বিশেষ প্রতিবেদক : পুলিশের বরখাস্ত ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে নিজ সংস্থার বরখাস্ত কর্মকর্তা এনামুল বাছিরকে পায়নি দুদক। তিনি অসুস্থ জানিয়ে সময় চেয়েছেন।
এর আগেও দেখা গেছে, দুদক যাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে তাদের মধ্যে বহু জনই উপস্থিত না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময় চেয়ে আবেদন করেন। আর এই সময় আবেদনের সিংহভাগ কারণ হিসেবেই জানানো হয় অসুস্থতার কথা। তবে আদৌ তারা চিকিৎসা নিয়েছেন কি না, নিলে কোথায় নিয়েছেন, এই বিষয়টি আর পরে কেউ জানান না। দুদকও এটি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে না। কেউ কেউ হাজিরার দিন দুদককে না জানিয়ে বিদেশ গেছেন। পরে লোক মারফত জানিয়েছেন, তার চিকিৎসকের অ্যাপয়নমেন্ট রয়েছে। কেউ কেউ একাধিক দিন জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়েছেন একই ধরনের আবেদনে। আবার এমনও দেখা গেছে অসুস্থতার কথা বলে দুদকে না গেলেও দৈনন্দিন কাজ করেছেন কেউ কেউ।
তলবের তারিখে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয়টিকে সন্দেহজনক বলছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার একাধিক ব্যক্তি। তাদের ধারণা, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে সময় চেয়ে আবেদন আসলে করা হয় সময়ক্ষেপণের জন্য। এই বাড়তি সময়ে তারা পার পেয়ে যাওয়ার মওকা খোঁজেন।
গতকাল ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের দুদকে হাজিরার তারিখ ছিল। কিন্তু যাননি কেউ। সময়ের আবেদন করেন দুজনই। এর মধ্যে মিজান দেখান ব্যক্তিগত কারণ, আর বাছির দেখান অসুস্থতা।
হাজিরার দিনই অসুস্থ হলেন?-এমন প্রশ্নে দুদকের বরখাস্ত কর্মকর্তা বাছির বলেন, আমি সঠিক সময় নোটিশ পাইনি। আর আমার ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও হার্টে রিং পরানো আছে। আমি কয়েকদিন ধরে পেটের পীড়ায় ভুগছি। এ ছাড়াও আমার উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে গেছে। তাই আমি আমার আবারও নোটিশ পাঠানো এবং সময় বাড়ানোর আবেদন করেছি।
সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকে ডাকা হয়েছিল জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে। তিনি দুদকের হাজিরা একাধিকবার এড়িয়েছেন অসুস্থতার কথা বলে। সবশেষ চলতি বছরের ২০ মে অবশ্য তিনি ওমরাহ পালনের জন্য দেশ ছাড়বেন বলে সময় চান। তবে এর আগে একাধিকবার তিনি যাননি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে।
গত বছরের ১৫ জুন হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের (ওয়াকফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাকিম ইউছুফ হারুনও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ এড়ান অসুস্থতার কারণে। ‘শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের’ অভিযোগে দুদকের সহকারী পরিচালক সাইদুজ্জামান নোটিশ পাঠিয়ে তাকে ডাকেন। কিন্তু হারুণ অসুস্থ হয়ে সময়ের আবেদন করেন।
সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনও দুদকের তলবের পর অসুস্থ হয়েছেন। ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে তাকে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল তলব করে দুদক। কিন্তু তিনি সেদিন অসুস্থ হয়ে যান।
সরকারি গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মশিউর রহমানও একই কাজ করেছেন। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর তার দুদকে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডায়াবেটিকসহ নানা শারীরিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে তিনি সেদিন তিন সপ্তাহের সময়ের আবেদন করেন। অথচ সেদিন ঠিকই তিনি অফিস করেছেন।
মীর মশিউর রহমানের মতো একইভাবে অসুস্থতার কথা জানিয়ে দুদকের কাছে সময় চান উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এস এম আবদুল ওয়াদুদ। তাকেও এমডির সঙ্গে ডাকা হয়েছিল।
দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচ কর্মচারীও দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ একাধিকবার এড়িয়েছেন অসুস্থ হয়ে।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ২০১৮ সালে ৭ মে দুদকের জিজ্ঞাবাদ এড়ান অসুস্থ হয়ে। বিরুদ্ধে ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ৬১ টি মামলা করে দুদক।
চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি শতকোটি টাকা অর্জনের অভিযোগে ল্যাব এটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন হিসাবরক্ষক লিয়াতক হোসেন উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম অফিসসহকারী শরিফুল ইসলাম এবং গাড়ি চালক রফিকুল ইসলামকে ডাকা হয়। কিন্তু তারা অসুস্থতার কথা বলে সময়ের আবেদন করেন।
এভাবে তলবের দিন অসুস্থ হয়ে পড়াকে কীভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, দুদক ডাকলে অনেকেই আসেন। আবার অনেকেই সময়ের আবেদন করেন। এখন অনেকের তো সমস্যা থাকতেই পারে। হাজার হাজার ব্যক্তিকে ডাকা হয়। তার মধ্যে দুই একজনের সমস্যা তো থাকতেই পারে। সময়ের আবেদন করলেও পরে তারা ঠিকই দুদকে এসে তাদের বক্তব্য দিয়ে যান।
তবে দুদক কর্মকর্তার এই ‘সরল বিশ্বাসে’ আস্থা নেই দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের। তিনি বলেন, ‘ডাকলেই ওনারা অসুস্থতার কথা বলে একটি কৌশল তৈরি করেন। এটা বাদেও অন্য কৌশলও আছে তাদের। এটা জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা। এসব ক্ষেত্রে তাদের উচিত হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সময়মত দুদকে হাজির হয়ে সঠিকভাবে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। আর দুদকের উচিত হবে নতুন কোন পন্থা বের করে তাদেরকে সময়মত হাজির করে জবাবদিহিরতা নিশ্চিত করা। আর তারা সত্যি সত্যি অসুস্থ নাকি অযুহাত তৈরি করেছেন, এই বিষয়টিও খতিয়ে দেখা উচিত।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানও মনে করেন আসলেই অসুস্থ কি না, এই বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সময় আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। তিনি বলেন, কে অসুস্থ আর কে অসুস্থ না এটা দেখার দায়িত্ব দুদকের। দুদক যদি মনে করে তিনি অসুস্থ, তাহলে সময় দেবে। আর যদি মনে হয় অসুস্থ না, তাহলে সময় দেবে না। এটা দুদকের দেখার বিষয়।