নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন চার হাজার ৬৩৬ জন। ২১ জুন এই তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার আগের দিন শনাক্ত হন তিন হাজার ৬৪১ জন। এর আগে সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল ২৪ ঘণ্টায় চার হাজার ৫৬৯ জন শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছিল অধিদফতর।
গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৮ জন, তার আগের দিন ৮২ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছিল।
দেশে শনাক্ত রোগী বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শনাক্তের হারও। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৭৩ শতাংশ আর মৃত্যু হার এক দশমিক ৫৯ শতাংশ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম নতুন করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে সেটি ছড়িয়ে পরে পুরো বিশ্বে। পরের বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গত বছরের শেষ দিকে এসে সংক্রমণ কমতে থাকে।
তবে চলতি বছরের মার্চ থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে থাকে। সেময় দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা হাজারের ওপরে চলে যায়। একইসঙ্গে বাড়তে থাকে মৃত্যুও। গত ১৯ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ ১১২ জনের মৃত্যুর কথা জানায়। সেসময় শনাক্ত ও মৃত্যু বাড়তে থাকায় পাঁচ এপ্রিল থেকে মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, যা এখনও বহাল রয়েছে।
এ বিধিনিষেধের ফলাফলে সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সে বিধিনিষেধ শিথিল হয়ে পড়ে। শহর ছেড়ে যাওয়া মানুষ গ্রামমুখী হয়, যেখানে স্বাস্থ্যবিধির কোনও বালাই ছিল না। তাতে করে জনস্বাস্থ্যবিদরা আশঙ্কা করেন ঈদের পর সংক্রমণ আবার বেড়ে যাবে।
সেইসঙ্গে দেশে ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোগী বাড়তে শুরু করেছে, হাসপাতালে জায়গা দিতে করোনা বেড বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা হাসপাতালগুলো।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। যার ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতেও। যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে।
একইসঙ্গে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত ৬০ ব্যক্তির নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করে ৬৮ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে আইসিডিডিআরবি। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৬০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে জানিয়ে আইসিডিডিআরবি সূত্র জানায়, সংগৃহীত নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখা গেছে এর ৬৮ শতাংশ ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ২২ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং বাকি নমুনাগুলো ১২ শতাংশ নাইজেরিয়ার ইটা ভ্যারিয়েন্ট।
দেশে এ তিন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানী ঢাকার সরকারি চারটি বড় হাসপাতালেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই বলে জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে। আর ঢাকার বাইরের কোনও কোনও হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে।
এদিকে, করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি জুন মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে না বলে মনে করছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর। গত ৬ জুন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে এ শঙ্কার কথা বলেন অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। তারা বলছেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণক্ষমতা আগের সব ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্রুত। ফলে এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। সীমান্তবর্তী জেলাসহ তার আশেপাশের জেলাগুলোতে হাসপাতালে উপচে পড়ছে রোগী। এখনই যদি সংক্রমণের লাগাম না টেনে রাখা যায় তাহলে করোনার এবারের ঊর্ধ্বগতি আগের সব বিপর্যয়কে ছাড়িয়ে যাবে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে আরও বিপর্যয় আসছে। তার মতে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। সরকার এসব মানাতে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না।
সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকি বাড়বে। জুন মাসতো শেষ হয়ে গেছে প্রায়। জুলাই-আগস্ট নাগাদ এরকম বাড়তে থাকবে। তারপর হয়তো কমতে থাকবে, বলেন তিনি।
সীমান্ত দিয়ে করোনার ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়েছিল, কিন্তু এখন সেটা পুরো দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন।
এখন সেটা জেনারালাইজড হয়ে গেছে মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যেসব শহরে শনাক্তের হার ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে এখন সেসব প্রতিটি জেলাতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। এ ছাড়া তুলনামূলক কম জরুরি অফিস আদালত বন্ধ করে দেওয়াও দরকার।
আগে শনাক্তে হার ছিল ধীরগতির কিন্তু এবারে বাড়ছে দ্রুত গতিতে। আগে এটা হয়নি জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ বাড়ছে। ঢাকাতে এখনও শনাক্তের হার ১০ এর নিচে রয়েছে, কিন্তু যদি সেটা ২০ শতাংশের ওপরে উঠে যায় তাহলে সব বন্ধ করেও তখন লাভ হবে না।
একইসঙ্গে সামনে রয়েছে কোরবানির ঈদ। সেসময় সারাদেশ থেকে ঢাকাতে পশু নিয়ে আসা হবে। তার আগে যদি সংক্রমণ কমানো যায় তাহলে তখন একটা ব্যালেন্স হতে পারে। কিন্তু এখন যদি সংক্রমণ বাড়তেই থাকে, আর তার সঙ্গে যদি কোরবারি ঈদের চলাচল যোগ হয়ে যায়; তাহলে সেটা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাবে।
তাই এখন সংক্রমণ কমানো দরকার। আগাম অ্যাকশন নিতে হবে, নয়তো এটা রোধ করা যাবে না- বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।
সংক্রমণ আরও বাড়বে এবং এটা করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, যদি কোরবানি ঈদ পর্যন্ত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে হয়তো একটা পর্যায়ে যাবে, নয়তো ঈদের পর এটা আরও সাংঘাতিক হবে। আরও বিপর্যয় হবে।
চিন্ময় দাস বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। আর যখন রোগী বেশি হবে, তখন মৃত্যুও বাড়বে- এটা খুব সহজ হিসাব। ডেল্টার সামাজিক সংক্রমণ অনেক বেশি হয়েছে। গ্রাম থেকেও এখন হাসপাতালে বেডের জন্য ফোন পাচ্ছি আমরা। কাজেই ‘গ্রামে করোনা নেই’- এই ধারণা যে ঠিক নয়, এই প্রবণতার মাধ্যমে সেটাও এখন প্রমাণ হচ্ছে।