চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিজুড়ে আর্তনাদ

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা বানিজ্য রাজধানী স্বাস্থ্য

*ক্ষতিগ্রস্ত ৩ হাজার পরিবার
*সব হারানো মানুষের আর্তনাদ
*ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি

মহসীন আহমেদ স্বপন : রাজধানীর মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনের চলন্তিকা মোড়ের পাশে ঝিলপাড় বস্তিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৫০০-৬০০টি ঘর পুড়ে গেছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মোট পরিবারের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। শনিবার সকালে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক রেজাউল করিম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, চলন্তিকা মোড়ের বস্তিতে গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ২২ মিনিটে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিটের চেষ্টায় তিন ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১০টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আর রাত আনুমানিক দেড়টা নাগাদ আগুন পুরোপুরি নির্বাপন সম্ভব হয়েছে। বস্তির আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত সবগুলো ঘরই ছিলো কাঁচা। এর ফলে কিছু ঘর দেবে গেছে এবং ঘরের চালা চাপা পড়েছে। এজন্য এসব ধ্বংসস্তূপ অপসারণে আমাদের সময় লাগছে। এসব অপসারণ করে ভেতরে কোনো ভিকটিম আছে কিনা আমরা সার্চিং করে দেখছি। আগুনে প্রায় ৫০০-৬০০টি ঘর পুড়ে গেছে। এতে প্রায় তিন হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, আগুনের উৎস আমরা এখনো বের করতে পারিনি। তবে আগুনটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধান শেষে আগুনের উৎস নিশ্চিত করে বলা যাবে। আগুন নেভাতে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রধান সমস্যা বস্তির এন্ট্রি পয়েন্ট একটি এবং সরু গলির কারণে বস্তি পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যায়নি। যার ফলে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরগুলো কাঁচা এবং ঘরগুলোর মধ্যে কোনো সেপারেশন ছিল না। পানির সংকট ছিলো। আমরা গাড়ির মাধ্যমে এবং আশপাশের গার্মেন্টস থেকে পানি নিয়ে কাজ করেছি। আগুনটি আশপাশের ভবনে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো, কিন্তু সেটি আমরা রোধ করতে পেরেছি। অগ্নিকা-ের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে কেউ গুরুতর নয় এবং কেউ দগ্ধ হয়নি। ঘটনার বিস্তারিত তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।
পরনের লুঙ্গি আর এই শার্ট ছাড়া কিছুই নাই। সব আগুনে পুড়ে গেছে। আমার স্ত্রীসহ চার মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে পাঁচটি ঘরে এখানে থাকতাম। এখন কি খাবো, কোথায় থাকবো, কিছুই জানি না? ঘরের টাকা কড়িও সব পুড়ে গেছে। এই কথাগুলো বলেন, মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির বাসিন্দা জাহাঙ্গীর। যখন আগুন লাগে তিনি ও তার স্ত্রী ঘরে ছিলেন। চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে পারেননি। পরনের কাপড় নিয়ে শুধু নিজেদের জান বাঁচিয়েছেন। শুধু জাহাঙ্গীর নন, মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে নিজের ঘরের জায়গায় বসে আহাজারি করছেন অন্যরাও।
ধ্বংসস্তূপে সব হারানো মানুষের আর্তনাদ: নগরীর নিন্মবিত্ত মানুষের আবাস বস্তি। যেখানে সাধ্যের মধ্যে শত-সহস্র স্বপ্নের মেলবন্ধন ঘটান তারা। ছোট-ছোট ঘরগুলোতেই সুখের নীড় বাঁধেন সমাজের নূন্যতম চাওয়া-পাওয়ার মানুষগুলো। তবে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে সাধ্যের মধ্যে সাজানো-গোছানো আশ্রয়স্থল হারিয়ে যেন বাকরুদ্ধ তারা। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে কি করবেন এমন দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাদের মনে। আগুনের ভয়াবহ তীব্রতায় ঝিলপাড় বস্তি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কাঁচা টিনের ঘরগুলো এবং ঘরের সব সরঞ্জাম। আর এই ধ্বংসস্তূপে সব হারানো মানুষগুলো খুঁজে ফিরছেন অবশিষ্ট সম্বল।
শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বস্তিজুড়ে টিন ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেউ-কেউ পুড়ে যাওয়া জিনিস বারবার হাতড়াচ্ছে, কিছু পাওয়া যায় কিনা, তাই ভেবে।
বস্তিতে ছোট্ট দোকান করতেন ৭০ ঊর্ধ্ব রিজিয়া বেগম। তিনি বলেন, এখানে ২৫ বছর যাবত আছি। অনেক কষ্ট করে এই দোকানটা করেছিলাম। এই দোকান করে আমার তিন ছেলে ও এক মেয়েকে মানুষ করেছি। এই দোকানই আমার সব ছিল। আগুনে আমার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলো। দোকান থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। এখন থাকবো কোথায়, করবো কি, কিছুই জানিনা। শুক্রবার বিকাল থেকে এখন পর্যন্ত না খেয়ে আছি। যখন আগুন লাগে তখন তিনি দোকানে ছিলেন না বলে জানান।
বস্তির একটি ঘর নিয়ে থাকতেন তানিয়া। তিনি বলেন, আমরা পরিবারের চার জন ছিলাম একটি ঘরে। আমরা সবাই সুস্থ আছি, কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার সম্বল বলতে আর কিছু নেই। অনেক কষ্ট করে সংসারটা গুছিয়ে ছিলাম। এখন কোথায় থাকবো, জানি না। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে না খেয়ে আছি। পোশাক শ্রমিক তানিয়া জানান, আগুন লাগার সময় তিনি ঘরে ছিলেন না।
পেন্টাগন জিন্স নামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন এরশাদ হোসেন (২৬)। থাকতেন মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনে রূপনগর চলন্তিকা ঝিলপার বস্তির একটি রুমে। স্ত্রী রিনা বেগম (২৬), ছেলে শিবলী (১১) ও মেয়ে এলিনাকে (২) নিয়ে ওই রুমেই তার সংসার। ঈদ করতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের পার্বতীপুর। শুক্রবার রাতে পরিবার নিয়ে যখন ফিরলেন, ততক্ষণে ২৫শ টাকা ভাড়ার সেই রুমে পেতে বসা সংসার আগুনে পুড়ে ছাই। মেয়ের খেলনা, ছেলের বই-খাতা-স্কুলের পোশাক, নিজেদের যা কিছু সঞ্চয়— সবই ছিল ওই রুমেই। এরশাদ বুঝতে পারছেন না, স্কুল খুললে ছেলেকে কিভাবে পাঠাবেন স্কুলে। ছোট হলেও শূন্য থেকে যে সংসার গড়ে তুলেছিলেন তিলে তিলে, নতুন করে সেই সংসার গড়ে তুলতে পারবেন কিনা এমন শঙ্কাই ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভেতরে।
শনিবার সকালে কথা হয় এরশাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনের তিন তলায় ঠাঁই হয়েছে তার পরিবারের। তবে কতদিন এখানে থাকতে হবে, জানেন না এরশাদ। এরশাদের পরিবারের মতো অন্তত আরও ২০টি পরিবার আশ্রয় পেয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরশাদের মতো তাদের সবার কপালেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
শুক্রবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে আগুন লাগে মিরপুর ৭ নম্বর সেকশনের চলন্তিকা মোড়ের ঝিলপাড় বস্তিতে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো বস্তিতে। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর রাত ১১টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেয় ফায়ার সার্ভিস, ততক্ষণে বস্তির প্রায় তিন হাজার ঝুপড়ি ঘরের কোনোটিই অক্ষত নেই। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়েছে নিম্ন আয়ের মানুষদের এই বসতি।
শুক্রবার রাতেই বস্তিবাসীদের জন্য আশপাশের পাঁচটি স্কুল খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারগুলোর স্থান হয় সেসব স্কুলেই। তবে সেখানে ‘অসহায়’ অবস্থায় রাত কাটিয়েছেন বলে জানালেন বস্তিবাসীরা।
এরশাদ বলেন, মশার কামড়, গরম আর খালি মেঝেতে আর থাকতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে খাবার দিয়েছে, খেয়েছি। কিন্তু পানি তো দিচ্ছে না। আর এখানে এই অবস্থায় থাকবই বা কতদিন! রোববার ছেলের স্কুল খুলবে। ওর বই-খাতা-শার্ট-প্যান্ট-জুতা তো সব আগুনে পুড়ে গেছে। ও স্কুলে যাবে কিভাবে?
ওই স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিনা বেগম। এসেছেন ভোলা থেকে। ২ আগস্ট মায়ের মরদেহ নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলেন। মাকে দাফন করে ঈদ পার করে সকালে ফিরে দেখেন যা রেখে গিয়েছিলেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যাওয়ার আগে রুমে তালা দিয়ে গিয়েছিলেন। এখন বোঝার উপায় নেই, তার সেই রুমটি কোথায়।
রিনা জানালেন, তিনি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন বাসায় বাসায়। স্বামী আনোয়ার পোশাক শ্রমিক। দু’জনের মাথা গোঁজার ঠাঁই হবে কোথায়, সেটা ভেবেই কূল পাচ্ছেন না।
বাবুর্চির কাজ করেন নান্নু মিয়া। তার পাঁচ মেয়ে। দুই মেয়ে কলেজে পড়ে, এক মেয়ের সামনে এসএসসি পরীক্ষা। বাকি দুই মেয়ের এক মেয়ে নবম শ্রেণিতে ও আরেক মেয়ে ক্লাস সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের সবার বই-খাতা, স্কুল-কলেজের পোশাক ছিল বস্তির ওই রুমেই। সবাইকে নিয়ে কোথায় থাকবেন আর মেয়েদের লেখাপড়া কিভাবে চালিয়ে নিয়ে যাবেন— সেটা ভাবার মতো শক্তিটুকু পাচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
নান্নু মিয়ার সংকট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। তার এক মামার মোবাইলের দোকান আছে, সেই দোকানের এক লাখ টাকা রাখতে দিয়েছিলেন নান্নু মিয়ার কাছে। আগুনের মুখে ছাই হয়েছে সেই টাকাও। নান্নু মিয়া বলেন, মামাকে এখন কী জবাব দেবো? আমার যা গেছে, তা তো গেছেই। কিন্তু মামাকে এখন মুখ দেখাব কী করে!
নান্নু মিয়াসহ বেশ কয়েকজন বলছেন, ঈদের ছুটির মধ্যে আচমকা এই আগুন কিভাবে লেগেছে, সে বিষয়ে সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তাদের অনেকেই ২০-৩০ বছর হলো রয়েছেন এই বস্তিতে। এর মধ্যে কখনো এই বস্তিতে আগুন লাগেনি। তাই এই আগুন নিছক কোনো দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনেও ‘অন্য কিছু’ আছে, তা জানতে চান তারা।
বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় পাওয়া বস্তিবাসীর অভিযোগ, স্কুলের রুমগুলোতে ফ্যান থাকলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তা ঘুরছে না। ফলে তীব্র গরমের এই সময়ে গাদাগাদি করে থাকতে বিশেষ করে শিশুদের প্রচ- কষ্ট হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে খাবার নিয়েও। মেয়র ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিন বেলাই খাবার দেওয়া হবে স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পরিবারগুলোকে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী রাতে খিচুড়ি দেওয়া হলেও সবার ভাগ্যে তা জোটেনি। আর সকালের খাবার পৌঁছাতে পৌঁছাতেই বেজেছে দুপুর ১২টা!
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন মেয়রের পক্ষ থেকে তদারকের দায়িত্বে থাকা ওসমান গণি। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার রান্না করা হচ্ছে, সবার মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সবাই খাবার পাচ্ছে, কেউ বাদ পড়ছে না।
বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতন থেকে সামনে এগিয়ে গেলেই ঝিলপাড় বস্তি। এখন অবশ্য শুধুই ধ্বংসস্তূপ। পুড়ে যাওয়া টিন ছড়িয়ে রয়েছে গোটা এলাকায়। একেকটা রুমের ভেতরে থাকা হাড়ি-পাতিল, চৌকি-চেয়ার, পোশাক-খেলনা কোনোকিছুকেই আলাদা করে চেনা যায় না। তবু কেউ কেউ টিন উঁচিয়ে দেখেন নিচে কিছু কি আছে? সেই ধ্বংসস্তূপই হাতড়ে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ প্রিয়জনের কোনো চিহ্নের কি দেখা মেলে তাতে?
ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি: মিরপুর চলন্তিকা মোড় সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির আগুনের ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে উপ-পরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে। বাকি দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল হালিম এবং উপ-সহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি)। তদন্ত কমিটির সদস্য উপ-সহকারী পরিচালক (ঢাকা জোন-২) নিয়াজ আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *