বিশেষ প্রতিবেদক : খনন হয়নি নদী। যেখানকার মাটি রয়েছে সেখানেই। উপরন্তু বালু ও পলির প্রলেপে ভরাট হয়ে গেছে নদীর পেট। স্থানীয় কৃষিজীবীদের উপকার হয়নি এক রত্তি। অথচ ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বরাদ্দের টাকায় উদরপূর্তি হয়েছে প্রকৌশলী ঠিকাদার ও বালুদস্যদের। নিজেরাই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ হওয়া ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর বৃহৎ এই দুর্নীতি সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তারা মরিয়া।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নেত্রকোণার কংস ও ভোগাই নদীর ১৫৫ কিলোমিটার খনন প্রকল্প হাতে নেয়। ম্যাকানিজম করে এ কার্যাদেশ পায় ৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। বসুন্ধরা ইনফ্রাস্টাকচার ডেভলপমেন্ট লি:, সোনালী ড্রেজার লি:, বিডিএল-এসআরডিসি (জেবি), এস এস রহমান, মাতৃবাংলা (জেবি) ও নবারুন ট্রেডার্স লি:। টেন্ডারের অনুযায়ী, নদী দু’টির প্রশস্থ ৮০ থেকে ১০০ ফুট। শর্ত ছিল, ড্রেজিংয়ের পর গভীরতা অনুসারে শঙ্ক মৌসুমে নদীতে ৮ থেকে ১০ ফুট পানি থাকতে হবে।
অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (১ম পর্যায়ে ২৪টি নৌ-পথ) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ভোগাই এবং কংস নদীর মোহনগঞ্জ থেকে নালিতাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথ খনন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত ড্রেজিং ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো নদীর খনন কার্যক্রম ভাগ করে নেয় ৫টি পয়েন্টে। প্রতিষ্ঠানগুলো নদী থেকে ১ কোটি ঘনমিটার বালু উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে। কাগজ-কলমে সেই কাজ ‘শেষ’ ও হয়েছে। ঠিকাদাররা পেয়ে গেছেন সমুদয় বিল। কিন্তু যেমন নদী তেমনই রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও হয়েছে আগের চেয়ে বেশি ভরাট। ড্রেজিংয়ের নামে ভয়াবহ এই দুর্নীতির কোনো তল খুঁজে পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ভোগাই-কংস নদী খনন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী বিআইডব্লিটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) আবু বকর সিদ্দিক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) দিদার এ আলমের বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। তাতে নদী খনন না করেই বরাদ্দকৃত ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য ছিল। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের (সজেকা)’র উপ-পরিচালক মো: আবুল হোসেন এবং একজন উপ-সহকারী কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি টিম মাঠে নামে। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। তাতে অভিযোগের অধিকাংশ তথ্যেরই সত্যতা মেলে।
প্রথমত : দুর্নীতির প্রথম দফায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ড্রেজিং এস্টিমেট ধরা হয়। দ্বিতীয় দফায়: দরপত্র অনুযায়ী, ড্রেজার দিয়ে খনন, এস্কেভেটরের সাহায্যে খনন এবং কোদাল দিয়ে মাটি স্থানান্তরের পৃথক ৩ ধরনের কার্যাদেশ ছিল। বাস্তবে এস্কেভেটর দিয়ে খননের প্রমাণ মেলেনি। বর্ষার পানি নেমে গেলে খননস্থলে ৮/১০ গভীর পানি থাকা দূরের কথা-বিভিন্ন জায়গায় জমেছে পলির স্তর। যাতে প্রতীয়মান হয়, কোনো ধরনের খনন কাজই হয়নি। অর্থাৎ কোনো ধরনের খনন না করেই পরস্পর যোগসাজশে তুলে নেয়া হয়েছে বরাদ্দের অর্থ।
তথ্য মতে, বিআইডব্লিটিএ’র কার্যাদেশ পাওয়া মাত্র স্থানীয় বালুদস্যুরা ভলগেট দিয়ে কংস ও ভোগাই নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে লেগে যায়। এ বালু বিক্রির মাধ্যমে পকেটস্থ করে কোটি কোটি টাকা। এর ভাগ পান বিআইডব্লিটিএ’র সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এ হিসেবে, নদী খননে বরাদ্দকৃত কোনো অর্থই খরচ হওয়ার কথা নয়। অথচ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করে তুলে নিয়েছে বরাদ্দের অর্থ।
এই অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বিআইডব্লিউটিএ’র মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুদক সূত্র জানায়, ভোগাই ও কংস নদ খননের নামে অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রেকর্ডপত্র হস্তগত হয়েছে। প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, বিআইডব্লিটিএ’র মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী, দুই নির্বাহী প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এটি খননের মাটি পরিমাপের পর্যায়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মতো পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ এখন দুদকের হাতে। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় চলছে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি প্রদানের প্রস্তুতি। উদ্দেশ্য হাসিলে অবলম্বন করা হচ্ছে অভিনব কৌশল।
সূত্রটি জানায়, বিআইডব্লিউটিএ’র সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ সেক্টর ড্রেজিং বা খনন। ৫৩টি নৌপথের ড্রেজিং প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করছে এ বিভাগ। ড্রেজিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো: ছাইদুর রহমান। বিআইডব্লিউটিএ ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের মাস্টারমাইন্ডও তিনি। ড্রেজিং বিভাগের দুর্নীতিমাত্রই সংশ্লিষ্টতা মেলে এই প্রকৌশলীর। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান দুদকের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা তার শুভাকাংক্ষী। তারাই তাকে শেল্টার দেন। এ কারণে চূড়ান্তভাবে তার বিরুদ্ধে দুদক কিছুই করবে নাÑ এমন আত্মবিশ্বাস থেকে দুর্নীতিতে তিনি বেপরোয়া। ছাইদুর রহমান, তার স্ত্রী শামিমা আক্তার, বিআইডব্লিটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) সিরাজুল ইসলাম ভুইয়ার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের ফাইলটি তিনি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন। মামলার যথেষ্ট উপকরণ হাতে আসা সত্ত্বেও দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে কুণ্ঠিত। ‘অনুসন্ধান চলছে’, ‘সম্পদ বিবরণী এখনও যাচাই চলছে’Ñ এমন দাবি করার জন্য মাঝেমধ্যেই অনুসন্ধান কর্মকর্তারা ইস্যু করছেন চিঠি। অনুসন্ধানের নামে একের পর এক বদল হচ্ছেন কর্মকর্তা। ছাইদুর রহমান দম্পতির বিরুদ্ধে ৮ বছর ধরে পড়ে থাকা এই অনুসন্ধানের সঙ্গে এবার ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অনুসন্ধানটি একীভূত করে এখন প্রস্তুতি চলছে মূল বিষয়টি আড়াল করে দায়মুক্তির প্রক্রিয়া।
সূত্রমতে, ছাইদুর রহমান গংদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানটি পরিচালিত হচ্ছে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে। অন্যদিকে ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগটির অনুসন্ধান করছেন ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: আবুল হোসেনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি টিম। ঢাকার নথিটি অনুসন্ধান করছেন উপ-পরিচালক মো: আব্দুল মাজেদ। এর আগে উপ-পরিচালক জালালউদ্দিন আহমেদ, উপ-পরিচালক মো: সালাহউদ্দিন পর্যায়ক্রমে এটি অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তবে উভয় নথির সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলতে রাজী হননি।
তবে সূত্র বলছে, ২০২০ সালে প্রকৌশলী মো: ছাইদুর রহমান, তার স্ত্রী শামিমা আক্তার, বিআইডব্লিটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মো: সিরাজুল ইসলাম ভুইয়ার সম্পদ বিবরণী চাওয়া হয়। দুদক পরিচালক (বিশেষ) আক্তার হোসেন আজাদ তাদের সম্পদ বিবরণীর নোটিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০১.০৪০.২০২০) দেন। এ প্রেক্ষিতে তারা সম্পদ বিবরণী দাখিলও করেন। তবে তিন বছরেও শেষ হয়নি সম্পদ বিবরণী যাচাই। এর মধ্যে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রকৌশলী ছাইদুর রহমানের কিছু রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। ওই বছর ১৬ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। কিন্তু দায়মুক্তি প্রদানের অদৃশ্য ইঙ্গিত থাকায় সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তাগন ছাইদুর রহমানের বেনামী সম্পদের বিষয়টি এড়িয়ে যান বলে জানা গেছে। প্রায় বিনা আপত্তিতে ‘গ্রহণ’ করে নিয়েছেন আয়কর নথিতে প্রদর্শিত সম্পদের অবিশ্বাস্য বিবরণী।
রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান শুধু মিথ্যা তথ্যই দেননি। জীবিত পিতাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে নিজেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদের মালিক দাবি করেছেন। ২০১৭ সালে পিতাকে ‘মৃত’ দাবি করা হলেও তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন বলে জানা যায়। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পিতা জীবিত থাকতে সন্তান পিতার সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক-এমনটি দেখাতেই তিনি এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেন বলে জানা গেছে।
২০১৬-২০১৭ সালে দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন (টিআইএন নং-৬১৯৪৬১৫৭১২৬৩, সার্কেল-৩৬, করাঞ্চল-০২) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মো: ছাইদুর রহমান পিতা-মৃত আনিছুর রহমান এবং মাতা মোসা: শামছুন নাহার, নিজের জন্ম তারিখ-১০/০৬/১৯৭৩ ইং সাল বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম, বেনগাছা উপজেলার, ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন, মুক্তারামপুর গ্রামে। ওই বছর আয়কর নথিতে তিনি বার্ষিক আয় ৭ লাখ ৯ হাজার ৩৮৮ টাকা দেখিয়েছেন। এ হিসেবে ৩১ হাজার ৯৬৮ টাকা কর পরিশোধ করেছেন। উতসে কর শোধ করেছেন ৫ হাজার টাকা। আয়কর নথিতে তিনি স্বর্ণ বিক্রির প্রমাণস্বরূপ তিনি ৩টি মানি রিসিপ্ট দেখিয়েছেন। একটি রসিদে স্বর্ণের বিক্রিয় দেখিয়েছেন ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৬৬ টাকা। একটি রসিদে দেখিয়েছেন, ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৯৫ টাকা। আরেকটি রসিদে দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৪ টাকা। দু’টি রসিদই ঢাকার ১৩/৪, চাঁদনী চক মার্কেটে অবস্থিত ‘বলাকা জুয়েলার্স’র। যদিও সরেজমিন অনুসন্ধানে ওই স্থানে এ নামে কোনো স্বর্ণালঙ্কার দোকানোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রায় ৩৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আয়কর ফাঁকি দিতে তিনি দাখিল করেছেন স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির ভুয়া রসিদ। গোপন করেছেন নিজের বেনামী সম্পদের তথ্য।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ২৫/বি, এম. ডব্লিউ মানামা হাইটস’র ৮ তলায় রয়েছেÑ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। একই এপার্টমেন্টে ছাইদুর রহমানের আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর ৫৫/৫৬ সিদ্ধেশ্বরীর ৪/এ, আমিনাবাদ হাউজিং এ রয়েছে বিশাল ফ্ল্যাট। এসব সম্পত্তি তিনি শ্বশুরের বলে প্রচার করেন। নিজ জেলা কুড়িগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড় রড-সিমেন্টের দোকানটি ছাইদুর রহমানের। এখানে রয়েছে অন্তত: ২০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। দোকানটি পরিচালনা করেন তারই ভাই আব্দুল আলীম।এ ছাড়া কুড়িগ্রামের কাঠালবাড়ী বড়পুলপাড় গর্বোরদোলা গ্রামে মেসার্স এমটিআর ব্রিকস নামে রয়েছে একটি অটো ইট ভাটা। যার মুল্য শত কোটি টাকা। এটি পরিচালনা করেন তার ভাই এস এম তৌফিকুর রহমান।
নদী খনন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য নিতে বিআইডব্লিটিএ’র অতিরিক্ত প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো: ছাইদুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমি কোন প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। আমার কোন অবৈধ সম্পদ নেই। যা কিছু প্রচার করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত।
নদী খননে ১৩৮ কোটি টাকা লোপাট:
বিআইডব্লিউটিএর প্রকৌশলীদের দায়মুক্তি দিতে মরিয়া দুদক!
বিশেষ প্রতিবেদক
খনন হয়নি নদী। যেখানকার মাটি রয়েছে সেখানেই। উপরন্তু বালু ও পলির প্রলেপে ভরাট হয়ে গেছে নদীর পেট। স্থানীয় কৃষিজীবীদের উপকার হয়নি এক রত্তি। অথচ ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বরাদ্দের টাকায় উদরপূর্তি হয়েছে প্রকৌশলী ঠিকাদার ও বালুদস্যদের। নিজেরাই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ হওয়া ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। আর বৃহৎ এই দুর্নীতি সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি দিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মকর্তারা মরিয়া।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নেত্রকোণার কংস ও ভোগাই নদীর ১৫৫ কিলোমিটার খনন প্রকল্প হাতে নেয়। ম্যাকানিজম করে এ কার্যাদেশ পায় ৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। বসুন্ধরা ইনফ্রাস্টাকচার ডেভলপমেন্ট লি:, সোনালী ড্রেজার লি:, বিডিএল-এসআরডিসি (জেবি), এস এস রহমান, মাতৃবাংলা (জেবি) ও নবারুন ট্রেডার্স লি:। টেন্ডারের অনুযায়ী, নদী দু’টির প্রশস্থ ৮০ থেকে ১০০ ফুট। শর্ত ছিল, ড্রেজিংয়ের পর গভীরতা অনুসারে শঙ্ক মৌসুমে নদীতে ৮ থেকে ১০ ফুট পানি থাকতে হবে।
অভ্যন্তরীণ নৌ-পথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (১ম পর্যায়ে ২৪টি নৌ-পথ) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ভোগাই এবং কংস নদীর মোহনগঞ্জ থেকে নালিতাবাড়ি পর্যন্ত নৌপথ খনন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গঠিত ড্রেজিং ব্যবস্থাপনা কমিটির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো নদীর খনন কার্যক্রম ভাগ করে নেয় ৫টি পয়েন্টে। প্রতিষ্ঠানগুলো নদী থেকে ১ কোটি ঘনমিটার বালু উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে। কাগজ-কলমে সেই কাজ ‘শেষ’ ও হয়েছে। ঠিকাদাররা পেয়ে গেছেন সমুদয় বিল। কিন্তু যেমন নদী তেমনই রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও হয়েছে আগের চেয়ে বেশি ভরাট। ড্রেজিংয়ের নামে ভয়াবহ এই দুর্নীতির কোনো তল খুঁজে পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ভোগাই-কংস নদী খনন প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী বিআইডব্লিটিএ’র নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) আবু বকর সিদ্দিক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) দিদার এ আলমের বিরুদ্ধে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। তাতে নদী খনন না করেই বরাদ্দকৃত ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য ছিল। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের (সজেকা)’র উপ-পরিচালক মো: আবুল হোসেন এবং একজন উপ-সহকারী কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি টিম মাঠে নামে। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। তাতে অভিযোগের অধিকাংশ তথ্যেরই সত্যতা মেলে।
প্রথমত : দুর্নীতির প্রথম দফায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ড্রেজিং এস্টিমেট ধরা হয়। দ্বিতীয় দফায়: দরপত্র অনুযায়ী, ড্রেজার দিয়ে খনন, এস্কেভেটরের সাহায্যে খনন এবং কোদাল দিয়ে মাটি স্থানান্তরের পৃথক ৩ ধরনের কার্যাদেশ ছিল। বাস্তবে এস্কেভেটর দিয়ে খননের প্রমাণ মেলেনি। বর্ষার পানি নেমে গেলে খননস্থলে ৮/১০ গভীর পানি থাকা দূরের কথা-বিভিন্ন জায়গায় জমেছে পলির স্তর। যাতে প্রতীয়মান হয়, কোনো ধরনের খনন কাজই হয়নি। অর্থাৎ কোনো ধরনের খনন না করেই পরস্পর যোগসাজশে তুলে নেয়া হয়েছে বরাদ্দের অর্থ।
তথ্য মতে, বিআইডব্লিটিএ’র কার্যাদেশ পাওয়া মাত্র স্থানীয় বালুদস্যুরা ভলগেট দিয়ে কংস ও ভোগাই নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে লেগে যায়। এ বালু বিক্রির মাধ্যমে পকেটস্থ করে কোটি কোটি টাকা। এর ভাগ পান বিআইডব্লিটিএ’র সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এ হিসেবে, নদী খননে বরাদ্দকৃত কোনো অর্থই খরচ হওয়ার কথা নয়। অথচ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করে তুলে নিয়েছে বরাদ্দের অর্থ। এই অর্থ ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, বিআইডব্লিউটিএ’র মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে দুদক সূত্র জানায়, ভোগাই ও কংস নদ খননের নামে অর্থ আত্মসাতের অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রেকর্ডপত্র হস্তগত হয়েছে। প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, বিআইডব্লিটিএ’র মাঠপর্যায়ের প্রকৌশলী, দুই নির্বাহী প্রকৌশলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সর্বশেষ এটি খননের মাটি পরিমাপের পর্যায়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মতো পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ এখন দুদকের হাতে। কিন্তু অদৃশ্য ইশারায় চলছে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তি প্রদানের প্রস্তুতি। উদ্দেশ্য হাসিলে অবলম্বন করা হচ্ছে অভিনব কৌশল।
সূত্রটি জানায়, বিআইডব্লিউটিএ’র সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ সেক্টর ড্রেজিং বা খনন। ৫৩টি নৌপথের ড্রেজিং প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন করছে এ বিভাগ। ড্রেজিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো: ছাইদুর রহমান। বিআইডব্লিউটিএ ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের মাস্টারমাইন্ডও তিনি। ড্রেজিং বিভাগের দুর্নীতিমাত্রই সংশ্লিষ্টতা মেলে এই প্রকৌশলীর।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান দুদকের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা তার শুভাকাংক্ষী।তারাই তাকে শেল্টার দেন। এ কারণে চূড়ান্তভাবে তার বিরুদ্ধে দুদক কিছুই করবে নাÑ এমন আত্মবিশ্বাস থেকে দুর্নীতিতে তিনি বেপরোয়া। ছাইদুর রহমান, তার স্ত্রী শামিমা আক্তার, বিআইডব্লিটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) সিরাজুল ইসলাম ভুইয়ার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের ফাইলটি তিনি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন দীর্ঘদিন। মামলার যথেষ্ট উপকরণ হাতে আসা সত্ত্বেও দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরে কুণ্ঠিত। ‘অনুসন্ধান চলছে’, ‘সম্পদ বিবরণী এখনও যাচাই চলছে’Ñ এমন দাবি করার জন্য মাঝেমধ্যেই অনুসন্ধান কর্মকর্তারা ইস্যু করছেন চিঠি। অনুসন্ধানের নামে একের পর এক বদল হচ্ছেন কর্মকর্তা। ছাইদুর রহমান দম্পতির বিরুদ্ধে ৮ বছর ধরে পড়ে থাকা এই অনুসন্ধানের সঙ্গে এবার ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অনুসন্ধানটি একীভূত করে এখন প্রস্তুতি চলছে মূল বিষয়টি আড়াল করে দায়মুক্তির প্রক্রিয়া।
সূত্রমতে, ছাইদুর রহমান গংদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানটি পরিচালিত হচ্ছে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে। অন্যদিকে ১৩৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগটির অনুসন্ধান করছেন ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: আবুল হোসেনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি টিম। ঢাকার নথিটি অনুসন্ধান করছেন উপ-পরিচালক মো: আব্দুল মাজেদ। এর আগে উপ-পরিচালক জালালউদ্দিন আহমেদ, উপ-পরিচালক মো: সালাহউদ্দিন পর্যায়ক্রমে এটি অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তবে উভয় নথির সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো কর্মকর্তাই মুখ খুলতে রাজী হননি।
তবে সূত্র বলছে, ২০২০ সালে প্রকৌশলী মো: ছাইদুর রহমান, তার স্ত্রী শামিমা আক্তার, বিআইডব্লিটিএ’র উপ-পরিচালক (প্রশাসন) মো: সিরাজুল ইসলাম ভুইয়ার সম্পদ বিবরণী চাওয়া হয়। দুদক পরিচালক (বিশেষ) আক্তার হোসেন আজাদ তাদের সম্পদ বিবরণীর নোটিশ (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০১.০৪০.২০২০) দেন। এ প্রেক্ষিতে তারা সম্পদ বিবরণী দাখিলও করেন। তবে তিন বছরেও শেষ হয়নি সম্পদ বিবরণী যাচাই। এর মধ্যে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রকৌশলী ছাইদুর রহমানের কিছু রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। ওই বছর ১৬ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। কিন্তু দায়মুক্তি প্রদানের অদৃশ্য ইঙ্গিত থাকায় সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তাগন ছাইদুর রহমানের বেনামী সম্পদের বিষয়টি এড়িয়ে যান বলে জানা গেছে। প্রায় বিনা আপত্তিতে ‘গ্রহণ’ করে নিয়েছেন আয়কর নথিতে প্রদর্শিত সম্পদের অবিশ্বাস্য বিবরণী।
রেকর্ড বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান শুধু মিথ্যা তথ্যই দেননি। জীবিত পিতাকে ‘মৃত’ দেখিয়ে নিজেকে উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদের মালিক দাবি করেছেন। ২০১৭ সালে পিতাকে ‘মৃত’ দাবি করা হলেও তিনি মাত্র কয়েক মাস আগে ইন্তেকাল করেছেন বলে জানা যায়। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পিতা জীবিত থাকতে সন্তান পিতার সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক-এমনটি দেখাতেই তিনি এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেন বলে জানা গেছে।
২০১৬-২০১৭ সালে দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ন (টিআইএন নং-৬১৯৪৬১৫৭১২৬৩, সার্কেল-৩৬, করাঞ্চল-০২) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মো: ছাইদুর রহমান পিতা-মৃত আনিছুর রহমান এবং মাতা মোসা: শামছুন নাহার, নিজের জন্ম তারিখ-১০/০৬/১৯৭৩ ইং সাল বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রামের বাড়ি কুড়িগ্রাম, বেনগাছা উপজেলার, ত্রিমোহিনী ইউনিয়ন, মুক্তারামপুর গ্রামে। ওই বছর আয়কর নথিতে তিনি বার্ষিক আয় ৭ লাখ ৯ হাজার ৩৮৮ টাকা দেখিয়েছেন। এ হিসেবে ৩১ হাজার ৯৬৮ টাকা কর পরিশোধ করেছেন। উতসে কর শোধ করেছেন ৫ হাজার টাকা। আয়কর নথিতে তিনি স্বর্ণ বিক্রির প্রমাণস্বরূপ তিনি ৩টি মানি রিসিপ্ট দেখিয়েছেন। একটি রসিদে স্বর্ণের বিক্রিয় দেখিয়েছেন ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৬৬ টাকা। একটি রসিদে দেখিয়েছেন, ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৯৫ টাকা। আরেকটি রসিদে দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৪ টাকা। দু’টি রসিদই ঢাকার ১৩/৪, চাঁদনী চক মার্কেটে অবস্থিত ‘বলাকা জুয়েলার্স’র। যদিও সরেজমিন অনুসন্ধানে ওই স্থানে এ নামে কোনো স্বর্ণালঙ্কার দোকানোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ প্রায় ৩৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকার আয়কর ফাঁকি দিতে তিনি দাখিল করেছেন স্বর্ণালঙ্কার বিক্রির ভুয়া রসিদ। গোপন করেছেন নিজের বেনামী সম্পদের তথ্য।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ২৫/বি, এম. ডব্লিউ মানামা হাইটস’র ৮ তলায় রয়েছেÑ১৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। একই এপার্টমেন্টে ছাইদুর রহমানের আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর ৫৫/৫৬ সিদ্ধেশ্বরীর ৪/এ, আমিনাবাদ হাউজিং এ রয়েছে বিশাল ফ্ল্যাট। এসব সম্পত্তি তিনি শ্বশুরের বলে প্রচার করেন। নিজ জেলা কুড়িগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড় রড-সিমেন্টের দোকানটি ছাইদুর রহমানের। এখানে রয়েছে অন্তত: ২০ কোটি টাকার বিনিয়োগ। দোকানটি পরিচালনা করেন তারই ভাই আব্দুল আলীম।এ ছাড়া কুড়িগ্রামের কাঠালবাড়ী বড়পুলপাড় গর্বোরদোলা গ্রামে মেসার্স এমটিআর ব্রিকস নামে রয়েছে একটি অটো ইট ভাটা। যার মুল্য শত কোটি টাকা। এটি পরিচালনা করেন তার ভাই এস এম তৌফিকুর রহমান।
নদী খনন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্পর্কে বক্তব্য নিতে বিআইডব্লিটিএ’র অতিরিক্ত প্রকৌশলী (ড্রেজিং) মো: ছাইদুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমি কোন প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতি করিনি। আমার কোন অবৈধ সম্পদ নেই। যা কিছু প্রচার করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত।