ভাদ্রের তালপাকা গরমে হাঁসফাঁস নগরজীবন

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী সারাদেশ

মহসীন আহেমদ স্বপন : ভাদ্রের তালপাকা গরমে হাঁসফাঁস হয়ে উঠছে নগরজীবন। ভাদ্রে যেন চৈত্র-বৈশাখের উত্তাপ। গরম কমার কথা থাকলেও তাপমাত্রার যেন হেরফের নেই। বর্ষায় কিছুদিন যখন বৃষ্টি হয়েছে, সেই দু-একটা দিন আরামদায়ক আবহাওয়া ছিল। তবে তা অন্যান্য বছরের তুলনায় ছিল কম দিনের। তাছাড়া গ্রীষ্মের শুরু থেকে মোটামুটি একই ধরনের আবহাওয়ায় পুড়ছে মানুষ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এই তাপমাত্রা স্বাভাবিক নয়। গোটা বছরই তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল এক থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ভাদ্রের ‘তালপাকা’ গরমের সঙ্গে এখনকার আবহাওয়ার পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে সূর্যের এতটা উত্তাপ থাকার কথা নয়।
বছরকে অন্য বছরের চেয়ে ব্যতিক্রমও আখ্যা দিয়েছে অধিদপ্তর। তারা জানাচ্ছে, বছরের এই সময়টায় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকার কথা ৩১ এর আশপাশে। কিন্তু গতকাল সর্বোচ্চ মাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অতিরিক্ত প্রায় পাঁচ ডিগ্রি তাপে সেদ্ধ হচ্ছে মানুষ।
গত শীত মৌসুমটা ছিল অস্বাভাবিক উষ্ণ। ঢাকায় শৈত্যপ্রবাহ আসেনি একটিবারের জন্যও। উত্তরের কিছু এলাকা কিছুদিনের জন্য কাঁপলেও দেশের বাকি অংশে মোটামুটি শীতের জন্য আফসোস দেখা গেছে। আর শীত শেষে চৈত্র থেকে শুরু হওয়া গরমকাল এবার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে মানুষের।
ঘরে, অফিসে, চলার পথে ঘেমে নেয়ে থাকা মানুষের আলোচনার বিষয়বস্তুতে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি থাকছে মাত্রাতিরিক্ত তাপের বিষয়টি। এই সময়ে এত গরম পড়ার কথা নয়, কথাবার্তায় উঠে আসছে প্রায়ই। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে, এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। আর একজন পরিবেশবিদ বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে পরিবেশবিদরা সতর্ক করে আসছেন। কিন্তু কেউ শুনছে না।
যারা কায়িক পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করেন, তাদের অবস্থা শোচনীয়। দিনের একটি বড় সময় গরমের কারণে বিশ্রাম নিয়ে থাকেন তারা। এতে তাদের আয় কমে যাচ্ছে। আর এমনিতেই তুলনামূলক কম অর্থ উপার্জনের কারণে তারা যেহেতু পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেন না, তাই এই আবহাওয়া তাদের জন্য নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক চাপ।
রাজধানীর সাত রাস্তা এলাকায় নিজের রিকশায় শুয়ে ঘুমুচ্ছিলেন রহিম মিয়া। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর চোখ মেলে তাকালেন। বলেন, আর দিনে আর রিকশা চালামু না।
গরমের লাইগ্যা এহন দিনে চালাইতে পারি না। গত সপ্তাহে রাইতেই চালাইছি। টেকা দরকার বইল্যা বারাইছিলাম। কিন্তু বাপরে বাপ, যেন আগুন ঢালতাছে সূর্য। ভাদ্রের গরম অন্য রকম। মনে হয় যেন চৈত-বৈশাখ মাস। মনে হয় আর রিকশা টানা অইব না।
একই এলাকায় এক চায়ের দোকানিও দুপুরের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনিও রাতে খুলবেন জানিয়েছেন। বলেন, গরমে আমি অসুস্থ হয়া যাই। আই মাঝে মাঝে। মনে করি চালাইতে পারুম। কিন্তু আর পারি না। চইল্যা যাই।
বাসে বা মানুষের জমায়েতে তাকালেই চোখে পড়ছে ধর্মাক্ত মানুষের শরীর। এর মধ্যে গণপরিবহনে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী উঠলে ভেতরের পরিস্থিতিও হয়ে উঠে ‘উত্তপ্ত’। যাত্রীরা হারায় মেজাজ।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড বলছে, গত একশ বছরে গ্রীষ্মকালীন মাসগুলোর মধ্যে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। তাদের রেকর্ড অনুসারে মার্চ মাসের তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এপ্রিলে ০.৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মে ও জুন উভয় মাসেই বেড়েছে গড়ে ০.১৭ ডিগ্রি।
পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়া এবং মৌসুমি বায়ু সক্রিয় না হওয়ার কারণেই গরমের প্রকোপ বাড়ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়াসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড মিটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের বক্তব্য অনুযায়ী, বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত যে, পৃথিবী ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। প্রায় সমস্ত স্থলভাগেই আরো বেশি সংখ্যায় উষ্ণ ও তাপ প্রবাহ বাড়ার আশঙ্কা দেখছে।
এবার গ্রীষ্মমন্ডলীর অঞ্চল ছাড়াও ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ শীতপ্রধান ইউরোপও পুড়েছে অস্বাভাবিক গরমে। ফ্রান্সের তাপমাত্রা ভঙ্গ করেছে ৪০ বছরের রেকর্ড। গরম প্রধান মধ্যপ্রাচ্যের আবহাওয়া আরও অসহনীয় হয়ে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে।
আবহাওয়া অফিসের জানায়, জানুয়ারি মাসের সর্বোচ্চ গড় তাপমত্রা থাকার কথা ২৫.২ ডিগ্রি সেলিসিয়াস, ফেব্রুয়ারিতে ২৭.৮ ডিগ্রি, মার্চ মাসে ৩১.৬ ডিগ্রি, এপ্রিলে ৩৩.২ ডিগ্রি, মে ৩২.৯ ডিগ্রি, জুন ৩১.৯ ডিগ্রি, জুলাই ৩১.১ ডিগ্রি, আগস্ট ৩১.৪ ডিগ্রি, সেপ্টেম্বর ৩১.৫ ডিগ্রি, অক্টোবর ৩১.৫, ডিগ্রি, নভেম্বর মাসে ২৯.৫ ও ডিসেম্বর মাসে ২৬.৪ ডিগ সেলসিয়াস।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ রুহুল কুদ্দুস জানান চলতি জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গড়ে চার থেকে ৫ ডিগ্রি তাপমাত্র বেশি রেকর্ড করা হয়েছে। আগস্টের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৩১.৪ আর সেপ্টেম্বরে সেপ্টেম্বরে যেখানে ৩১.৫ থাকার কথা সেখানে, বেশিরভাগ দিনই তা ছিল ৩৫ এর বেশি।
কেন এত বেশি গরম? রুহুল কুদ্দুস বলেন, গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি নেই। বাতাসের আদ্রতাও বেশি, বাতাসে ৯৩ শতাংশ এখন জলীয় বাষ্প। এটাও স্বাাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া বাতাসের স্বাভাবিক গতিবেগ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে, যা ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। এ কারণেও এই মৌসুমে যে ধরনের গরম হয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি অনুভূত হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, কেবল চলতি বছর নয়। গত কয়েক বছর ধরেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবার আর এই মুহূর্তে বঙ্গোপসাগরে লঘু চাপ আছে। সেটাও গরমের একটি কারণ।
ক্রমাগত গরম বেড়ে চলা আর স্বাভাবিকের চেয়ে চার থেকে ছয় ডিগ্রি তামপাত্রা বেশি থাকা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সেস অনুষদের শিক্ষক এ কিউ এম মাহবুব। তিনি একে দেখছেন বৈশি^ক উষ্ণায়নের ফসল হিসেবে।
ক্রমশই তামমাত্রা বেড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব। এই বিষয়ে আমরা গত এক দশক ধরে বলে আসার চেষ্টা করছি। কিন্তু এসব বলে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।
সমগ্র পৃথিবীতেই উষ্ণায়নের প্রভাব আছে। ঢাকা শহরেও এর যন্ত্রণা আরও বেশি। কারণ এখানে জনসংখ্যার অতি ঘনত্ব, একটার সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া ভবন, লাখ লাখ বাড়ি বা অফিসে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার, যানবাহন থেকে নির্গত ধোয়ার কারণে তাপমাত্রা যত থাকুক, গরম অনুভূত হচ্ছে তার চেয়ে বেশি।
এই আবহাওয়া কৃষির জন্যও ভালো নয়। গত শীত মৌসুমে তামপাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হওয়ায় গম ও ধানে ব্লাস্ট রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
কৃষি অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে কর্মরত কৃষিবিদ খন্দকার মো. রাশেদ ইফতেখার বলেন, এখন আমনের মৌসুম। এখন হয়ত এই আবহাওয়া বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু এই ধরনের তামপাত্রা যদি বেশিদিন স্থায়ী হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই উৎপাদনে খারাপ প্রভাব ফেলবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *