বিজেপি আমার লজ্জা বইটি পছন্দ করে : তসলিমা নাসরিন

আন্তর্জাতিক

আজকের দেশ ডেস্ক : ভারতবর্ষের ভেতরে বাইরে বিজেপিবিরোধী লোক প্রচুর। বিজেপি কারো ওপর অন্যায় করলে বিজেপিবিরোধীরা সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে দেরি করে না।


বিজ্ঞাপন

আমাকে বিজেপিবিরোধীরা কখনো পছন্দ করে না। কেন, আমি কি বিজেপিতে নাম লিখিয়েছি? পছন্দ করে না, কারণ বিজেপি আমার একটি বই খুব পছন্দ করে, তাই। বইটির নাম লজ্জা। বিজেপি বইটি পছন্দ করে বলে বিজেপিবিরোধীরা আমার সেই বইটির খুব বদনাম করে। বইটি জুড়ে আছে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বর্ণনা। বিজেপিবিরোধীরা দাবি করে তারা সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু অবাক কাণ্ড সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানো আমাকে তাদের পছন্দ নয়। কারণ আমি যে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়িয়েছি, তারা ভারতের সংখ্যালঘু নয়, তারা বাংলাদেশের সংখ্যালঘু। আমি তো পৃথিবীর যে কোনও দেশে যারাই সংখ্যালঘুর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে, তাদের সমর্থন করি, তাদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি। ভারতবর্ষের বিজেপিবিরোধীরা তা করে না। তারা যেহেতু ভারতের মুসলমান সংখ্যালঘুর পক্ষ নেয়, তাই তারা অন্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ- মুসলমান দ্বারা আক্রান্ত কোনও সংখ্যালঘুর জন্য সমবেদনা প্রকাশ করে না।


বিজ্ঞাপন

বিজেপি যদি কারও ওপর অন্যায় করে, অথবা হিন্দু মৌলবাদীরা যখন কাউকে আক্রমণ করে, তখন, আগেই বলেছি, বিজেপিবিরোধীরা তার পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের কোনও বৈষম্য নিয়ে আমি কিছু প্রশ্ন করে যখন হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত হই, বা বিজেপি সরকার যখন আমার রেসিডেন্স পারমিট ১ বছরের জায়গায় ২ মাস দিয়ে বুঝিয়ে দেয় আমার পাশে তারা নেই, তখন কিন্তু বিজেপিবিরোধীরা আমার পাশে দাঁড়াতে আসে না। আমাকে ব্রাত্য করেছে তারা, ইসলাম এবং ইসলামি মৌলবাদের সমালোচনা করেছি বলে আমি ব্রাত্য, হিন্দুর পাশে, সে সংখ্যালঘু হলেও, নির্যাতিত হলেও, দাঁড়িয়েছি বলে ব্রাত্য। জীবনভর নারীর সমানাধিকার, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ইত্যাদির পক্ষে এবং সব রকম মৌলবাদ, সংকীর্ণতা, কুসংস্কার ইত্যাদের বিপক্ষে চল্লিশটিরও বেশি বই লিখলেও তারা আমাকে বিজেপির লোক, বা হিন্দু মৌলবাদের দোসর বলে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আমাকে তাদের সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান থেকে বাতিল করে, আমাকে কালো তালিকাভুক্ত করে। অবশ্য তারা মনে মনে ঠিকই জানে যে আমি কারো দোসর নেই, আমার আপসহীন কণ্ঠস্বর আমার একার। তারা ঠিকই জানে যে আমার মতো তারা আসলে পৃথিবীর সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে একই রকম সরব হতে পারে না। মুসলিম মৌলবাদীদের অন্যায় তাদের গোপনে গিলে ফেলতে হয়। তারা হয়তো মনে করে সংখ্যালঘু মুসলিমের ন্যায্য অধিকার দাবি করলে তাদের ধর্মের এবং মৌলবাদের পক্ষ নিতে হয়। না নিলে সমর্থনটায় জোর থাকে না। আমি তো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের পাশে দাঁড়িয়েছি, আমি তো তাই বলে হিন্দুধর্মের গুণগান গাইনি!

বিজেপি আমার বিরুদ্ধে গেলে বিজেপিবিরোধীরা আমার হয়ে কথা তো বলেই না, বিজেপির অমানবিক হওয়ার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। বরং বলে, ‘দেখ, দেখ বিজেপিও ওকে পছন্দ করে না’। তার মানে আমাকে বিজেপি পছন্দ না করলে বিজেপি ভালো, আর আমি মানুষটাই গণ্ডগোলে, খারাপ।

হিপোক্রেসির কিছু না কিছু সীমা থাকে। কিন্তু আমাকে যে করেই হোক অপদস্থ অপমান যারা করবে বলেই ঠিক করেছে, আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে ছড়াতে আর অপপ্রচার করতে যাদের এতটুকু বাধে না, তাদের হিপোক্রেসির কোনও সীমা নেই। এইসব হিপোক্রেসি দেখতে দেখতে আমি বাঁচি। যত দেখি, তত নিজের প্রতি ভালোবাসা আর বিশ্বাস জন্মায়।