বর্জিত ইসলামি শিক্ষা তথা শুধু মাত্র শরীয়ার জ্ঞান দ্বারায় মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগ্র করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। কথিত আছে মনুষ্যত্বহীন মানুষ পশুতুল্য। সুতরাং এতে দ্বিধা দন্দেরও কোন স্থান নেই। তাই শুধু মাত্র শরীয়ার জ্ঞান অর্জিত ব্যক্তির দ্বারায় মানবতাবিরোধী এবং সৃষ্টির অকল্যাণকর কর্ম বা কাজ সম্পাদিত হওয়াটাই স্বভাবিক। এজন্যেই ইসলামে ইলমে মা’রিফাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
মা’রিফাত আরবী শব্দ। আরবী আল মা’রিফাত শব্দটি আরাফা ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত এর অর্থ পরিচয়। ভাবার্থ কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা।এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা বুঝানো হয়। এককথায় আল্লাহ কে চেনার জ্ঞানই হচ্ছে মা’রিফাত।
এছাড়াও সূফীদের ব্যাখ্যায় মা’রিফাত যথা মীম+ রা +ফা+ তা। অর্থাৎ মা-মানে নিজ, রা এবং ফা মানে আল্লাহ কে চেনার মাধ্যম, তা মানে তৌহিদ। আশশরীয়া’তু শাজারাতু ওয়াতত্বরীকাতু আগসানুহাওয়ালমা’রিফাতু আওরাকুহা ওয়ালহাকীকাতু ছামারুহা। (সিররুল আসরার-পৃ.৩৩) অর্থঃ ‘‘শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।’’ আশশরীয়া’তু আকওয়ালী ওয়াতত্বরীকাতু আফয়া’লী ওয়াল হাকীকাতু হালী ওয়ালমা’রিফাতু রা’ছু মালী। (আজলূনী,পৃ.২,কাশফুল খাফা,পৃ.৬) অর্থঃ ‘‘শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্ম, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন।’’
‘‘মারিফাত’’ সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা রাহঃ বলেন, নারিফুল্লাহা তা’য়ালা হাক্কা মা’রিফাতিহি কামা ওয়াসাফাল্লাহু নাফসাহু ফী কিতাবিহি বিজামীয়ি’ সিফাতিহি ওয়াইয়াসতাওয়ীল মু’মিনূনা কুল্লুহুম ফীলমা’রিফাতি ওয়ালইয়াক্বীনিওয়াত্তাওয়া কুল্লি ওয়ালমুহাব্বাতি ওয়াররদা ওয়ালখাওফি ওয়াররাজায়ি ওয়ালঈমানি ফী জালিকা ওয়াইয়াতাফা ওয়াছূনা ফীমা দূনালঈমানি ফী জালিকা কুল্লুহি।(ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার (মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যা-সহ), পৃ. ১৫১-১৫৭। অর্থঃ ‘‘মহান আল্লাহর প্রকৃত মা’রিফাত আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। মুমিনগণ সকলেই মারিফাতের বিষয়ে ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট: মারিফাত ঈমানেরই অন্যতম অংশ। আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত লাভই ঈমানের পথে পরিচালিত করে। এজন্য সকল মু’মিনই আল্লাহর হক্ক বা প্রকৃত মা’রিফাত লাভ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই মর্যাবান। মহান আল্লাহ তা’য়ালা তার নিজের বিষয়ে ওহী কিংবা এলহাম অথবা এলকার মাধ্যমে তার প্রিয়জনদেরকে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াও মা’রিফাতের অন্তরগত। মৌলিকভাবে মা’রিফাত বা আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালার পরিচয় তাই, হাদীসে জিবরাঈলে “ইহসান” এর পরিচয়ে উদ্ধৃত। তথা- যখন হযরত জিবরাঈল আঃ রাসূল সাঃ কে জিজ্ঞাসা করেন, ক্কালা, ফামালইহসানু? ক্কালা, আন তা’বুদাল্লাহি কাআন্নাকা তারাহু ফাইনলাম তাকুন তারাহু ফাইন্নাহু ইয়ারাকা।(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৩৬৭, সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৫০, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৮) অর্থঃ “ইহসান কি?” তখন রাসূল সাঃ জবাবে বলেন, তুমি আল্লাহর বন্দেগী এভাবে কর যে, যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ (প্রত্যক্ষ করছ), যদি তাকে দেখতে না পাও, তাহলে অন্তত ভাবো তিনিই তো তোমাকে দেখছেন।”
মা’রিফাত, ত্বরীকত, হাকীকতের জ্ঞানীদেরকে ইলমে তাছাউফ বলে থাকে। এসম্পর্কে হযরত ইমাম মালিক রাহঃ বলেন, যে ব্যক্তি ইলমে ফিকাহ (জবানী ইলম) অর্জন করলো কিন্তু ইলমে তাছাউফ (কলবী) ইলম অর্জন করলো না সে ব্যক্তি ফাসিক (মিথ্যুক)। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাছাউফ অর্জন করলো কিন্তু ইলমে শরীয়ত অর্জন বা স্বীকারও করলো না সে ব্যক্তি যিন্দিক(কাফের)। আর যে ব্যক্তি উভয় প্রকার ইলম অর্জন করলো সে ব্যক্তি মহাক্কিক তথা মু’মিনে কামেল।, (মিরকাত)
অন্য জায়গায় বিষয়টি এভাবে উল্লেখ আছে, যে শুধু শরীয়ত অনুসরণ করে সে হলো মুনাফিক আর যে শুধু মা’রিফাত অনুসরণ করে সে হলো ফাসিক। হযরত গাউসুল আজম আব্দুল কাদির জিলানী রাহঃ বলেন, মান আরাদাল ই’বাদাতা বা’দাল ওয়াসালি ফাহুওয়া কাফিরুন।
অর্থাৎ আবেদের ইবাদত অজানা আল্লাহর জন্য আর আ’রিফদের লক্ষ্য বা সাধনা মা’রিফাত (প্রত্যক্ষ)। এজন্য আবেদদের জাহেল বা মুর্খ আর আ’রিফদের জ্ঞানী বা প্রত্যক্ষদর্শী বলা হয়।
ইলমে মা’রিফাত অর্জন একজন মুসলিম ব্যক্তির জন্য অপরিহার্য বিষয়। কেননা এই ইলম অর্জন ছাড়া একজন ব্যক্তি ঈমানদার মু’মিন হওয়া তো দুরের কথা মানুষ বনাও সম্ভব নয়। ইলমে মা’রিফাতের বিচরণের মধ্য দিয়ে মানুষ তৌহিদে আত্মমগ্ন হয়। যার মাধ্যমে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান প্রাপ্তি ঘটে। কালিমায়ে তাইয়্যেবার স্বরূপও উন্মোচিত হয় বোধশক্তিতে। ধর্ম বর্ণের বিদ্বেষ চিরতরে বিদায় নেয় মনোজগত থেকে। সাম্য আর মরমীতে ঐক্যত্ব জাগে মানুষ মানুষে। মানবতাবিরোধী যজ্ঞের মৃত্যু ঘটে হৃদয়ে। বিবেক জেগে উঠে কল্যাণকর মানুষ ও সমাজ বিনির্মানে। সন্ত্রাস, জঙ্গি তৎপরতা,সাম্প্রতিক দাঙ্গা, উগ্রতামূলক উস্কানি বক্তব্য ও মানবতাবর্জিত কর্ম থেকে বিরত করে শেকড়ে। ইলমে মা’রিফাতের নির্যাসে জীবন হয় শান্তিময় সুখময় জগতসমূহ হয় এক পরিবার। তবে মা’রিফাত অর্জনের জন্য একজন প্রশিক্ষক আবশ্যক। ইসলামের শরীয়ত, ত্বরীকত, হাকীকত ও মা’রিফাত অর্জিত ব্যক্তিই হতে পারে সে প্রশিক্ষক। এই প্রশিক্ষক কে ইসলামি পরিভাষায় মুবাল্লিগ, মুয়াল্লিম, পীর, মুর্শিদ কিংবা রাহাবরে রাবেতা বলা হয়। বাংলায় বলা হয় গুরু, পথপ্রদর্শক ও অভিভাবক। যদি কেউ নিজেকে ইসলামি বিধানে আত্মজ্ঞানে পরিশুদ্ধ সৃষ্টির কল্যাণকর বোধসম্পন্ন মনুষ্যত্বপূর্ণ জাগ্রত মুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান। তাহলে বিলম্ব না করে দ্রুত একজন অভিভাবকের দারস্থ হন।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, বাংলাদেশ সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম। (লেখাটি সংগৃহীত)