বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক আতিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সরকারের শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা।
বিশেষ প্রতিবেদক : বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক আতিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী সরকারের শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানার নানামুখী দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের খবরে চাউরে হয়েছে সচিবালয় ও পুলিশ প্রশাসনে। তারা দম্পতি যেমন দুর্নীতি করে অঢেল টাকা বানিয়েছেন, তেমনি কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাগিয়েছেন পদোন্নতি ও লোভনীয় পোস্টিং। কখন সরকারে কে আছে তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। নগদ টাকাই হলো তাদের শক্তির চাবিকাঠি। ঠিক যেনে রূপকথার গল্প।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, ১৯৬৬ সালে রংপুর জেলায় জন্ম নেয়া মো. আতিকুল ইসলাম বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করেন ১২তম বিসিএসে ১৯৯১ সালের জানুয়ারীতে। ৩ দশকের চাকরী জীবনে সকল সরকারের সময় সুবিধাভোগ করেছেন, কখনই রাজনৈতিক গ্যাড়াকলে পড়তে হয়নি তাকে। ২০০৩ সালে বিএনপি আমলে কট্টর জামায়াতি এসপি হিসাবে প্রাইজ পোস্টিং দোর্দন্ড প্রতাপে গাজীপুরের এসপি হিসাবে এক টার্ম পূর্ণ করেছেন। গাজীপুর তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া হিসাবে দ্রত বিকাশমান ছিল।
দুই হাতে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা থেকে হাজার কোটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে তার তৎকালীন সহকর্মীদের অনুমান। নামে বেনামে কিনেঝেস শত শত বিঘা জমি। বিএনপি আমল শেষ হলে সেই সময়ে পুলিশ অফিসারদের পরবর্তী আওয়ামীলীগ সরকারে ভাগ্যপতন হলেও কেবল আতিকুল ইসলামের সৌভাগ্যের চাকা চলতেই থাকে। আর এর মূল চালিকা শক্তি হলো নগদ নারায়ণ। খেতেও পারেন, খাওয়াতেও সমান দক্ষ!
প্রবেশনার পিরিয়ড শেষ হতে না হতেই ১৯৯৪ সালে বিএনপি আমলে সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ঢোকেন, তারপরে ডিএমপির বিভিন্ন পদ এবং পুলিশ স্টাফ কলেজ মিলিয়ে ২০০৪ সাল অবধি ঘুরে ফিরে ঢাকায় কাটান। এরপরে পুলিশ সুপার সিআইডি এবং গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপারের পদটি বাগিয়ে নেন।
২০১০ সালে পদোন্নতি পেয়ে এআইজি, ২০১২ সালে অতিরিক্ত ডিআইজি, ২০১৪ সালে ডিআইজি (এইচআর) হিসেবে পুলিশ হোডকোয়াটার্সে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে, ২০১৬ সালে ডিআইজি হাইওয়ে এবং ২০১৯ সালে নৌ পুলিশের ডিআইজি এবং ২০২১ সালে অতিরিক্ত আইজিপি পদোন্নতি নিয়ে নৌপুলিশের মজাই লুটতে থাকেন।
২০০৯ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতার বদল হলেও গাজীপুর থেকে কামাই করা শত শত কোটি টাকার অংশবিশেষ ব্যয় করে আতিকুল ইসলাম মিশে যান আওয়ামী বলয়ে। সম্পূর্ণ ভোল পাল্টে হয়ে যান বড় আওয়ামীলীগার।
এর পর দ্রততার সাথে এডিশনাল ডিআইজি, ডিআইজি এবং বর্তমানে পুলিশের এডিশনাল আইজি। আগামীতে আতিকুল আইজিপি হলেও অবাক হবার কিছু থাকবে না। জামাত থেকে ভোল পাল্টে বড় আওয়ামীলীগ হতে তাকে দিতে হয়েছে বেশী বেশী সার্ভিস এবং ক্যাশ। এজন্য অতি আগ্রহী হয়ে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ধরে ধরে গ্রেফতার, গুম, ক্রসফায়ার, নৈশ ভোটের ইলেকশন সবই করেছেন আতিকুল ইসলাম!
স্বামী আতিকুলের সাথে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে পিছিয়ে নেই স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা, বর্তমানে সরকারের শিল্প সচিব। ১০ম বিসিএসে ১৯৯১র ডিসেম্বর মাসে বিসিএস প্রশাসনে যোগ দিয়ে সারাটা জীবন ঢাকা বা তার আশেপাশেই কাটিয়েছেন।
জাকিয়া সুলতানার দূর্নীতির হাতেখড়ি একেবারে চাকুরীর শুরুর দিকে। স্বামী আতিকুল ইসলাম এর দূর্নীতির রেসে জাকিয়া সুলতানা সমান তালে এগিয়ে যান। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ সহ বিভিন্ন লোভলীয় পোস্টিং দুই হাতে কামিয়েছেন। সেই টাকার একাংশ ঘুষ দিয়ে আবার বিভিন্ন সময়ে বাগিয়ে নিয়েছেন মহিলা ও শিশু, স্থানীয় সরকার, পরিবেশ, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে লোভনীয় পোস্টিং। ঢাকার বাইরের পোস্টিংগুলো জাকিয়া সুলতানার জন্য নয়। ঢাকার বাইরের পোস্টিংয়ে যাবে তেলবাজ নয় এমন মেধাবী বা লবিং না করা আওয়ামী অফিসাররা!
আতিকুল-জাকিয়ার দূর্নীতির খতিয়ান : গাজীপুরের এসপি থাকাকালে শত শত কোটি টাকা কামাই করে তা ইনভেস্ট করে পদোন্নতি নেন এডিশনাল ডিআইজি, তারপর ডিআইজি নৌ পুলিশ, এবং অতঃপর অতিরিক্ত আইজিপি। নৌপুলিশের ডিআইজি পদে থেকে আতিকুল ইসলাম গাজীপুর শালনাতে ২৫০ বিঘা জমি কিনে নেন। এই জমি কিনতে গিয়ে ডিআইজি আতিকুল ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে কম দামে হাসিল করেছেন।
নৌপুলিশের এমন কোন খাত নেই যেখান থেকে আতিক টাকা কামাই করেনি- মাছ ধরার নৌকা, কারেন্ট জাল পাতা, নৌপুলিশের অফিস নির্মান, নৌপুলিশের বাড়ী ভাড়া নেয়া, জলযান ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় সহ কি নেই তার দুর্নীতির সীমায়।
নৌপুলিশে মধুর ভান্ডার আতিক ভুলতে পারে না। তাই তো এডিশনাল আইজিপি হয়েও বেআইনিভাবে তদবীর করে আবার ফিরে আসেন ডিমোশন পদে, তথা এডিশনাল আইজিপি হয়েও কাজ করছেন ডিআইজি পদমর্যাদার পদে।
এডিশনাল আইজিপি হতে গিয়ে আতিকুল ইসলাম ঘটায় বহুবিধ ঘটনা। নগদ ১০ কোটি টাকা এবং ৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক পার্টনারশিপে আটকে ফেলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ ও স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিনকে।
মন্ত্রী পর্যায় সহ সব মিলিয়ে প্রায় শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অতিরিক্ত আইজিপি পদটি বাগিয়ে নেন আতিকুল। পদোন্নতি পেয়ে অন্যত্রে বদলী হয়েও গত কয়েক মাস ধরে নৌপুলিশ প্রধান হয়ে চেয়ার ধরে রাখেন যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
অবৈধ কারেন্ট জালের মালিকদের একপক্ষকে সুবিধা দিয়ে অন্য পক্ষকে অসুবিধা সৃষ্টি করেন আতিকুল ইসলাম। ইন্সপেক্টর কবীরকে দিয়ে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর ফাঁড়ি থেকে প্রতিমাসে ৫-৮ কোটি টাকা মাসোহারা তুলে নেন।
স্ত্রী জাকিয়াকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন স্বামী আতিকুল। অনেক মেধাবীদের বাদ দিতে ১৪৫ সিরিয়ালের জাকিয়া সুলতানা যখন সচিব পদে পদোন্নতি পান প্রশাসনের অনেকেই চমকে উঠেছেন। পোস্টিং পান শিল্প সচিব হিসাবে। এখানেও আছে কামাইয়ের বিশাল ক্ষেত্র।
ডিপার্টমেন্টের জন্য পুরানা লঞ্চ ক্রয় করে রং করে বেশি দাম দেখিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাবেক নৌপুলিশ প্রধান আতিক। বিভিন্ন জেলায় নৌ পুলিশের টহল দলে কম তেল ব্যবহার করে সেই টাকার ভাগও নেন আতিকুল ইসলাম।
স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত পরিবারের একজন সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আতিকুল ইসলামকে তার অপকর্মে সহায়তা করে আরেক পল্টিবাজ অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলাম যার বাড়ী বগুড়া।
গুলশান পুলিশ প্লাজাতে এডিশনাল আইজিপি আতিকুল ও তার স্ত্রী জাকিয়ার স্বনামে-বেনামে প্রায় ১৪টি দোকান আছে।
দূর্নীতি লুটপাটের টাকায় ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়াতে নির্মাণ করা তার নিজের বাড়ীকে শ্বশুড় বাড়ী পরিচয় দিয়ে নৌপুলিশের ঢাকার অফিস বানিয়েছেন আতিকুল। ইতিপুর্বে তিনি নিজেও এই বাড়ীটি তার ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করতেন।
মাছধরা জেলেদের কাছ থেকে ট্রলার নৌকা জব্দ করে, ভাল ট্রলার নৌকা বিক্রি করে দিয়ে টাকা আত্মস্যাৎ করেন আতিকুলের নির্দেশে তার লোকজন। এই নিয়ে একবার প্রথম আলো পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়।
সচিব জাকিয়া সুলতানার আগ্রহে শিল্প মন্ত্রনালয়ের কাজের বড় বড় টেন্ডারের ডিল করে স্বামী আতিকের ঘনিষ্ট এক বন্ধুকে দিয়ে।
আতিকুল ইসলামের অন্যতম কৌশল হলো নতুন কোনো আইজিপি হলেই তাকে বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে কিনে ফেলা, এরপরে তাকে আর পিছু তাকাতে হয় না, নিচের দিক থেকে বেড়ে যায় রেট। এভাবে লেনদেন আর কামাইর বদৌলতে আতিকুলের সম্পদের পাহাড় এখন পর্বতে রূপ নিয়েছে।
ঢাকায় অসংখ্য ফ্ল্যাট, বাড়ী দোকান, ঢাকা ও গাজীপুরে শত শত বিঘা জমিতেই তা সীমাবদ্ধ নয়, আছে সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ী। স্ত্রী জাকিয়া সুলতানার এক ভাগিনা আতিকের ৩ বন্ধুর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের একাউন্টে পাচার করেছেন কোটি কোটি ডলার। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম সুবিধায় এক বন্ধুর নামে বাড়ী কিনেছেন আতিক।
আতিকুলের পিতা ছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী একজন বিহারী এবং তারা মা ছিলেন রংপুর সদরের একজন নার্স। অন্যদিকে নাটোরের সিংড়া উপজেলায় জাকিয়া সুলতানার জন্ম। যেখানে উত্তরবঙ্গের লোকেরা একটু আলাভোলা হয়, তাছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী পরিবার হওয়ায় আওয়ামী আমলে আতিকুলের থাকার কথা ছিল চাপে পদোন্নতি ও পোস্টিং না পাওয়া, সেখানে কেবল টাকার শক্তি দিয়ে সবকিছু পার করতে সফল হয়েছেন আতিকুল ইসলাম। পুলিশ ও প্রশাসন সার্ভিসে আতিক-জাকিয়া দম্পতির মত দূর্নীতি, লুটতরাজ, সব আমলে সুবিধাভোগী, পল্টিবাজীতে চ্যাম্পিয়ান পরিবারের কোনো উদাহরণ আর নেই।
তবে ৫ আগষ্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতন হলে সচিব জাকিয়া মুলতানার স্বামী অতি: আইজিপি আতিকুলকে পুলিশের চাকুরী থেকে বাধ্যতামূলক অবসা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা এখনো শিল্প মন্ত্রণালয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। (চলবে)