পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ
নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি-গাছপালা
আজকের দেশ ডেস্ক : দেশের ১০ নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৯৩টির মধ্যে ৬৯টি পয়েন্টে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়েছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা করছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। পাহাড়ি ঢল ও ভারি বৃষ্টিতে প্লাবিত হতে পারে আরো বেশকিছু এলাকা।
আষাঢ়ের শেষদিকে এসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকা তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুরের গ্রাম ডুবে আছে সুরমা নদীর পানিতে। টাঙ্গুয়ার হাওর পানিতে থৈথৈ। জালামগঞ্জ, ধর্মপাশাসহ ছয় উপজেলার বাসিন্দারা পানিবন্দি। বন্যা পূর্বাভস কেন্দ্র বলছে, ভারতে চেরাপুঞ্জিতে প্রতিদিন গড়ে বৃষ্টি হচ্ছে সাড়ে ৩০০ মিলিমিটার। শিলং ও আসামে ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের মনু, যাদু, কুশিয়ারার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। দক্ষিণের পার্বত্য এলাকার মাতামুহুরী, সাঙ্গু নদীর পানিও বিপদসীমার উপরে। লালমনিরহাটের দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা, যমুনেশ্বরী, যমুনাসহ উত্তরাঞ্চলে সব নদীর পানি বাড়ছে প্রতিদিনই।
এক সপ্তাহ ধরে অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার ফলে সারা দেশের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে পার্বত্য এ জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। বৃষ্টির কারণে ও সাগর উত্তাল থাকায় গত ছয়দিন ধরে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যত বন্ধ আছে। বন্দরে প্রবেশ করা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি যানজটের কারণে স্বাভাবিকভাবে বেরুতে পারছে না, প্রবেশেও ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাসে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কনটেইনার জটের পাশাপাশি জেটিতে জাহাজ জটও তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। প্রতিদিনই যমুনা নদীতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে ভাঙনের তীব্রতা। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে এলাকার ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও গাছপালা। পাহাড়ি ঢলে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে লালমনিরহাটে প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নেত্রকোনার দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কবলে তিন উপজেলার তিন শতাধিক গ্রামে ৫০ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকছে। বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে থাকায় উপজেলা ও জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ অব্যহত থাকতে পারে। ঢাকার আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দছ বলেন, অতি ভারি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।
বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত বান্দরবান : এক সপ্তাহ ধরে অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার ফলে সারা দেশের সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে পার্বত্য এ জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। গত কয়েক দিনের মতো গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া এ বর্ষণ ও ঢলে এরই মাঝে বান্দরবান সদর, রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অধিকাংশ জায়গা প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে বন্যার পানিতে নতুন করে আরো বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ সড়ক ও গ্রাম প্লাবিত হয়। এদিকে প্রধান সড়কের বাজালিয়া, দস্তিরদাহাট, বরদুয়ারা অংশ প্লাবিত হওয়ায় চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্ধ রয়েছে রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদমের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও। এ ছাড়া পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন সড়কও বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। চার দিন ধরে প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ বিভিন্ন কাঁচামালের সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে মন্দা ভাব। এরই মাঝে জেলার সাত উপজেলার ১২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন হাজার হাজার বন্যাকবলিত মানুষ। অবিরাম বর্ষণের ফলে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে মাইকিং করে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হচ্ছে।
লালমনিরহাটে পানিবন্দি প্রায় ১২ হাজার পরিবার : টানা পাঁচ দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে লালমনিরহাটে প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শুক্রবার দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। যা (স্বাভাবিক ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার) বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরআগে গত বৃহস্পতিবার তিস্তার পানিপ্রবাহ দোয়ানী পয়েন্টে বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ ৫২ দশমিক ৬৮ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়, যার স্বাভাবিক মাত্রা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার। বিপৎসীমার আট সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গত পাঁচ দিনের ভারি বৃষ্টি। এতে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলার তিস্তা ও ধরলা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। এর সঙ্গে বুধবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভারি বৃষ্টিতে কিছু পরিবার গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নৌকা বা ভেলা ছাড়া চরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ধেয়ে আসছে পানির ¯্রােত। চারদিকে অথৈ পানির কারণে গবাদি পশুপাখি নিয়ে অনেকটা বিপদে পড়েছেন চরাঞ্চলের খামারি ও চাষিরা। উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট এ বন্যায় জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী; কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা; সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, কুলাঘাট ও মোগলহাট ইউনিয়নের তিস্তা ও ধরলার নদীর চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এসব ইউনিয়নের প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদিকে তিস্তায় পানিপ্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের তালেব মোড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁধটি রক্ষায় রাতভর স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে নিরন্তর চেষ্টা চালাছেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মসিউর রহমান মামুন। এ ছাড়া জেলার তিস্তার তীরবর্তী বেশ কিছু বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট, হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গোবর্দ্ধন চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাজি শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানিতে ডুবে গেছে শ্রেণিকক্ষ। তাই তিন দিন ধরে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে না। পরিবেশ বিঘœ ঘটায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে। আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা চরাঞ্চলের পাসাইটারী গ্রামের মানিক মিয়া, আজিজুল ইসলাম ও আমিনুর রহমান বলেন, তিন-চার দিন ধরে বন্যার পানিতে বন্দি থাকলেও সরকারি-বেসরকারিভাবে কোনো ত্রাণ তাঁরা পাননি। এ ছাড়া পানিবন্দি খেটে খাওয়া মানুষগুলো শিশুখাদ্য ও নিরাপদ পানির সমস্যায় পড়েছে। হাতীবান্ধা উপজেলার চর সিন্দুর্না গ্রামের আলতাব উদ্দিন ও আবু তালেব বলেন, দুদিন ধরে পানিবন্দি থাকার পর বুধবার মধ্যরাতে হঠাৎ তিস্তার পানি বাড়তে থাকে। টানা তিন দিন পানিবন্দি রয়েছেন তাঁরা। তাঁরাও কোনো প্রকার সহায়তা পাননি বলেও অভিযোগ করেন। সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে এ ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ত্রাণের জন্য পানিবন্দিদের তালিকা পাঠানো হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলী হায়দার বলেন, জেলা ত্রাণ তহবিলে এক হাজার ৯৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ১৫০ টন জিআর চাল ও আড়াই লাখ টাকা মজুদ রয়েছে। উপজেলা থেকে তালিকা পেলে বরাদ্দ দেওয়া হবে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যারেজ রক্ষার্থে সব জলকপাট খুলে দিয়ে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
বাড়ছে যমুনার পানি, বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির কারণে সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে ভাঙন। প্রতিদিনই যমুনা নদীতে পানি বেড়ে যাচ্ছে। এতে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে ভাঙনের তীব্রতা। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে এলাকার ফসলি জমি, ঘরবাড়ি ও গাছপালা। যমুনা নদীতে অবৈধ আর অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের কারণে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ১৫ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দু-একদিনের মধ্যে যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। বাঐখোলা বাঁধসহ বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপথ। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে নদীপাড়ের আট গ্রামের মানুষের। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড দাবি করছে, ভাঙন রোধে বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু করা হয়েছে। যমুনা নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙনের কবলে পড়েছে কাজীপুর উপজেলার বাহুকা, সিংড়াবাড়ি, বাঐখোলা ও পাটগ্রাম এলাকা। প্রতিদিন ভাঙনের কবলে পড়ে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বাঐখোলা বাঁধসহ এসব এলাকার জনপথ। যমুনা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভাঙন অব্যাহত থাকায় হুমকির মধ্যে রয়েছে গান্দাইল, রতনকান্দি ও শুভগাছা ইউনিয়নের বাহুকা, বাঐখোলা, পূর্ব খুশকিয়া, পাটাগ্রাম, কুড়ালিয়া, সিংড়াবাড়ি, চিলগাছাসহ নদীতীরবর্তী আট গ্রামের হাজার হাজার মানুষ। অব্যাহত ভাঙনে এসব এলাকার ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, গাছপালা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাঐখোলা বাঁধের অর্ধকিলোমিটারসহ অর্ধশত ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করছেন নদীপাড়ের মানুষ। এদিকে এনায়েতপুর, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলায়ও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যমুনা নদীর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নদ-নদীগুলোতেও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকার বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক বলেন, গত কয়েকদিনে বাঐখোলা বাঁধের প্রায় অর্ধকিলোমিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমরা বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবগত করেছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ভাঙনকবলিত ওমর আলী নামে আরেকজন বলেন, গত কয়েক দিনে বাঐখোলা, শুভগাছা গুচ্ছগ্রাম, পাটগ্রাম, পূর্ব খুকশিয়া গ্রামে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। এরইমধ্যে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি জমি ও বেশ কিছু বৈদ্যুতিক খুঁটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসেন জানান, ভারতের আসামে প্রবল বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা নদীর উজানে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে দু-একদিনের মধ্যে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। বাঐখোলা বাঁধ রক্ষায় বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। দুই কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এরইমধ্যে কাজের ওয়ার্কঅর্ডার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি কমলে কাজ শুরু হবে। আগামি বছরগুলোতে আর ভাঙন থাকবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন ভাঙনের কারণ হতে পারে। ৮০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার নদীপথ আছে। তার মধ্যে দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা ৩৫ কিলোমিটার নদীভাঙন রোধ করে ফেলেছি। এ মুহূর্তে আমাদের দুটি প্রকল্প চলমান আছে। এ ছাড়া কাজীপুরের বাঐখোলা, খুদবান্দি এবং এনায়েতপুরের ব্রক্ষনগাতী, হাটপাচিল এলাকায় ভাঙন রয়েছে। এখানে ভাঙন রোধে প্রকল্প তৈরি করে ঢাকায় পাঠিয়েছি। এগুলো অনুমোদন হলে কাজ শুরু হবে।
তিন শতাধিক গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি : ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দা উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যার কবলে তিন উপজেলার তিন শতাধিক গ্রামে ৫০ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দেড় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকছে। বিভিন্ন গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে থাকায় উপজেলা ও জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। গত সোমবার থেকে টানা চার দিনের মাঝারি ও ভারি বৃষ্টিপাতে জেলার প্রধান নদী কংস, সোমেশ্বরী, ধনু ও উব্দাখালীতে পানি বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। বন্যায় সীমান্ত উপজেলা কলমাকান্দার আটটি ইউনিয়ন বড়খাপন, রংছাতি, লেঙ্গুরা, খারনৈ, নাজিরপুর, পোগলা, কৈলাটি ও কলমাকান্দা সদরসহ দুর্গাপুরের গাওকান্দিয়া, কুল্লাগড়া, বাকলজোড়া, কাকৈরগড়া ও বিরিশিরির আংশিক এলাকা এবং বারহাট্টার রায়পুর ও বাউসী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তিন উপজেলায় ৫০ হাজারের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। স্কুল, মাদ্রাসায় পানি ঢুকছে। কলমাকান্দার পাঁচগাও, লেঙ্গুরা, বড়খাপন, চারালকোনাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ বাজার পানির নিচে রয়েছে। এ ছাড়া বড়খাপন, চাঁনপুর, ধীতপুর, পাঁচকাঠা, পালপাড়া, কলেজ রোডসহ বেশ কয়েকটি গ্রামীণ পাকা সড়ক পানির নিচে থাকায় মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। শতাধিক পুকুর ও মৎস্য খামারে পানি ঢুকে পড়ায় মাছ ভেসে গেছে। গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গাপুরে বিরিশিরি ও কাকৈরগড়া ইউনিয়নের ১৯৬টি পরিবার ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কের ইন্দ্রপুর এলাকায় সেতু ও সড়ক ঝুঁকিতে রয়েছে। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম জানান, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আপাতত ২০ টন জিআর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুই উপজেলায় ৬০০ প্যাকেট শুকনা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির জন্য বলা হয়েছে।
চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের শঙ্কা : মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ অব্যহত থাকতে পারে। ঢাকার আগারগাঁওয়ের আবহাওয়া কার্যালয়ের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দছ বলেন, অতি ভারি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। আগামি তিন দিনে বৃষ্টিপাত হ্রাস পেতে পারে বলে আবহাওয়া কার্যালয় জানিয়েছে। এদিকে কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। এর মধ্যে লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, পটিয়া, চন্দনাইশ ও বোয়ালখালী উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। বানভাসি মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক। এসব উপজেলার সবকটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রাবাহিত হচ্ছে। সাতকানিয়ার বাজালিয়া মীরেরপাড়া এলাকায় শঙ্খ নদের বাঁধ ভেঙে তীব্র ¯্রােতে পানি ঢুকে পড়ছে। দ্রুত অবনতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির। জানা গেছে, লোহাগাড়া উপজেলায় টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়কের অবস্থা করুণ হয়ে পড়েছে। বড়হাতিয়া, আমিরাবাদ, সুখছড়ি, কলাউজান, পুটিবিলা, আধুনগরসহ উপজেলার বহু গ্রামের সড়ক পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আধুনগরে ডলু নদীর ভাঙনে খালপাড়ে বহু কাঁচা বসতঘরে পানি ঢুকেছে। পটিয়া উপজেলার কেলিশহর, হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা, ভাটিখাইন, ছনহরা, ধলঘাট, হাবিলাসদ্বীপ, জিরি, কুসুমপুরা, আশিয়া, কোলাগাঁও ছাড়াও পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে উপজেলার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে পৌর সদরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডে কোমরপানি জমে থাকায় মানুষকে পানির মধ্য দিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। আনোয়ারার বরুমচড়া, বারখাইন, হাইলধর, বৈরাগ, চাতরী ও পরৈকোড়া ইউনিয়নের ওষখাইন, কৈখাইন, শিলালিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রায়পুর ও জুঁইদ-ী ইউনিয়নসহ উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানির অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ভারি বৃষ্টিপাতে দুই উপকূলীয় ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বোয়ালখালীতে পাহাড়ি চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাহাড় থেকে শাকসবজি, লেবু ও পেয়ারা পানির ¯্রােতে ভা-ালজুরি খাল দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে অনেক চারাগাছও। খালের পাশে থাকা একাধিক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। ভা-ালজুরি পাড়ের বাসিন্দা তোয়াব আলী জানান, টানা বৃষ্টিতে তাঁদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি। পাহাড়ি ঢলে কয়েকটি ঘর একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। তা ছাড়া পাহাড়ের পাদদেশে গুচ্ছগ্রাম, আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীদের নিরাপদে থাকতে নির্দেশ দিয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার কাজ চলছে। তাঁদের সহযোগিতা করা হবে। বাঁশখালীতে টানা বৃষ্টিতে উপকূলীয় এলাকা সরল, গ-ামারা, চনুয়া, পুইছড়ি, চাম্বল, কাথারিয়া, বাহারছড়া, পুকুরিয়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষ ভয়াবহ বন্যার আতঙ্কে রয়েছে। এরইমধ্যে তলিয়ে গেছে নদীপাড়ের গ্রামসহ রাস্তাঘাট। স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট পানি বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে বিভিন্ন ফসলি জমি। চন্দনাইশের দোহাজারী পৌরসভার উল্লাপাড়া, সরকারপাড়া, চাগাচর, জামিজুরী, ঈদপুকুরিয়া, খানবাড়ি, দিয়াকুল, রায়জোয়ারা, কিল্লাপাড়া, পূর্ব দোহাজারী, লোকমানপাড়া, চাগাচর নতুনপাড়া এলাকার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোবারক হোসেন বলেন, শুধু সাতকানিয়ায় ৫০ হাজার পরিবারের অন্তত দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্তত পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামে বিপর্যস্ত আমদানি-রফতানি : টানা বর্ষণ, জলজট ও চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের জন্য যানজটে অবরুদ্ধ সড়কের কারণে সংকটে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। বৃষ্টির কারণে ও সাগর উত্তাল থাকায় গত ছয়দিন ধরে বন্দরের বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কার্যত বন্ধ আছে।
বন্দরে প্রবেশ করা ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান-লরি যানজটের কারণে স্বাভাবিকভাবে বেরুতে পারছে না, প্রবেশেও ব্যাঘাত ঘটছে। এর ফলে বন্দরের ইয়ার্ড থেকে পণ্য খালাসে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কনটেইনার জটের পাশাপাশি জেটিতে জাহাজ জটও তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বন্দরকেন্দ্রিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এ অচলাবস্থার কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমদানি-রফতানিকারকেরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে বলে মত দিয়েছেন তারা।
তবে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃষ্টির কারণে বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাস বন্ধের চেয়েও মারাত্মক সংকটে ফেলেছে বন্দরের আশপাশের সড়কে ভয়াবহ যানজট। এই যানজটে একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
গত ৪ জুলাই থেকে চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে ৭ জুলাই রাত থেকে সেই বৃষ্টিপাত অঝোর বর্ষণে রূপ নেয়। দুইদিন টানা বর্ষণের পর থেমে থেমে বর্ষণ এখনো অব্যাহত আছে। নগরীর পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৮ জুলাই ২৫৯ মিলিমিটার, ৯ জুলাই ৬৭ মিলিমিটার, ১০ জুলাই ১৪৬ মিলিমিটার এবং বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) ৯৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে গত ৭ জুলাই থেকে বড় জাহাজের পণ্য খালাস বন্ধ আছে। ১৯০ মিটারের বেশি লম্বা জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। লাইটারেজ জাহাজ পাঠিয়ে পণ্য খালাস করে কর্ণফুলী নদীর ঘাটে অথবা নৌপথে দেশের বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে সেই পণ্য খালাস করা হয়।
লাইটারেজ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের কর্মকর্তারা জানান, বন্দরের বহির্নোঙ্গরে গত পাঁচদিনে কাজ হয়েছে মাত্র ২৫টি জাহাজে। স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন বহির্নোঙ্গরে ৪৫ থেকে ৫০টি জাহাজ থেকে একযোগে পণ্য খালাস চলে। এই অবস্থায় বন্দরে ৭৯টি বড় জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বসে আছে। বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) সকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমলে ২৬টি জাহাজ থেকে খালাস শুরু হয়। কিন্তু বেলা গড়াতেই আবারও বৃষ্টি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় খালাস।
বহির্নোঙ্গরে ৭ জুলাই জাহাজ ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ৫টিতে। ৮ জুলাই ছিল ৬৮টি, কাজ হয়েছে ২টিতে। ৯ জুলাই ছিল ৭৪টি, কাজ হয়েছে ৭টিতে। ১০ জুলাই ছিল ৭৫টি, কাজ হয়েছে ১২টিতে।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের সদস্য (অপারেশন) জাহাঙ্গীর আলম দোভাষ বলেন, ‘লাইটারেজ জাহাজ তো যেতেই পারছে না। গেলেও হ্যাজ খুলতে না পারায় খালাস তো হবে না। শুধু লোহার পাত ছাড়া আর কিছু খালাসের সুযোগ নেই। খালাস হলেও ঘাটে এসে সেগুলো নামানো যাচ্ছে না। আমরা বড় ধরনের ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমাদের প্রায় ৪০০ জাহাজ গত ছয়দিন ধরে অলস বসে আছে।
বহির্নোঙ্গরের মতো একই ধরনের জট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বন্দরের অভ্যন্তরেও। বন্দরকে ঘিরে সড়কে ভয়াবহ যানজটই এই সংকট তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।
নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ জুলাই সকাল থেকে চট্টগ্রাম নগরী থেকে দু’টি সড়ক ধরে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার দু’টি সড়কে কার্যত অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে একটি সিমেন্ট ক্রসিং থেকে রুবি সিমেন্টের দিকে, আরেকটি কাটগড়-পতেঙ্গা হয়ে বিমানবন্দর। রুবি সিমেন্টের সামনের সড়কে পানি জমে থাকায় স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। কাটগড় সড়কটিতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে। সড়কের এক-তৃতীয়াংশ দখলে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স গ্রুপ। প্রায় ৮ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। সেসব গর্তের ওপর পানি জমে আছে। সেই সড়ক দিয়েও ছোট যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ আছে। বড় বড় গাড়িগুলোও স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।
টানা বৃষ্টির কারণে সেই সড়কগুলোর পানি অপসারণ ও সংস্কার করে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার কোনো উদ্যোগও নিতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে গত পাঁচদিন ধরে ভয়াবহ যানজট তৈরি হয়েছে আশপাশের সড়কগুলোতে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে যানবাহন প্রবেশের ফটকও যানজটে প্রায় অবরুদ্ধ। গত পাঁচদিন ধরে বিমানবন্দর সড়কের এই যানজট কাস্টমস মোড়, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, টাইগারপাস পেরিয়ে ওয়াসা-জিইসি মোড় পর্যন্ত পৌঁছেছে।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) তারেক আহম্মদ বলেন, ‘গাড়ি যদি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারত, তাহলে যানজট থাকত না। কিন্তু ভাঙাচোরা সড়কে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। যানজটে মানুষের দুর্ভোগ হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সুফিউর রহমান টিপু বলেন, আমার তিনটি গাড়ি বন্দরে ঢোকার কথা ছিল বুধবার সকাল ৮টায়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইটেম নিয়ে রাত ৯টায় ঢাকার মিরপুরে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। আমার গাড়ি তিনটি বন্দরের এনসিটিতে ঢুকতে পেরেছে বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় খবর নিয়েছি, তখনও গাড়িগুলো বের হতে পারেনি।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, বন্দরে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ থেকে যে কনটেইনার দুইদিনে নামানো সম্ভব সেগুলো দ্বিগুণ সময় লাগছে। ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ সেখানে অনেক গাড়ি। যানজটের কারণে সেগুলো বের হতে পারছে না। এতে কনটেইনার জট তৈরি হচ্ছে। আবার অফডক থেকে রফতানি কনটেইনারগুলোও যানজটের কারণে বন্দরে ঠিকভাবে আসতে পারছে না। এতে কনটেইনার ফেলেই জাহাজকে চলে যেতে হচ্ছে। আমরা দুইদিক থেকেই সমস্যায় পড়েছি। একদিকে জাহাজের ওয়েটিং টাইম ও চার্জ বাড়ছে। আবার কনটেইনার লোড করতে না পেরে জাহাজ চলে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দরে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাহাজ অবস্থান করছে ৯৭টি। বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে কনটেইনার আছে ৪৪ হাজার ৪৪৭টি। বন্দরের ইয়ার্ডে ৪৯ হাজার ১৮ কনটেইনার রাখার ধারণক্ষমতা আছে। সে হিসেবে- জটের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ পার্সোনাল অফিসার মো.নাসির উদ্দিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। দিনে প্রায় ৫ হাজার ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান বন্দরে ঢোকে আর বের হয়। কিন্তু চলমান সংকটের কারণে সেটা অনেক কমে গেছে। পণ্য খালাস স্বাভাবিক না থাকলে বন্দরে তো প্রভাব পড়বেই।’