ভয়ঙ্কর হচ্ছে কিশোর গ্যাং

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় রাজধানী

গ্যাং দল নিশ্চিহ্নের ঘোষণা পুলিশের

মহসীন আহমেদ স্বপন : ঢাকায় দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে উঠতি কিশোরদের গ্যাং কালচার। স্কুল-কলেজের গ-ি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এই গ্যাং কালচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত দুই মাসে দুই শতাধিক কিশোরকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর আগে শুক্রবার রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ১১০ জন সদস্যকে আটক করা হয়। এ ছাড়াও এলাকার স্থানীয় সহিংসতা বন্ধে ইতোমধ্যে র‌্যাব-পুলিশ মোহাম্মদপুর-মিরপুরে অভিযান চালিয়ে মোট ৩ শতাধিক সদস্যকে আটক করেছে। সর্বশেষ কিশোর গ্যাং সদস্যদের আঘাতে মোহাম্মদপুরে এক কিশোর নিহত হয়।
এ দিকে ঢাকা শহরে গ্যাং কালচার বলতে কিছু থাকবে না, সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উদ্ভট উদ্ভট সব নাম দিয়ে খোলা হয়েছে এসব গ্রুপ। ঢাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং’ এর নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে। মোহাম্মদপুরে খুন হওয়া কিশোরটি ‘ফিল্ম ঝির ঝিল’ গ্যাং এর সদস্য ছিল। আর ‘আতঙ্ক’ গ্যাং এর সদস্যরা তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে আসে। এর পর এসব গ্রুপের ব্যাপ্তি বেড়েছে। ১৫-২০ বছর বয়সী কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে।
কিশোর অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন। তিনি বলেন, ‘কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে। আগে তারা বখাটেপনা বা মেয়েদের উত্যক্ত করত। এখন হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে।
এর বড় কারণ পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা। এরপর বলব, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নেই। আগে গ্রামের মুরুব্বিকে সবাই ভয় পেত। এখন নগরায়নের ফলে মুরুব্বিদের তারা ভয় পায় না, উল্টো মুরুব্বিরাই তাদের ভয় পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। তারা এখানে খুব একটা মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। পাশাপাশি এখন তো খেলার মাঠ নেই। তাই সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট। তারা ইন্টারনেটে মারামারির গেম খেলছে, হরর ফিল্ম দেখছে, এগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য স্কুলে অনিয়মিত বা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া। এদের অধিকাংশই বখে যাওয়া কিশোর। আমরা এমন পাঁচ কিশোরকে আটক করেছি। কিশোর গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে।
র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, গত দুই মাসে আমরা অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্যকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছি। ২৪ আগস্ট রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ‘স্টার বন্ড গ্রুপের’ ১৭ সদস্যকে আটক করে এক বছর করে সাজা দেওয়া হয়। একই দিন বংশালে ‘জুম্মন গ্রুপের’ প্রধানসহ পাঁচ সদস্যকে ধরা হয়। ২৫ আগস্ট মুগদায় অভিযান চালিয়ে ‘চান-জাদু (জমজ ভাই) গ্যাং’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টির’, ‘ভলিয়ম টু ও ভা-ারি’ গ্রুপের ২৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে সাজা দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, একটা ঘটনা বলি, একটি ছেলে একটি মেয়েকে উত্যক্ত করত। মেয়েটির বড় বোন ছেলেটিকে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এটি একটি রাস্তার উপরের ঘটনা। ছেলেটি মেয়েটির বোনকেও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করল। ওই রাস্তা দিয়ে বহু মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদ করলেন না। আসলে আগে অপরাধ করলে অপরাধীরা ভয়ে থাকত। আর এখন অপরাধীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকেন।
এইসব গ্যাং কালচারের কিশোরদের অধিকাংশই মাদকসেবী। মাদক এমন একটি জিনিস সেটা ব্রেনের নার্ভকে নষ্ট করে দেয়। ফলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে। বা মুহুর্তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এসব কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে এবং খুনোখুনির ঘটনা বেশি হচ্ছে।’
গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর লালবাগ কেল্লায় আশুরায় ঢোল বাজানো নিয়ে বিতর্কের জের ধরে রনি হাসান নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে আরেক কিশোর গ্রুপ।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া বলেন, এই কিশোররা সংঘবদ্ধ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এদের পেছনে কোনো গডফাদার বা প্রভাবশালী কেউ রয়েছে। ফলে কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। অনেক সময় আমরা তদন্তে গিয়ে দেখেছি, সত্যি সত্যি এরা গডফাদারের আর্শিবাদপুষ্ট।
ডিএমপির হুশিয়ারি গ্যাং বলে ঢাকায় কিছু থাকবে না : ঢাকা শহরে গ্যাং কালচার বলতে কিছু থাকবে না। সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। হোসেনী দালানের ইমামবাড়ায় শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনের আগে কমিশনার ইমামবাড়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শন করেন।
তাজিয়া মিছিলে প্রতিবছর কিশোর গ্যাংয়ের কারণে বিশৃঙ্খলা হয়। তাদের বিষয়ে পুলিশের কোনো পদক্ষেপ থাকবে কি না- জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার বলেন, কিশোর গ্যাং বলি আর বড় গ্যাং বলি ঢাকায় গ্যাং বলে কোনো শব্দ থাকবে না। সবাইকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। গ্যাং কালচারের বিরুদ্ধে ডিএমপি শূন্য সহিষ্ণু নীতি অবলম্বন করেছে। ঢাকায় কোনো গ্যাং থাকবে না। এ ছাড়াও অন্য কাউকেও মিছিলে নাশকতা করতে দেয়া হবে না। এর আগে শুক্রবার রাতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ১১০ জন সদস্যকে আটক করা হয়। এ ছাড়াও এলাকার স্থানীয় সহিংসতা বন্ধে ইতোমধ্যে র‌্যাব-পুলিশ মোহাম্মদপুর-মিরপুরে অভিযান চালিয়ে মোট ৩ শতাধিক সদস্যকে আটক করেছে। সর্বশেষ কিশোর গ্যাং সদস্যদের আঘাতে মোহাম্মদপুরে এক কিশোর নিহত হয়।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *