মোহাম্মদ সেলিম রেজা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। দিনটি ছিল শনিবার। ওইদিন ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর সিলেটে বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে এক ছাত্রের উপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী শক্তি বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী এ সমাবেশে জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা চালায়। পুরো আওয়ামী পরিবারের উপর চালানো নারকীয় এই গ্রেনেড হামলা থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহত হয়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী প্রাণ হারান। আহত হন সাংবাদিকসহ প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে কয়েক’শ নেতা-কর্মী আহত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
আমি তখন বেসরকারি টেলিভিশন ‘চ্যানেল আই’তে সম্প্রচারিত তথ্য-প্রতিবেদনধর্মী অনুষ্ঠান ‘সময়ের কথা’র প্রযোজনা করতাম। সেদিন ‘লঞ্চডুবি-কারণ ও প্রতিকার’ পর্বের শুটিং ছিল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। হঠাৎ একজন প্রতিবেদক মুঠোফোনে জানালেন- বঙ্গবন্ধু এ্যভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে একাধিক বোমা হামলা হচ্ছে। অনেক মানুষ আহত-নিহত হয়েছেন।
সংবাদ পেয়ে আমি দ্রুত রমনা ভবনের সামনে এসে ঘটনাস্থলের ভিডিওচিত্র করার জন্য ক্যামেরাম্যানকে বললাম। দেখলাম, কিছুক্ষণ আগে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার টর্নেডো বয়ে গেছে এখানে। ভয়ঙ্কর গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন শত শত মানুষের আহাজারিতে ভারি বাতাস। আকস্মিক মৃত্যু আর রক্ত¯্রােতে শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের হাত-পাসহ মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। কারও হাত নেই, কারও পা উড়ে গেছে। আহতদের বাঁচার সে কী তীব্র আকুতি! রক্তে ভিজে লাল হয়েছে পিচঢালা কালো রাজপথ। বিকট শব্দে আশপাশের ভবনের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চৌচির। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
অশুভ শক্তির বিভীষিকাময় ওই গ্রেনেড হামলার আগমুহূর্তে ট্রাকের ওপর বানানো মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। খোলা ট্রাকমঞ্চ থেকে নেমে এসে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতির সময় বিকট শব্দে একের পর এক বিস্ফোরিত হয় ১৩টি তাজা গ্রেনেড। আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেটপ্রুফ গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটে আসে ১২টি গুলি। বুলেটের আঘাতে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ প্রাণ হারান। মঞ্চ ঘিরে নেতৃবৃন্দের মানববর্মের কারণে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
আহতদের দেখার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণ পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে দেখলাম এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। অমানবিক ও বর্বর হামলা কতটা মর্মান্তিক এবং পৈশাচিক ছিল তা লিখে বোঝানো দুরূহ ব্যাপার। শুধু এ হাসপাতালেই প্রায় ১৫০ জন আহত নেতা-কর্মী চিকিৎসার জন্য আসেন।
অবস্থা দেখে মনে পড়লো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা-জাপানের যুদ্ধের উপর নির্মিত ‘পার্ল হারবার’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের কথা। গ্রেনেড হামলায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউর পরিস্থিতি অনেকটা সেরকমই ছিল। ছবিতে একটি দৃশ্য যেমন দেখেছিলামÑএকটি রোগীবিহীন হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের অলস সময় কাটানোর পরবর্তী মুহূর্তেই হঠাৎ করে কিভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের ক্ষত-বিক্ষত আহত-নিহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ধকল পোহাতে হয়েছিল। তার চেয়েও মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক দৃশ্য ছিল এটি। হাসপাতালে গ্রেনেড হামলায় আহত ও নিহতদের একের পর এক আনা হচ্ছে। কেউবা চিকিৎসার পাশাপাশি মৃত্যুবরণ করছে। কেউবা রক্তের জন্য হাহাকার করছে। কারো শরীর পোড়া, কেউবা স্পিøন্টারের আঘাতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন এবড়ো-থেবড়ো। কাকে রেখে কাকে আগে চিকিৎসা দেবেন এ নিয়ে দিশেহারা নার্স-চিকিৎসকরা ছুটোছুটি করছেন। হাসপাতালের বিভিন্ন ফ্লোরের মেঝেতে গুরুতর আহতদের পাাশে পড়ে আছে নিহতরা। স্বজনহারাদের বুক ফাটা আহাজারি শোনার কেউ নেই। রোগীর ভিড়ের কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩২নং ওয়ার্ডের দরোজা বন্ধ করে দেয়া হলো। কারণ সেখানে তিল পরিমাণ রোগী রাখার ঠাঁই ছিল না। মেঝেতে শুধু রক্ত আর রক্ত। এক সময় ওয়ার্ডের দরোজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হলো। আমি ওয়ার্ডের জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে ক্যামেরাম্যানকে ভেতরের দৃশ্য ধারণ করতে বললাম। দেখলাম কয়েকজন নার্স মুমূর্ষুদের বাঁচাতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে হঠাৎ করেই হাসপাতালে তীব্র ডাক্তার সংকট দেখা দেয়। পাশাপাশি বাড়তে থাকে আহতদের মাঝ থেকে মৃতের সংখ্যা। প্রায় এক ঘণ্টা পরে আওয়ামী মহিলা লীগ নেত্রী আইভী রহমানকে কোলে করে উঠিয়ে আনা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন তাঁর কোন সাড়া-শব্দ নেই। দু’পা গ্রেনেডের স্পিøন্টারের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তিনি যেন নির্বাক তাকিয়ে আছেন। কর্মীরা তাঁকে কোলে করে অপারেশনের জন্য হাসপাতালের ৩২নং ওয়ার্ডের পাশে নিয়ে আসেন। সেখানে প্রস্তুতিও চলছিল অপারেশনের। এরই মধ্যে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে দ্রুত তাঁকে সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কয়েকদিন তাঁর শারীকির অবস্থার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২৪ আগস্ট মধ্যরাতে জানা গেল, তিনি সবার মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন।
একজন কলম সৈনিক অর্থাৎ সাংবাদিক হিসেবে সেদিন থেকে এ নির্মম ঘটনার উপর প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুভব করে ২০১৩ সালে ‘২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি রক্তাক্ত’ গ্রন্থ প্রকাশ করি। কিন্তু আহত-নিহত পরিবারের সদস্যদের খুঁজে নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া ছিল একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ।
নির্মম ও বর্বর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে দেশসহ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘসহ বিশ্বব্যাপী ধিক্কার ও নিন্দার ঝড় ওঠে।
কী এক অজানা কারণে আগস্ট মাস এলেই জঙ্গি তৎপরতা বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম ও নারকীয় রাজনৈতিক হত্যাকা-ের দিন। ওইদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকদের হাত থেকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকা নারী, শিশুরাও রেহাই পায়নি।
শোকাবহ আগস্ট মাসেই বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে অসংখ্য বোমা হামলা হয়। উদ্দেশ্য জঙ্গি রাষ্ট্র কায়েম করা। এরই ধারাবাহিকতায় জঙ্গিরা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৪ টি জেলার মধ্যে ৬৩টি জেলার ৩শ’টি স্থানে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। তাদের এ হামলার হাত থেকে মসজিদ-মাদ্রাসাও রেহাই পায়নি। তৎকালীন সময়ে জেএমবি, হুজি, হিজবুত তাহরির, বাংলা ভাই এবং শায়খ আব্দুর রহমানসহ শীর্ষ জঙ্গিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। এসব জঙ্গিরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ঘাতকচক্র ১৯ বার চেষ্টা চালায়।
২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১। আদালতের রায়ে হত্যা মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদ-, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়। আর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ১৯ জনকে ফাঁসি এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্ত ৪৯ আসামির মধ্যে ১৮ জন পলাতক। যার মধ্যে দুজন ফাঁসির ও ১২ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি রয়েছে।
মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। এরপর কারাবন্দি আসামিরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
হত্যা মামলায় ১৩ ভলিউমে মোট ৫৮৫টি পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত, রায়সহ বই সাড়ে দশ হাজার পৃষ্ঠা) জমা। এতে মোট আপিল ২২টি এবং জেল আপিল ১২টি। অপরদিকে বিস্ফোরক মামলায় ১১ ভলিউমে মোট ৪৯৫টি পেপারবুক (দশ হাজার পৃষ্ঠা) জমা। এ মামলায় আপিল ১৭টি ও জেল আপিল ১২টি দায়ের হয়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন হলেও অধিকাংশ হামলা মামলার ঘটনার বিচার এখনো প্রক্রিয়াধীন। স্বজনহারা পরিবার ও ভূক্তভোগীরা আঘাতের ক্ষত বয়ে তাকিয়ে আছেন এ সরকারের আমলেই অপরাধীদের বিচার হবে। স্বদেশ সন্ত্রাসমুক্ত ও কলঙ্কমুক্ত হবে।
লেখক : ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি রক্তাক্ত বাংলাদেশ