বিশেষ প্রতিবেদক : রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন জালিয়াতিতে দালালরা কাজ করতো চারটি স্তরে। এতে জড়িত আছেন উপজেলা নির্বাচন অফিসার এবং এনআইডির টেকনিক্যাল এক্সপার্টও। পরিচয়পত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইসির নিজস্ব স্ক্যানার ও মডেম। এরইমধ্যে এ চক্রের ২০ জনের তথ্য পেয়েছে কমিশনের তদন্ত কমিটি।
নির্বাচন কমিশনের তদন্ত সূত্র বলছে, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরেই রয়েছে দালাল চক্রের সদস্যরা। তাদের প্রথম কাজ, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এনআইডি কার্ডের বিনিময়ে টাকা-পয়সার বিষয়টি ফয়সালা করা। এরপর কৌশলে ক্যাম্প থেকে বের করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজার শহরে।
সূত্র বলছে, কক্সবাজার থেকে আরেক দালালের মাধ্যমে তাদের পৌঁছে দেয়া হতো চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে অন্য দালাল রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেত নির্বাচন কমিশনের হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপ ব্যবহারকারীর কাছে।
প্রথমে তাদের নাম নিবন্ধন করে, ছবি ও স্বাক্ষর ইনপুট দেয়া হতো ল্যাপটপে ইনস্টল হয়ে থাকা ইসির সফটওয়ারে। পরে এনআইডির প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই আরেকটি ল্যাপটপে এ তথ্যগুলো স্ক্যান করে রাখা হয়।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে রয়েছে কমিশনের নিজস্ব প্রায় ২০টি মডেম। মডেমগুলোর মাধ্যমে মূলত মূল সার্ভারে কাজ তথ্য ইনপুট দেন ইসির মাঠ কর্মকতারা। এরমধ্যে একটি মডেম নিয়মিত ব্যবহার করতো দালাল চক্রের সদ্যসরা। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচন অফিসারের ইউজার এবং পাসওয়ার্ডও। সবশেষ ধাপে ঢাকার লালবাগ থানার হালনাগাদ কার্যক্রমের টেকনিক্যাল সহযোগী সত্য এবং ইসির থেকে চাকরিচ্যুত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগরের সহযোগিতায় প্রিন্ট করা হতো জাতীয় পরিচয়পত্র। এমনকি এতে এনআইডি উইংয়ে অন্তত ৩ জন টেকনিক্যাল এক্সপার্টের হাত রয়েছেও বলে জানা গেছে তদন্ত সূত্রে।
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম বলেন, যে ল্যাপটপ হারিয়েছে সেটা দিয়ে আর কোনো ভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। বর্তমান যে কম্পিউটারগুলো ব্যবহার হচ্ছে সেগুলো আমরা আপগ্রেড করেছি। ফলে এখন অনৈতিকভাবে কেউ করতে চাইলেও করতে পারবে না। আমাদের যে দক্ষ কারিগরি টিম রয়েছে তারা অবশ্যই ডিটেক্ট করতে পারবে।
সারা দেশে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম ২০ নভেম্বর শেষ হবে। নিবন্ধন কার্যক্রমে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাসমূহে রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হতে না পারে, সে বিষয়ে ইসি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে। হালনাগাদ কার্যক্রম সফল করতে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার ৩২টি উপজেলাকে ‘বিশেষ এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবু রোহিঙ্গারা বিভিন্ন কৌশলে ভোটার হওয়ার জন্য নানা রকম অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাদের এই অপচেষ্টা নিবৃত্ত করার জন্য কমিশন সবার সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেছে। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠান ইসি সচিব।
ইসির উপসচিব মো. আব্দুল হালিম খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিশেষ কমিটির উদ্দেশে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার বিষয়ে কারো কোনো রকম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে এবং তদন্তে তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা ও আইনানুগ ফৌজদারি মামলা করা হবে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়ে যদি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের সহযোগিতা অথবা মিথ্যা তথ্য প্রদান অথবা মিথ্যা কাগজপত্র সরবরাহ করেন, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ফৌজদারি মামলা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন ইসির ঘোষিত ৩২টি বিশেষ উপজেলার বাইরে গিয়ে ভোটার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ ক্ষেত্রে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কেননা, এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা প্রকৃত বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে ভোটার হচ্ছে। প্রকৃত নাগরিকের মতো স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান থেকে নাগরিক সনদ ও জন্ম সনদ সংগ্রহ করছে তারা। এই জন্ম সনদ দিয়ে পাসপোর্টও তৈরি করছে রোহিঙ্গারা। যদিও বাংলাদেশে অবস্থিত ১১ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গার ফিঙ্গার প্রিন্ট সংবলিত ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। ডাটাবেজের বাইরে অনিবন্ধিত ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করা কষ্টসাধ্য বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন) আবদুল বাতেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আমরা এখন রোহিঙ্গা শনাক্ত করতে দুটি ডাটাবেজ ব্যবহার করছি। প্রথমত, নতুন করে যারাই ভোটার হচ্ছে, তারা রোহিঙ্গা কি না, তা শনাক্ত করতে ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গার ডাটা চেক করা হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা হিসাবে নো ম্যাচিং এলে পরবর্তীতে ইসির সাড়ে ১০ কোটি ডাটাবেজ চেক করে নো ম্যাচিং এলেই কেবল ভোটার হিসেবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
এদিকে ভোটার তালিকায় যে ৪৬ জন রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সার্ভারে ব্লক করেছে ইসি। ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা ঠেকাতে তাৎক্ষণিকভাবে ৫১৮টি থানা ও উপজেলা অফিসের সার্ভারের পাসওয়ার্ড ও কোড নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন করে আরো রোহিঙ্গাদের নাম ঢুকতে পারে এমন আশঙ্কায় ৩ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্ভারে নতুন ভোটারদের তথ্য আপলোড করার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা নারী লাকি আটকের পর রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসে। চট্টগ্রামের একটি থানা নির্বাচন অফিসের তদন্তে এক এলাকার ফরমে অন্তত ১৪টি থানায় রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঐ ঘটনায় ইসির একজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে একই এলাকার একটি ভোটার বইয়ের ৭৪টি নিবন্ধন ফরমের মাধ্যমে অন্তত ৬ জেলার ১৪টি থানা নির্বাচন অফিস থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হয়েছে। একই নম্বরে একাধিক ব্যক্তি ভোটার হয়েছে। যেসব থানায় এসব ফরম ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, পাহাড়তলী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া। নোয়াখালীর সেনবাগ, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ, রাঙ্গামাটির লংগদু, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর।
ইসির অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামের ডবলমুরি উপজেলা নির্বাচন অফিসের একজন পিয়ন জয়নাল আবেদিন রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির অপচেষ্টায় জড়িত ছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে এসেছে। তার বিরুদ্ধে আমরা ফৌজদারি মামলা দেওয়া এবং বিভাগীয় মামলার ব্যবস্থা নিচ্ছি। অন্য কেউ জড়িত আছে কি না, সেটাও আমরা দেখছি। ভোটার করতে পারেনি, আইডি দিতে পারেনি, এটেম্প নিয়েছে, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো মতেই যাতে আইডি কার্ড না পায়, সে জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। তারা ভোটার হতে পারবে না।
তদন্ত কমিটির সন্দেহ, এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত স্বয়ং দু’জন উপজেলা নির্বাচন অফিসার।
নির্বাচন কমিশনার কবিতা খান বলেন, এ কাজে নির্বাচন অফিসের কর্মকতা বা যেই সংশ্লিষ্ঠ থাকুক তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।