বেলাল হোসেন চৌধুরী : লেখাটা মূলত আব্বার সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণের সংক্ষিপ্তসার। নব্বুইয়ের বার্ধক্যে তৃতীয় প্রজন্মের জন্য গল্পচ্ছলে বলে যান। সব তাঁর মনে নেই। তেজস্বিতা ও গর্বের অতীতচারিতায় উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধে আব্বার নানানাত্রিক ভুমিকা ও জীবনবাজির বহু স্মৃতিময় গল্প। আজ ১৫ আগস্ট শোকদিবসে আব্বার নামান্ধ-আদর্শ বঙ্গবন্ধুর কিছু স্মৃতি তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আরেক সময়ে প্রসঙ্গক্রমে নিয়ে আসবো। জেলগেট, রাজনৈতিক সভা ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনু অফিসে আব্বার সাক্ষাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা:
১৯৫৮ সালে আব্বা তাঁকে প্রথম দেখেন। এরপর একশো’রও বেশী দিন সামনে গেছেন। কখনো শ্লোগান নিয়ে, কখনো সালাম দিয়ে। প্রতিবার নেতার মুক্তির সময় রুদ্ধশ্বাস জেল গেটে ছুটে গেছেন। তরুণ বয়সে নেতার সংক্রমিত আকর্ষণ আজ বার্ধক্যেও তেজে মেজাজে দৃশ্যমান।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণে আব্বা আনমনা হয়ে যান। অনুভুতির সাথে, শব্দে, চোখে, ভাবে ও শরীরের ভাষায় বদলে যান।
▪️প্রথম সাক্ষাত
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখা প্রসঙ্গে বলেন, পল্টন পানির ট্যাংকের কাছে মোল্লার বাড়ি তিনি ভাড়া থাকতেন। রাস্তার উল্টো দিকে অডিট অফিসের পুকুর। নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতরে পরিচ্ছন্ন পানি। তখনো ওয়াসার পানির ব্যবস্থা হয়নি। আব্বা অডিটের পুকুরে নিয়মিত গোসল করতেন। বঙ্গবন্ধু অডিট অফিসের উল্টোদিকে সেগুন বাগিচায় বাসা নিয়ে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। অডিটের পুকুরটি তাঁর বাসা সংলগ্ন ছিল। তিনি একই সময়ে সকাল সাড়ে সাতটায় অডিট বিভাগের সেই পুকুরে গোসল করতেন। প্রায় এক বছরের বেশী সময় অফিস খোলার দিনে ঠিক একই সময়ে পুকুরঘাটে আব্বার সাথে দেখা হতো। আব্বা প্রায়শই এ মহান নেতার শৃংখলা ও সময়ানুবর্তিতার উদাহরণ দেন। আব্বার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি স্মৃতি:
▪️ভেতরে আয়, নাস্তা কর্….. বঙ্গবন্ধু বিলাতের সুগন্ধি সাবান ব্যবহার করতেন। একদিন আব্বা গোসল শেষে বঙ্গবন্ধুর ‘সাবান কেইস’ ঘাটে পেয়ে তাঁর বাসায় ছুটে যান। বেলকনি থেকে সাবান হাতে আব্বাকে একজন কিশোরী দেখতে পান (তাঁর ধারণা, সম্ভবত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বঙ্গবন্ধুকে ডেকে আনেন। সাবান কেস হাতে নিয়ে তিনি আব্বাকে বললেন ‘খুব ভালো করেছিস, আগে কয়েকটা হারাইছে। ভেতরে আয়, নাস্তা কর!’ বঙ্গবন্ধুর আদরের ‘তুই’ ডাক আব্বার সুখময় স্মৃতি! দ্রুত অফিসে যাবার জন্য আব্বা চলে আসেন। পরে দেখা হলে আব্বার খোঁজখবর নিতেন। এর কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুকে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান গ্রেফতার করে। প্রতিদিন সকালে পুকুর ঘাটে গেলেই বঙ্গবন্ধুকে মনে করে মন খারাপ করতেন।
▪️লিডার, আমি পোস্টম্যান না… ১৯৬৪ সালের কথা। বঙ্গবন্ধু ইতোমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে বড় নেতা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর নামে সারাদেশ থেকে আট আনা করে মানি অর্ডার আসতো। এভাবে আঠারোশো টাকা জমে যায়। পোস্টম্যান দিনে পাঁচশ টাকার বেশী ডেলিভারি দিতে পারতেন না। জিপিও’র পোস্টমাস্টার জানতেন বঙ্গবন্ধু আব্বাকে চেনেন। তিনি আব্বাকে ডেকে পাঠান। অতিরিক্ত টাকা ও গুরুত্বের কথা বলে ওই টাকা হাতে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেন। নিজের কাজ নয়, তবু আব্বা দায়িত্ব নেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার সুযোগও ছিল। জিপিও’র কাছেই জিন্নাহ অ্যাভেন্যু (বর্তমান বঙ্গবন্ধু অ্যাভেন্যু)। অফিসে গেলে বঙ্গবন্ধু আব্বাকে দেখে বলেন
“কিরে তুই? কি কাজে এসেছিস”
“মানি অর্ডার দিতে এসেছি”
“তুই না সদরঘাটে ছিলি?”
“জ্বী! এখন জিপিওতে! অফিস থেকে দায়িত্ব দিয়েছে”
“বস! তাড়া আছে?”
“জ্বী না!”
মানি অর্ডারের প্রাপ্তিস্বীকারে স্বাক্ষর করার ফাঁকে নানান খোঁজখবর নেন। টাকা বুঝে নিলেন।
“ধর, এটা রাখ্” ২০টাকা আব্বাকে বখশিশ দিলেন।
“আমি পোস্টম্যান না, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি”
বঙ্গবন্ধু একটু থেমে বললেন,
“সময় পাইলে আসবি, কাছেইতো থাকিস”
সেদিন প্রায় চল্লিশ মিনিট তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্য কাটান।
▪️শুনলেই রক্ত টগবগ করে….. ৭মার্চ ভাষণের স্মৃতিচারণে এখনো আব্বার স্পন্দন দেখি। দু’চোখে অন্য ভাষা, অন্য কিছু। সেদিন তিনি তৈরি হয়ে কয়েক ঘন্টা আগেই চলে যান। শীষ্যদের পেছনে বসার ব্যবস্থা করেন। নিজে সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা মঞ্চের কাছে চলে যান। খুব কাছ থেকে বক্তৃতা শোনেন। ছাত্রনেতাদের কল্যাণে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা বলে বাঁশের ঘেরার ভেতরে বসার সুযোগ পান। বলেন, “তোমরা রেকর্ডিং শুনে শিহরিত হও, স্বাধীনতা পিয়াসুদের সেদিনের সরাসরি শোনার অনুভুতি বোঝানো কঠিন, দূরে ভাষণের শব্দ কানে এলে আমার এখনো অস্থির লাগে!”
▪️ওরা কই যাবে বঙ্গবন্ধু……! ১৯৭৩এ ডাকবিভাগের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর দাবীতে টানা ২২দিন ধর্মঘটে দেশে ডাকসেবার বেহাল অবস্থা। ১৯তম দিনে সিনিয়ররা পরিকল্পনা করে হঠাৎ আব্বাকে না জানিয়ে কর্মচারী সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক বানানো হয়। সচিবালয়, টিএন্ডটি, ডাক, পুলিশ, আর্মি, আনসারসহ সরকারের সব বিভাগের লোক দিয়ে জরুরী সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হয়। জাতির জনক তখন দেশ পুনর্গঠন নিয়ে ব্যস্ত। এসব বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার মতো সময় ছিল না। তিনি খুব বিরক্ত ছিলেন। ধর্মঘটকারীদের চাকরিচ্যুত করে নতুন নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। ধর্মঘটীরা ভয় পেয়ে যায়। যেকোন মূল্যে এটা ঠেকাতে হবে। তৎকালীন ডিজি, ডাক বিভাগের প্রভাবে ও নেতাদের সমন্বিত সিদ্ধান্তে আব্বাকে ৩২নম্বরে পাঠানো হয়। এ সময় আর কেউ বঙ্গবন্ধুর সামনে পড়তে রাজি হচ্ছিল না। চাকরিচ্যুতির সামারি ইতোমধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর স্বাক্ষর হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায়। আব্বাকে একা ঢুকতে দেয়া হলো। বঙ্গবন্ধু আব্বার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘তুই কি জন্য এসেছিস?
‘জ্বী, আমি পোস্ট অফিস থেকে এসেছি’
‘তুই ওদের(ধর্মঘটীদের) পক্ষে এসেছিস?
‘বাঙ্গালীর শেষ ভরসা আপনি’ ভয়ে ভয়ে বললেন
‘তুই ওদের নেতা নাকি?’
‘আমাকে না জানিয়ে তিনদিন আগে ওরা আহবায়ক করেছে’
বঙ্গবন্ধু খুব রেগে গেলেন। বললেন,
‘তুই আমাকে ভালো করে জানিস, তুই কিভাবে এটা করলি? এটা আন্দোলন করার সময়? আগে তোকে সাফাই করব! পরে সবগুলারে বাড়ি পাঠাব’
‘ওরা অপরাধ করেছে বঙ্গবন্ধু। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
‘ওদের ক্ষমা পাবার অধিকার নেই, অত করে বললাম কেউ শুনল না।’
‘আপনি যা বলবেন, তা-ই হবে! দেশ স্বাধীন আপনি সবার জন্য করেছেন। অপরাধী ষোল হাজার কর্মচারীর পরিবারের এক লাখ মানুষ কোথায় যাবে! শেষ পর্যন্ত আপনাকেই দেখতে হবে।’
আব্বার দিকে ঘুরে তাকালেন! পরক্ষণে সোফায় বসলেন। আব্বাকে ইশারা দিয়ে বসতে বললেন। সেদিন মহান হৃদয়ের মানুষটির আরেকটি মহানুভবতা দেখলেন। একটু পর যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে লাল ফোনে বললেন, ‘পোস্টঅফিসের ফাইলটা রেখে দাও। আমি বললে পাঠিও’। বেঁচে গেল ষোল হাজার কর্মচারী ও তাদের পরিবার। আব্বাকে দেখিয়ে উপস্থিত ক্যাপ্টেন জামিলকে বললেন, নিরাপত্তার ব্যাপার আছে, ওকে গাড়ি দিয়ে জিপিওতে নামিয়ে দাও। অশ্রুসজল চোখে বলেন, দেশের ব্যস্ত প্রধানমন্ত্রী ষোল হাজার কর্মচারীকে কেবল ক্ষমাই করেননি, নগণ্য একজন সরকারী কর্মচারীর নিরাপত্তাও লক্ষ্য রেখেছেন।
তারুণ্যে নেতৃত্ব-মুগ্ধতার স্পন্দন আব্বার অস্থিমজ্জায় সংক্রমিত! মহতের মহতি নেতৃত্ব, সাহসে তিনি উদ্বুদ্ধ, আপ্লুত! ১৯৬৪ সালে শুরু। এক সম্মেলনে তৎকালীন ডাক-কর্মচারীদের প্রতাপশালী বিহারী নেতা গোলাম হাসনাইনের উদ্দেশ্যে এক তরুণ বলেছিলেন, “সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য বাঙ্গালী। সভার নোটিশ মিনিটস বাংলায় হবে!” এর কিছুদিন পর গোলাম হাসনাইন করাচি পালিয়ে যায়। ঢাকা জেলার নেতৃত্বে এরপরই গোলাম হাসনাইনের স্থলাভিষিক্ত হন মনসুর আহমদ চৌধুরী, আমার বাবা।
বত্রিশ বছর ডাক কর্মচারী ইউনিয়নে অবিকল্প নেতৃত্ব দেন। যেখানে নিরপেক্ষতা, ত্যাগ ও কর্মচারী কল্যাণই ছিল মুখ্য। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি বেয়াল্লিশ হাজার কর্মচারীর কেন্দ্রীয় মহাসচিব। অবসরের পরেও ডাকবিভাগে তাঁর অপরিহার্যতা শেষ হয়নি। অবসরের চার বছর পরও ২০০১ সাল পর্যন্ত আব্বাকে কেন্দ্রীয় সভাপতি পদে থাকতে হয়।
নেতৃত্বে এ দীর্ঘ সাফল্য সহজাত নয়। বঙ্গবন্ধুর সংক্রমিত স্পন্দনময় নেতৃত্বে আব্বা ছিলেন মোহগ্রস্ত। তিনি গর্বিত বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য, আদর্শ ও অনুপ্রেরণায়। যে মহান নেতার জীবনের পঞ্চান্ন বছরের পঁয়ত্রিশ বছরই কেটেছে জেল, জুলুম, নির্যাতনে। এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, মানুষের ভালোবাসার নেশায়। যিনি কেবল স্বাধীন দেশ নয়, বিশ্বময় সৃষ্টি করলেন, ত্যাগের মহান মহীমায় ‘নন্দিত নেতৃত্ব’র নতুন ধারণা।
বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাঙ্গালী জাতির নেতৃত্ব-গর্বের উত্তরাধিকারে আমি, আমরাও ! লক্ষ তরুণ, যুবা, প্রৌড়, আমার আব্বার মতো নব্বুই বয়সী বৃদ্ধও। তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের রোলমডেল বাংলাদেশ। আলো ছড়াচ্ছে বাঙ্গালী, বাংলাদেশ।
মুগ্ধতায় আমার আমাদের পিতা থেকে পুত্র থেকে প্রপৌত্র….প্রজন্মান্তরে, পরম্পরায়…..যাঁর ঋণ কখনো শোধিবার নয়।
ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম যথার্থই বলেছিলেন, “ঐশ্বরিক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। নিজেই সে আগুনে ডানা যুক্ত করতে পেরেছিলেন”। বিশ্বব্যাপী অজস্র রাজনীতিবীদ, মিডিয়া তাঁর গুনমুগ্ধ!