বিশেষ প্রতিবেদন : সম্প্রতি মায়ানমারের নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকার (NUG) এক বিবৃতিতে জানায়, সামরিক শাসন প্রত্যাখ্যান ও ফেডারেল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা আরাকান আর্মির (AA) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই অব্যাহত রাখবে। এতে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির সাফল্য শুধু রাখাইন অঞ্চলের জনগণের বিজয় নয়, বরং সামরিক কাউন্সিলের বিরুদ্ধে লড়াইরত মিয়ানমারের বাকি প্রতিরোধশক্তির জন্যও এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
আরাকান আর্মির সাম্প্রতিক সাফল্য : ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, বিশেষত ২০ ডিসেম্বর, আন (আম) শহরের কাছে অবস্থিত পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সদর দপ্তর (নপখ) সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেয় আরাকান আর্মি। এনইউজি গভীর সন্তোষ প্রকাশ করে জানায়, এই বিজয় সামরিক কাউন্সিলের পতনকে ত্বরান্বিত করবে। আন শহরের পাশাপাশি মংডু, বুথিডং, রাথেডং, পউন্নাগ্যুন, পুণ্ণাগ্যুন, কিয়াউকতাউ, ম্রাউক-উ, মিনব্যা, মেয়েপুন, পাউকতাউ, ইয়াম্ব্রে, থানদোয়ে, টাউনগুক–এমন অন্তত ১৪টি বৃহত্তর শহর ও পলেটও এলাকাও এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া গওয়া (গুই) দখলের জন্যও তারা অভিযান চালাচ্ছে।
এদিকে ‘১০২৭ সশস্ত্র অভিযান’-এর অংশ হিসেবে আরাকান আর্মি ও তাদের মিত্র শক্তিগুলো (যেমন New Society Army (NSA), People’s Liberation Army (PIA), Students Armed Forces, PRA-Magway ইত্যাদি) সামরিক কাউন্সিলের ওপর একযোগে চাপ বাড়াচ্ছে। গত বছরের নভেম্বরে মংডু-আঙুমাও সড়কে অবস্থিত রকেট লঞ্চার ও সীমান্ত ফাঁড়ি দখল, ডিসেম্বরের গোড়ায় মংডুর ৫ নম্বর সীমান্তরক্ষী পুলিশের ঘাঁটি দখল, এ সবই AA-র সাম্প্রতিক সাফল্যের অংশ।
সিটুওয়ে ঘিরে জান্তাবাহিনীর প্রতিরক্ষা বলয় : সামরিক কর্তৃপক্ষ এখন সিটুওয়ে শহরে (সিট্তে নামেও পরিচিত) সর্বোচ্চ শক্তি কেন্দ্রীভূত করছে। এখানে রয়েছে সামরিক প্রশাসনিক সদর দপ্তর, রাজ্যের সামরিক পরিষদ কার্যালয়, পদাতিক রেজিমেন্ট—যেমন ২০ নম্বর, ২৩২ নম্বর, ২৭০ নম্বর, ৩৪৪ নম্বর, ৩৫৪ নম্বর, ৩৭৩ নম্বর—সহ একাধিক বিশেষ ইউনিট। পাশাপাশি আছে ৯০৮ নম্বর সশস্ত্র প্রকৌশল রেজিমেন্ট, ৮১৮ নম্বর যোগাযোগ রেজিমেন্ট, ৮২৮ নম্বর লজিস্টিক ও পরিবহন রেজিমেন্ট, ৮ নম্বর সামরিক চিকিৎসা রেজিমেন্ট, ৯ নম্বর বিদ্যুৎ ও শিল্প প্রকৌশল রেজিমেন্ট, ৮৬৮ নম্বর রক্ষী বাহিনী চৌকি, ৪ নম্বর যোগাযোগ ওয়ার্কশপ, ৯৬২ নম্বর নির্মাণ প্রকৌশল শাখা, ৪৩৪ নম্বর সামরিক অস্ত্রসংরক্ষণ শাখা এবং ১০ নম্বর শিক্ষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
সিটুওয়েতে ১৭ নম্বর সামরিক হাসপাতাল (১০০ শয্যা), ২ নম্বর সামরিক নিরাপত্তা রিজার্ভ ইউনিট, ১২ নম্বর পুলিশ রেজিমেন্ট, ৩৬ নম্বর পুলিশ রেজিমেন্ট ও নৌবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিও রয়েছে। সিটুওয়ের চারপাশে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে জান্তাবাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। পরিখা, স্থলমাইন, জলমাইন পেতে শহরকে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি নদীপথ ও সমুদ্রপথে সর্বক্ষণিক টহল জোরদার করা হয়েছে।
নৌপথ ও বিমান হামলার আশঙ্কা : সিটুওয়ে শহরের নদী ও সমুদ্রপথ ঘিরে তিন নম্বর কৌশলগত নৌবহরকে (৩ স্ট্র্যাটেজিক নেভাল ফ্লোটিলা) শক্তিশালী করা হয়েছে। এখানে একজন উচ্চপদস্থ কমান্ডারের নেতৃত্বে পঞ্চাশজন অফিসার ও তিন শতাধিক নৌসেনা মোতায়েন আছে। রসদ ও যুদ্ধসরঞ্জাম সরবরাহের জন্য প্রায় পঁয়ত্রিশটি ছোট-বড় রণতরী ও জলযান সক্রিয় রাখা হয়েছে। সিটুওয়েকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে নৌবাহিনীর পাশাপাশি বিমানবাহিনীরও সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী আশঙ্কা করছে, আরাকান আর্মি সিটুওয়ে সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তাই আগাম পাল্টা অভিযানে নেমেছে জান্তাবাহিনী, যাতে আক্রমণকারী বাহিনী শহরের উপকণ্ঠেই বাধার সম্মুখীন হয়। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুসারে, পাউকতাউ, পুণ্ণাগ্যুন, বুথিডং ও রাথেডং এলাকায় সামরিক বাহিনীর নিয়মিত গোলাবর্ষণ চলছে। একই সঙ্গে বিমান থেকে গোলাবর্ষণ ও ড্রোন পর্যবেক্ষণও বেড়ে গেছে।
ডিভাইড এন্ড রুল নীতি ও অপপ্রচার : সামরিক কাউন্সিল ও তাদের মিত্র লবিস্ট চ্যানেলগুলোতে ক্রমাগত “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। রাখাইনের ভেতরে রোহিঙ্গা, চিন ও অন্য নৃগোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টির ফেক নিউজ ও অপপ্রচার চলছে। কোথাও বলা হচ্ছে, আরাকান আর্মি জোরপূর্বক লোক সংগ্রহ করছে; কোথাও বলা হচ্ছে, স্থানীয়দের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। আবার এনইউজি বা অন্যান্য পিডিএফ (PDF) বাহিনীর মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।
ইয়াঙ্গুন-মান্ডালেসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরে রাখাইন ও চিন জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের চলাচলে বাধা দেওয়া, গাড়ির টিকিট না দেওয়া বা সন্দেহজনকভাবে আটক করার ঘটনাও ঘটছে। সামরিক পন্থী টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, “রাখাইনে বিমান হামলা জোরদার করতে হবে” বা “ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধার করতে রোহিঙ্গা-বিশ্বকেও উস্কে দিতে হবে”—এ ধরনের অপপ্রচার চলছে।
মানবিক সংকট ও যুদ্ধের প্রভাব : রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সামরিক বাহিনী যখনই এলাকা ছাড়ছে, তখনই সেখানকার সড়ক ও জনপদে বিপুল পরিমাণ ল্যান্ডমাইন পেতে রেখে যাচ্ছে। মানুষ খাবার ও ওষুধের সন্ধানে বের হলেও মাইন বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছে। অন্যদিকে অবরোধের কারণে পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত, ফলে খাদ্য ও ওষুধের সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থা জানিয়েছে, আনুষ্ঠানিক সাহায্য পৌঁছানোও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সদ্য দখলমুক্ত শহরগুলোয় গোলাবর্ষণে ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। থানদোয়ে এলাকায় বিমান হামলায় সাধারণ মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সামরিক বাহিনী এমনভাবে হামলা চালাচ্ছে, যাতে মানুষ একদিকে আতঙ্কে পালাতে বাধ্য হয় এবং অন্যদিকে আরাকান আর্মিও পুরোদমে সংগঠিত হতে না পারে।
যুদ্ধাপেক্ষা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা : আরাকান আর্মি এখন পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক সদর দপ্তর (নপখ), আন শহরের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি, মংডুর ৫ নম্বর সীমান্তরক্ষী বাহিনী, থানদোয়ের ৫ নম্বর সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা সদর দপ্তর, এমনকি কিছু নৌবাহিনী প্রশিক্ষণ শিবির ও জলযান দখল করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সিটুওয়ের মতো আরো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে হামলার প্রস্তুতি নিতে আরাকান আর্মি আগের অপারেশনগুলো থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
স্থানীয় মানুষরা সাধারণত আরাকান আর্মিকেই সমর্থন দিচ্ছেন, কারণ সামরিক সরকার দীর্ঘদিন ধরে দমনপীড়ন ও বৈষম্যমূলক রাজনীতি চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপরীতে সামরিক বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ছে, বাহিনীর অনেক সদস্য পলায়নের চেষ্টা করছে, এমন খবরও ভেসে আসছে। সামরিক শিবিরের পক্ষে কাজ করে এমন টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে সৈন্যদের উজ্জীবিত রাখতে বা পালানো ঠেকাতে ব্যর্থভাবে চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে।
সামগ্রিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রাখাইনে সামরিক সরকারের পতন ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। সিটুওয়েকে ঘিরে রাখার চেষ্টা করেও সামরিক বাহিনীর পক্ষে পুরো রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। আরাকান আর্মি ও এনইউজি-সহ অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর একযোগে তৎপরতা, সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতির ব্যর্থতা—সবমিলিয়ে রেখাঙ্কিত করছে যে রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতি সামরিক শাসনের অন্তিম কফিনে পেরেক ঠুকে দিতেও সক্ষম হতে পারে।
(তথ্য সুত্র ও ছবি : ইনফো বাংলা)