রিজার্ভ চুরি সিন্ডিকেটের সদস্যদের ‘রক্ষাকবচ’ ছিলেন পতিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী 

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় প্রশাসনিক সংবাদ বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক  :  আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয় হ্যাকাররা। আর্থিক খাতে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সাইবার চুরির ঘটনা তাৎক্ষণিক ধামাচাপা দিয়ে রাখে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রায় এক মাস পর রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে দেশজুড়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। রিজার্ভের অর্থ চুরির ঠিক ৩৯ দিন পর ঢাকার মতিঝিল থানায় একটি মামলা হয়।


বিজ্ঞাপন

মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ করা হয়, তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তপশিলভুক্ত অপরাধ। দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ অন্য কোনো সংস্থার তদন্ত করার এখতিয়ার না থাকলেও আইনবহির্ভূতভাবে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। তদন্ত করতে গিয়ে সংস্থাটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানসহ অন্তত ১৩ জন কর্মকর্তাকে মূলহোতা হিসেবে শনাক্তও করে। তবে এই মূলহোতাদের নাম মামলার অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিতে সিআইডিকে তখন চাপ দিয়েছিলেন তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো গণমাধ্যম কে  এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।


বিজ্ঞাপন

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুইফট সিস্টেমে ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয় ফিলিপাইনের রিজল কমার্শিয়াল ব্যাংকে। পরে ওই অর্থ স্থানীয় মুদ্রা পেসোর আকারে চলে যায় তিনটি ক্যাসিনোয়। এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করে ফিলিপাইন সরকার বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার আর পাওয়া যায়নি।

রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি বাংলাদেশ ব্যাংক পরদিনই জানতে পারলেও তা গোপন রাখে এবং ৩৩তম দিনে বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীকে জানায়। ৩৯ দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের উপপরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অর্থ রূপান্তর, চুরি, আত্মসাৎ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সহায়তা বা প্ররোচনা, জালিয়াতি (আরসিবিসির বিরুদ্ধে), জালিয়াতিতে সহায়তা বা প্ররোচনাসহ বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়। এরপর ওই মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সিআইডির তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানসহ অন্তত ১৩ কর্মকর্তার গাফিলতি ও যোগসাজশের বিষয়টি উঠে আসে। ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যেই ফিলিপাইন, ভারত ও বাংলাদেশ থেকে জড়িত অপরাধীদের নিয়ে তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে পায় সিআইডি। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ কর্মকর্তাসহ জড়িতদের আসামি করে অভিযোগপত্র তৈরি করে সিআইডি। তবে সেই অভিযোগপত্র দীর্ঘ পাঁচ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।

ওই সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভ চুরির মামলাটি নিয়ে সিআইডি কার্যক্রম শুরু করলে তদন্ত প্রতিবেদন পাল্টে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরসহ ওই ১৩ কর্মকর্তা তৎপর হন। এরপর তাদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সিআইডিকে চাপ দেন। বিষয়টি নিয়ে সাবেক এ দুই মন্ত্রী তখন সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একাধিক বৈঠকও করেন। তবে মূলহোতাদের নাম বাদ দিতে তখন রাজি হননি সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা। এমনই এক বৈঠক থেকে তদন্ত কর্মকর্তাদের ধমক দিয়ে বেরও করে দিয়েছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এরপর মামলার গুরুত্বপূর্ণ ফরেনসিক প্রতিবেদন আইনবহির্ভূতভাবে নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযুক্ত ওই কর্মকর্তাদের হাতে। যে কারণে তদন্ত কার্যক্রম শেষ হওয়ার প্রায় চার বছর পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিআইডির তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার নাম আসে তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান, একজন নির্বাহী পরিচালক, একজন মহাব্যবস্থাপক, তিনজন উপপরিচালক, চারজন যুগ্ম পরিচালক এবং উপমহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের তিনজন কর্মকর্তা। এদের মধ্যে দুজন এরই মধ্যে অবসরে গেছেন। কয়েকজন পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঠিক ৩৮ দিন আগে রহস্যজনকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিলিপাইনের পরামর্শক এডিসন জভেল্লানোস মরদেহ পাওয়া যায় ম্যানিলার একটি সড়কে। তবে সে সময় বিষয়টিকে ফিলিপাইনি কোম্পানি বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করলেও সেটি প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে সেটিকে ‘টপ সিক্রেট’ ক্যাটাগরিতে ফেলে প্রকাশ না করার দায় সারেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তারা।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা রিজার্ভ চুরির সঙ্গে যেসব বিদেশি নাগরিককে সন্দেহ করছেন তাদের মধ্যে এডিসন জভেল্লানোস অন্যতম। কেন্দ্রীয় বাংক সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের আওতায় ইআরপি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের এপ্রিলে স্পেনের ইন্দ্রা সিস্টেমাসের সঙ্গে চুক্তি হয়। একই প্রকল্পের আওতায় ডেটা ওয়্যারহাউস স্থাপনের জন্য চুক্তি হয় ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে।

ইন্দ্রা সিস্টেমাসের সঙ্গে চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়ন করে ফিলিপাইনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্দ্রা ফিলিপাইন। ইআরপি ও ডেটা ওয়্যারহাউস বাস্তবায়নে বাংলাদেশ থেকে মানবসম্পদ সংগ্রহে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ইন্দ্রা ফিলিপাইন। তবে অ্যাগ্রিয়ার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ওই কর্মীদের পরে নিজস্ব কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয় ইন্দ্রা ফিলিপাইন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালে ফিলিপাইনের তিন নাগরিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কাজ করেছেন। এর মধ্যে প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে ছিলেন এডিসন জভেল্লানোস।

বিধিবহির্ভূতভাবে মামলা তদন্ত করে সিআইডি: আলোচিত এই মামলা পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত করানো হলেও আইন অনুযায়ী মামলাটি তদন্ত করার এখতিয়ারই নেই সংস্থাটির।

মামলার এজাহারে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে এবং রিজার্ভ চুরির ঘটনায় যেসব কর্মকর্তার দ্বারা যে ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা দুর্নীতি দমন কমিশনের তপশিলভুক্ত অপরাধ। ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুযায়ী, ‘ব্যাংক কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, নিরীক্ষক, অবসায়ক, ম্যানেজার এবং অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী পেনাল কোড-১৮৬০ অনুযায়ী ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ হিসেবে গণ্য হবে।

সে হিসেবে রিজার্ভ চুরির ঘটনা দুদক আইনের ধারা-৫(২) অপরাধমূলক অসদাচরণ, ধারা-১০৯-এ সংঘটিত অপরাধে যোগসাজশ বা সহায়তা করা; ধারা ২১৭, অপরাধীকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে বা কোনো সম্পত্তিকে বাজেয়াপ্ত থেকে বাঁচাতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক আইনের নির্দেশ অমান্যকরণ; ধারা-২১৮, অপরাধীকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে সরকারি কর্মচারী কর্তৃক ভুল কাগজপত্র বা দলিলাদি তৈরি করা; ধারা-৪০৯-এ অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ ছাড়া মামলার এজাহারে অর্থ রূপান্তরের কথা বলা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং আইনেও দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আর দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ অনুসন্ধান বা তদন্ত করার এখতিয়ার অন্য কোনো সংস্থার নেই।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ২০(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের অধীন ও উহার তপশিলে বর্ণিত অপরাধসমূহ কেবলমাত্র দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনুসন্ধানযোগ্য বা তদন্তযোগ্য হইবে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ হলেও মামলাটি তদন্ত করার সুযোগ দেওয়া হয়নি দুর্নীতি দমন কমিশনকে। কারণ, দুর্নীতি দমন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। অন্যদিকে, সিআইডি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেক্ষেত্রে সরকারের জন্য দুদকের চেয়ে সিআইডিকে প্রভাবিত করা বেশি সহজ। যে কারণে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে মামলাটি সিআইডিকে দিয়ে তদন্ত করানো হয়। এরপর নিজেদের ইচ্ছামতো প্রতিবেদন দিতে সিআইডিকে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিগত সময়ে রিজার্ভ চুরির মামলাটি তদন্ত করার সুযোগ না পেলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকেই আলোচিত এই মামলাটি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের গোয়েন্দা শাখা। এরই মধ্যে এই মামলা সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া এই মামলা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণমাধ্যম কে  বলেন, ‘এই ধরনের অপরাধ নিয়ে সব সময় কাজ করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এই ধরনের কাজে দুদকের কর্মকর্তারা যে কোনো সংস্থার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। তাই এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্ত করতে দেওয়া হলে তারা সন্তোষজনক ফল আনতে পারবেন না। এ ছাড়া এটি দুদকের তপশিলভুক্ত অপরাধ।

এই মামলা অন্য কোনো সংস্থা তদন্ত করলে সেই প্রতিবেদন আদালতে টিকবে না। বিষয়টি জেনেশুনেই মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতে সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর তদন্ত যত বেশি সময়ক্ষেপণ হবে, মামলার আলামত তত নষ্ট হবে। ফলে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে সুকৌশলে অপরাধীদের বাঁচানোর অপচেষ্টা।’


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *