এইচ এম হাকিম (কালীগঞ্জ) : চিকিৎসার জন্য পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করেছে ভারতীয় পুলিশ। বুধবার সকালে কলকাতার নিউটাউন এলাকার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যু নিয়ে দানা বেঁধেছে রহস্যের জট।
কী কারণে বাংলাদেশের একজন বর্তমান সাংসদকে নৃশংসভাবে খুন করা হলো এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এদিকে আনার এমপির মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুনের রহস্য উদঘাটনে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। ভারতীয় পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন দুজন।
হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিন তিনবারের সংসদ সদস্য এবং কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজীম আনার চিকিৎসার জন্য গত ১২ই মে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে সড়ক পথে ভারতে প্রবেশ করেন। ওই সময় তাঁর সাথে সঙ্গী হিসেবে কাউকে যেতে দেখা যায়নি। ভারতে প্রবেশের পর একইদিন সন্ধ্যায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরাহনগর থানার অন্তর্গত ১৭/৩ মণ্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দা দীর্ঘদিনের পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। পরের দিন অর্থাৎ ১৩ই মে দুপুরে তিনি ডাক্তার দেখানোর কথা বলে গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বের হয়ে যান এবং যাওয়ার সময় বলে যান দুপুরে খাব না, সন্ধ্যা বেলা ফিরে আসবো। কিন্তু তিনি আর ফিরে না আসায় গত ১৮ই মে বরাহনগর থানায় একটি মিসিং ডায়েরি করেন গোপাল বিশ্বাস। যদিও ১৫ তারিখ পর্যন্ত তিনি হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজের মাধ্যমে গোপাল বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
ডায়েরিতে গোপাল বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন ১৫ই মে সকাল ১১টা ২১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করে এমপি আনার দিল্লি পৌঁছানোর কথা জানান এবং বলেন সাথে ভিআইপিরা আছে ফোন করার দরকার নাই। একই ম্যাসেজ তিনি বাড়িতে এবং ব্যক্তিগত সহকারীকে ফরোয়ার্ড করেন।
১৬ তারিখে তিনি ব্যক্তিগত সহকারীকে ফোনে কল দেন। কিন্তু তিনি কলটি রিসিভ করতে না পারায় পরবর্তীতে কল ব্যাক করলেও তাঁর সাথে আর কোনোরূপ যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একই দিন সকালে তিনি ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর মোবাইলে ফোনেও কল দেন বলে জানা গেছে। তবে কোনো কারণে তিনিও ফোনটি রিসিভ করতে পারেন নাই। এরইমধ্যে এমপি আনারকে খুঁজে পেতে দুই দেশের পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করতে শুরু করেন।
গতকাল বুধবার সকালে কলকাতা নিউটাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেনস এর একটি ফ্ল্যাট থেকে এমপি আনারের খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধারের সংবাদ পাওয়া যায়। দুই দেশে শুরু হয় তোলপাড়। এমপির মৃত্যুর খবরে তাঁর পরিবার ও কালীগঞ্জ এলাকার নেতাকর্মীদের মাঝে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এদিকে ভারতের যাওয়ার সময় দর্শনা চেকপোস্ট থেকে অটোভ্যানে করে এমপি আনারকে ভারতের গেদের দিকে একা যেতে দেখা গেলেও ভারতে গিয়ে তার সাথে আরও কয়েকজন বাংলাদেশী যোগ দেন। অর্থাৎ তিনি ভারতে একা যাননি বলে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ধারণা করছেন। গোপাল বিশ্বাসের বাড়ি থেকে বের হয়ে এমপি আনার যে ক্যাবে ওঠেন সেই গাড়িতে পরে আরও তিনজন ওঠেন বলে জানিয়েছেন ক্যাবচালক।তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও একজন নারী। ক্যাবচালক তাদেরকে কলকাতা নিউটাউন এলাকায় নামিয়ে দেন।
পশ্চিমবঙ্গের এটিএফ কর্মকর্তারা জানান, এদের মধ্যে পুরুষ দুইজন বাংলাদেশে ফিরে যান। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগকে জানানো হলে তারা দুই জনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের দেয়া তথ্য কলকাতার পুলিশকে জানানো হয়। এরপরেই এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ।
কলকাতা প্রশাসন জানিয়েছেন, সরকারি প্রটোকল না মেনে এমপি আনার ভারতে আসেন। তবে দুই দেশের প্রশাসন প্রাথমিকভাবে এতটুকু নিশ্চিত হয়েছেন যে, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা সকলেই বাংলাদেশী নাগরিক। উল্লেখ্য, এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাংসদ হওয়ার পরও তিনি কোনোপ্রকার প্রটোকল না নিয়ে রাত-দিন একাই মোটরসাইকেলে নির্বাচনি এলাকা ঘুরে বেড়াতেন। কর্মীদের বিপদে-আপদে সবসময় থাকতেন পাশে।