অনলাইনেও কোরবানির পশুর হাট জমজমাট

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন বানিজ্য রাজধানী

বিশেষ প্রতিবেদক : বাজারে বাজারে ঘুরে গরুর লাথি-গুঁতা খেয়ে আর গন্ধে নাক চেপে কোরবানি দেওয়ার জন্য পশু কেনার দিন বোধহয় শেষ হতে চলেছে। কেননা, এখন ঘরে বসে অনলাইনে এক ক্লিকেই কেনা সম্ভব গরু বা ছাগল। অনলাইনে যেমন করে শাড়ি, গহনা, পোশাক, জুতো, বাচ্চাদের খেলনা থেকে শুরু করে চাল-ডাল বা নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা হয়, তেমনি এখন কেনা যায় আস্ত গরুও।
বেঙ্গল মিট, দারাজ ডটকম, বিক্রয় ডটকমসহ বড় বড় অনলাইন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও বিভিন্ন পেজ বা গ্রুপ খুলে বিকিকিনি করছে গরু-ছাগল। ক্রেতারাও এই বর্ষায় কাদা-পানি-গোবর এড়িয়ে কোরবানির পশু কেনার জন্য অনলাইন মার্কেটপ্লেসকেই বেছে নিচ্ছেন।
আবার শুধু বেচাবিক্রিই নয়, অনলাইনে চলছে পশু কেনাবেচার মার্কেটিংও। মানে ফেসবুকের হোমপেজ স্ক্রল করার সময় কোনো গরুর বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে ক্রেতা আগ্রহী হয়ে ঘুরে আসছেন সেই পেজ, মনোযোগ দিয়ে গরুর ছবি দেখছেন, অন্য পেজগুলোর গরুর সঙ্গে তুলনাও করতে পারছেন।
যারা এই ধরনের কেনাকাটা সম্পর্কে অবগত নন, তাদের জানিয়ে রাখি— সাধারণত ফেসবুক পেজ বা ওয়েবসাইটে বিক্রি করার জন্য পশুর ছবি আপলোড করা হয়। সেখানে লিখে দেওয়া হয় জীবিত পশুটির ওজন। কোথাও কেজি হিসেবে দাম নির্ধারণ করেন, আবার কোথাও আকার-আকৃতি বা গরুর জাত হিসেবে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো বিক্রেতা ছবির পাশাপাশি গরু-ছাগলের ভিডিও প্রকাশ করেন। ক্রেতা এসব দেখে পছন্দ করে অনলাইনেই অর্ডার দেন। তারপর নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় কোরবানি দেওয়ার জন্য কেনা পশুটি।
এর মধ্যে অনলাইন মার্কেটপ্লেস দারাজ ডটকমে পশু অর্ডার করার সময় শেষ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সায়ন্তনী ত্বিষা  জানান, আগামী ৯ আগস্ট থেকে তারা কোরবানির পশু ডেলিভারি করতে শুরু করবেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের লালন পালন করা গরুই দারাজ ডটকমে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে এগুলোকে বিশেষ কোনো খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হয়েছে— এই ভয় নেই। দারাজে বেশিরভাগই মাঝারি আকৃতির গরু বিক্রি করা হয়। কারণ এই আকৃতির গরুর চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। ক্রেতারা দারাজ ডটকম থেকে গরুর ভিডিও দেখে পছন্দ করেন, অনলাইনেই অর্ডার দেন।
এ বছর দারাজে আকৃতিভেদে ৪২ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে গরু বিক্রি হয়েছে বলে জানান সায়ন্তনী ত্বিষা।
অনলাইনে গরু বিক্রি করে আলোচনায় এসেছে বেঙ্গল মিট। নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গরু বিক্রি ও ক্রেতা চাইলে মাংস হালাল প্রক্রিয়ায় কোরবানির মাধ্যমে তার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এজন্য গ্রাহককে বেঙ্গল মিটের ওয়েবসাইটে লগইন করতে হয়। এরপর প্রয়োজনীয় ধাপ পূরণ করে গরুর ছবি দেখে অর্ডার দিতে হয়। গ্রাহক চাইলে অনলাইনেও মূল্য পরিশোধ করতে পারেন।
শুধু বড় বড় অনলাইন প্লাটফর্মগুলোই নয়, গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় ছোট ছোট খামারগুলো এবারও ফেসবুকের মাধ্যমে পশু কেনাবেচা করছেন। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপচারিতায় সেই বিক্রেতারাও জানিয়েছেন তাদের কথা।
কথা হয় কনফিয়ানস অ্যাগ্রোর স্বত্ত্বাধিকারী খোরশেদ আলম ও জাহিদুল আলমের সঙ্গে। তারা জানালেন, মূলত গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে তাদের ডেইরি ফার্ম। সেখানে জন্ম নেওয়া বাছুরগুলোকে পরিচর্যার মাধ্যমে কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়। দুই বছর আগে ফেসবুকে পেজ খুলে গরু বিক্রি শুরু করেন। যেহেতু তারা বিশেষ যতেœর মাধ্যমে এদের বড় করেন, তাই বাজারে চাহিদাও থাকে বেশ। তাই যে কয়টি গরু তারা বিক্রির জন্য লালন পালন করেন, তা বিক্রি হয়ে যায়। বেশিরভাগই অনলাইনে বিক্রি হলেও দুয়েকটি পরিচিতরাও খামার থেকে নিয়ে যান।
এ বছর কনফিয়েন্স অ্যাগ্রো ৮০০ থেকে ৮৫০ কেজি ওজনের গরুও বিক্রি করছে। এগুলো বিক্রি হচ্ছে ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকায়।
আস্থা অ্যাগ্রোর স্বত্বাধিকারী মাহবুব জানালেন, তিনি ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেছেন। আবাসন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা করেন। তবে সবসময়ই তার শখ ছিল পশুপালন। শখের বসেই শুরু করেছিলেন গরু লালন পালন। এখন সেটাও তার ব্যবসা।
এই ব্যবসায়ীর খামারও গাজীপুরে। সারাবছরই গরু লালন পালন করে আস্থা অ্যাগ্রো। তবে কোরবানির সময় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বেশিদিন হয়নি যাত্রা শুরু করেছে এই প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে গ্রাহকদের আস্থাও তৈরি করেছে তারা। এখানে ফেসবুক পেজের মাধ্যমেও গরু পছন্দ করতে পারেন ক্রেতা, আবার খামারে এসে দেখেশুনেও কিনতে পারেন। এবার ঈদে গরুর লাইভ ওয়েট (জীবিত গরুর ওজন) হিসেবে দাম ধরা হয়েছে প্রতি কেজি ৩৮০ টাকা। সেই হিসেবেই বিক্রি হচ্ছে তাদের গরু। খামারে ২০০ কেজি থেকে শুরু করে ৪০০ কেজি পর্যন্ত ওজনের গরু আছে বলে জানালেন মাহবুব।
ফেসবুকে আরেকটি গরু বিক্রির পেজের নাম দ্য ক্যাটেল কোম্পানি। ২০১৭ সালে শখের বসে কামরাঙ্গিরচরে খামার শুরু করেন বলে জানালেন এর প্রধান ফারহান আশরাফ মালিক। এক পর্যায়ে ফেসবুকে পেজ খোলেন। সেখানে শুরু হয় বেচাকেনা। তবে শুধু কোরবানি উপলক্ষে নয়, সারাবছরই গরু কেনাবেচা হয় দ্য ক্যাটেল কোম্পানিতে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য নিয়মিত গ্রাহকরা গরু কেনেন, আবার স্থানীয় কসাইরাও তাদের কাছ থেকে গরু কিনে নেন বলে জানান ফারহান আশরাফ।
অন্যদিকে ফেসবুকে পশুর ছবি দেখে পছন্দ করেন অনেক ক্রেতা। এছাড়া খামারে এসে দেখে নেওয়ারও সুযোগ আছে। এবার ক্যাটেল কোম্পানির সম্ভারে রয়েছে ৪০০ কেজি থেকে ৬০০ কেজির বেশি ওজনের গরু। ক্রেতার প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়িও পৌঁছে দেওয়া হয় এখানকার গরু।
এই ব্যবসায় কোনো বাধা আছে কি না— জানতে চাইলে ফারহান বলেন, খামারে গরু আনার পথে অনেক সময় চাঁদাবাজদের কবলে পড়তে হয়। আবার ছোট ছোট খামারিদেরও বিদ্যুতের বাণিজ্যিক সংযোগ নিতে হয়, যেটা তাদের জন্য বেশ ব্যয়সাধ্য। সময়মতো পশু চিকিৎসক বা যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ারও অভিযোগ করলেন তিনি। সরকার যদি এসব দিকে নজর দেয়, তাহলে দেশে এখন যে পরিমাণ খামার আছে তার সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করেন এই বিক্রেতা।
নারায়ণগঞ্জের পুরাতন বন্দর এলাকায় রয়েছে সিকান্দার অ্যাগ্রোর খামার। এই খামারের বিশেষত্ব হলো— এখানকার সব গরু আসে চুয়াডাঙ্গা ও এর আশপাশের এলাকা থেকে। নিজেদের তত্ত্বাবধানে স্থানীয় চাষিদের তদারকিতে বড় হয় গরুগুলো। এবার কোরবানির ঈদের জন্য মোট ৬৫টি গরু পালন করেছেন বলে জানালেন খামারের দুই স্বত্বাধিকারীর একজন মেহেদী খান। তিনি জানান, অনলাইনে মূলত মার্কেটিং করছেন তারা। ক্রেতারা ফেসবুকে ছবি দেখে গরু পছন্দ করে খামারে এসে কিনে নিচ্ছেন। ডিজিটাল স্কেলে লাইভ ওয়েট অনুযায়ী গরু বিক্রি করেন তারা। লাইভ ওয়েট প্রতিকেজি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮০ টাকা। আট থেকে ১৪ মণ ওজনের গরু আছে সিকান্দার অ্যাগ্রোতে।
সিকান্দার অ্যাগ্রোর নিজস্ব ট্রাক আছে। এছাড়া প্রয়োজনে ট্রাক ভাড়া করে গ্রাহকের কাছে গরু পৌঁছে দেওয়া হয়। এছাড়া চাঁদরাত পর্যন্ত ফার্মে গরু রাখার সুযোগ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। শুধু তাই না, পরিবারের সবাইকে নিয়ে গরু পছন্দ করে কেনার সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে।
মেহেদী খান জানালেন, তাদের পালন করা গরুগুলো স্টেরয়েড হরমোনমুক্ত। যেহেতু ডিজিটাল স্কেলে ওজন মাপা হয়, তাই সঠিক ওজনেরও শতভাগ নিশ্চয়তা দিলেন তিনি।
অনলাইনে মার্কেটিং প্রসঙ্গে এই বিক্রেতা বলেন, এতে সুবিধা হলো— ক্রেতা কম্পিউটারের পর্দায় পছন্দের পশুটি খুঁটিয়ে দেখতে পাচ্ছেন। পরিবারের অন্যদের দেখাতেও পারছেন। এতে হাটে হাটে ঘুরে সময় নষ্ট হচ্ছে না। আবার যেহেতু তারা নিজেরাই পশুর জন্য ট্রাক সরবরাহ করছেন, তাই ক্রেতাকে সে বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে না। সহজে যেকোনো মানুষের কাছে তথ্যও পৌঁছে দিতে পারছেন বলে জানান তিনি।
এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট সুবিধাও হাতের নাগালে। তাই বিক্রেতারাও বেছে নিয়েছেন পশু বিক্রির আধুনিক এই পন্থা। ফেসবুকে বিভিন্ন এলাকাভিত্তির গরুর হাটের পেজ বা গ্রুপেরও দেখা মিলবে। আছে কসাই সরবরাহকারী গ্রুপও। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন শপে কোরবানির পশু জবাই ও মাংস কাটার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও কোথাও পরিচ্ছন্নতা কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর ওপর ছাড়ও চলছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *