মানবিক পুলিশ, পুলিশের মানবিকতা, ঘটনার স্বাক্ষী লালবাগ থানা

অপরাধ

আজকের দেশ রিপোর্ট : পুলিশের জনসমর্থন হীন ঘটনার মধ্যে অতিমানবিক ঘটনার নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু সেগুলো লোকসমাজে বেশি করে প্রকাশ ও প্রচার না হওয়ায় জনগণ পুলিশের মানবিকতার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা অনস্বীকার্য।


বিজ্ঞাপন

তারা তাদের সেই ভূমিকা সঠিকভাবে পালন না করায় জনগণ তাদের বিষয়ে সম্যক ধারণা থেকে দূরে রয়েছেন। তবে এ অতি মানবিক এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে রাজধানীর লালবাগ থানায়।


বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২৫ মে) এবিষয়ে লালবাগ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার ফেসবুকে একটি পোস্ট প্রকাশ করেন। যা পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো।

ঘটনা বর্ণনায়, গত সপ্তাহে লালবাগ থানায় ওসির অফিস রুমে বসে আছি। এসময় এক মহিলা অফিসে আসলেন। তিনি দেড় বছর আগে এতিমখানায় তার মেয়েকে রাখার জন্য আসলে এতিমখানার সামনে সেখানকার দারোয়ানের মাধ্যমে নিজের মেয়ে সোনালী-কে এক মহিলার কাছে দত্তক দেন।

কিন্তু দত্তক দেয়ার কিছুদিন পর থেকে সেই দারোয়ান বা দত্তক গ্রহণকারী মহিলা কারো দেখা পাচ্ছেন না বা কারো সাথেই ফোনেও যোগাযোগ করতে পাচ্ছেন না । মেয়ের অজানা আশঙ্কায় তিনি এখন তার মেয়ের সন্ধান চান।

সাথে সাথেই ডিউটি অফিসারকে যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণের নির্দেশ দেই। মহিলাকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তার নাম হোসনে আরা। তার সাথে খোকনের বিয়ে হয় প্রায় সতেরো বছর পূর্বে। তার আর খোকন দম্পতির সুখের সংসারে জন্মগ্রহণ করে ০৪টি সন্তান। ভালোই চলছিল সে সংসার।

কিন্তু স্বামী খোকন অন্য একটি বিয়ে করে অনত্র বসবাস করতে শুরু করলো। এদিকে হোসনে আরা পড়ে গেলেন অথৈ সাগরে। চার সন্তান নিয়ে লালবাগ থানাধীন আজিমপুর এলাকায় তিনি মানবেতর জীবন-যাপন করতে লাগলেন। জীবন ধারণের জন্য তার শিশু সন্তানকে পার্শ্ববর্তী জুতার কারখানায় কাজে দিয়ে দিলেন। অন্যদিকে হোসনে আরা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে সামান্য কিছু আয় করেন।

ছেলে আর মায়ের সম্মিলিত আয়ও ০৫ জনের সংসারের জন্য তা পর্যাপ্ত হয় না। হঠাৎ হোসনে আরার মনে হয় পাশেই তো আজিমপুর(স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা) এতিমখানা। একটা সন্তান এতিমখানায় দিলেই তো হয়। তাই তিনি এতিমখানায় যোগাযোগের চেষ্টা করেন একটা বাচ্চাকে এতিমখানায় রাখার জন্য।

অন্যদিকে রুনা লায়লা একমাত্র কন্যা সন্তান নিয়ে থাকেন মিরপুর এলাকায়। কর্মজীবি মা হওয়ায় মেয়ে-কে বাসায় একাই থাকতে হতো। ফলে তার মেয়ে একাকিত্ব জনিত সমস্যায় ভুগতে থাকে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার রুনা লায়লাকে আরো একটি সন্তান নেয়ার পরামর্শ দেন।

তাহলে তার মেয়ে একজন খেলার সাথী পাবে। কিন্তু স্বামীর সাথে রুনা লায়লার বিচ্ছেদ হওয়ায় তা আর সম্ভব হয় না। তাই রুনা লায়লা সিদ্ধান্ত নেন তিনি একটি সন্তান দত্তক নিবেন। সে লক্ষ্যে তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় যোগাযোগের জন্য আসেন। কিন্তু এতিমখানার গেটে তিনি পড়ে যান দালালের খপ্পরে।

এতিমখানার কথিত দারোয়ান তাকে বলে, “নিয়ম অনুযায়ী আপনি সন্তান নিতে পারবেন না, তবে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। আপনি ফোন নম্বর দিয়ে যান।” রুনা লায়লা কথিত দারোয়ানের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ফোন নম্বর দিয়ে চলে যান। ভবিষ্যতে কোন বাচ্চা আসলে কথিত দারোয়ান তার সাথে যোগাযোগ করবে।

এদিকে হোসনে আরা তার ০৬ বছরের মেয়ে সোনালীকে এতিমখানায় রাখার উদ্দেশ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় আসলে কথিত দারোয়ান বিষয়টি বুঝতে পেরে রুনা লায়লাকে ফোন করে আসতে বলেন এবং হোসনে আরার সরলতার সুযোগ নিয়ে তার মেয়েকে রুনা লায়লার কাছে দত্তক হিসেবে তুলে দেন। রুনা লায়লা তাকে ফোন নম্বর দিয়ে বলেন যে মেয়েকে দেখার ইচ্ছে হলে সে যেন তাকে ফোন দিয়ে বাসায় চলে আসে।

কিছুদিন যাওয়ার পর হোসনে আরা তার মেয়ের সাথে দেখা করার জন্য রুনা লায়লার নম্বরে ফোন দিলে মোবাইল নম্বর বন্ধ পান। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে মায়ের মন। তার ভিতরের মমতাময়ী মায়ের মন কেঁদে উঠে। তিনি তার মেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য আবার এতিমখানায় যান।

কিন্তু সেখানে উপস্থিত দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলে বুঝতে পারেন, কথিত দারোয়ান তথা দালাল তার মেয়েকে এতিমখানা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে অন্যের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে। একদিকে তিনি অন্যদিকে দালালও লাপাত্তা। বিভিন্নভাবে নানা জায়গায় অনেক খোঁজখুজির পরও কোথাও না পেয়ে তিনি লালবাগ থানায় আসেন। ইতিমধ্যে অতিবাহিত হয়েছে প্রায় দেড় বছর।

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে লালবাগ থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তদন্তের এক পর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে রুনা লায়লার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর গতকাল লালবাগ থানার একজন চৌকষ অফিসার এস আই ফিরোজের নেতৃত্বে মিরপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়।

ফিরিয়ে দেয়া হয় তার মায়ের কোলে। যে মা তার জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলেন প্রায় দেড় বছর। হাসি ফুটে উঠে মা-মেয়ের মুখে। সোনালীকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরে খুশি আমরাও।