টেন্ডার ছাড়াই রসিকের কোটি টাকার সংস্কার কাজ : নগর ভবনে দুদকের অভিযান

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত গ্রাম বাংলার খবর জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন রাজশাহী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিনিধি (রাজশাহী) :  ক্ষতিগ্রস্ত রাজশাহী নগর ভবন (রাসিক) সংস্কারে কোনো প্রকার টেন্ডার ছাড়াই এক বিএনপি নেতাকে দিয়ে কোটি টাকার কাজ করাচ্ছে সিটি করপোরেশন। রাসিকের প্রকৌশল শাখা এ সংস্কার কাজের বিস্তারিত কোনো নথিপত্রও তৈরি করেনি। এ অনিয়মের সংবাদ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় গত ৩০ ডিসেম্বর প্রকাশের পর গত বৃহস্পতিবার রাসিকের প্রকৌশল শাখায় ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।


বিজ্ঞাপন

দুদক টিম চলমান সংস্কার কাজ সরেজমিন দেখতে পেলেও রাসিকের প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তারা ঠিকাদার নিয়োগ বা টেন্ডার সংক্রান্ত কোনো নথিপত্র দেখাতে পারেননি। এমনকি রাসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন দুদক টিমকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখেও কোনো কাগজপত্র সরবরাহ করতে পারেননি।


বিজ্ঞাপন

এদিকে নগর ভবনে দুদকের টিম হানা দেওয়ার খবরে রাজশাহীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তা কর্মচারীদের কেউ কেউ বলেছেন গত ৫ আগস্টের আগে টেন্ডার করে পছন্দের ঠিকাদারকে সব কাজ দেওয়া হতো। এখন কেন টেন্ডার ছাড়াই সব কাজ করা হচ্ছে বিশেষ একটি দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে। রাজশাহী নগর ভবন হয়ে উঠেছে অনিয়মের আখড়া। নির্বাচিত পরিষদ না থাকায় সরকারি কর্মকর্তারা এসব অনিয়ম দুর্নীতি খতিয়ে দেখছেন না।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার সকালে দুদকের সমন্বিত রাজশাহী জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম নগর ভবনে এই অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানিক দলে আরও ছিলেন দুদকের আরেক সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ সিদ্দীক এবং উপ-সহকারী পরিচালক মাহবুবুর রহমান।

অভিযান শেষে দুদক টিম জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত নগর ভবনের সংস্কার কাজ ইতোমধ্যে অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ কাজের ঠিকাদার নির্বাচন সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সিটি করপোরেশন। আবার যেসব কাগজ দিয়েছেন তার একটি যাচাইয়ের জন্য ঠিকাদারের মোবাইল নম্বর হিসেবে উল্লেখ থাকা নম্বরটিতে ফোন করে দুদক জানতে পেরেছে, নম্বরটি কোনো ঠিকাদারের নয়। ওই নম্বরটি চাঁদপুর জেলার কোনো এক ব্যক্তির। এই কাজের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ভুয়া এই নম্বরটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখছে দুদক।

রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই রাজশাহী নগর ভবনে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়। নগর ভবনে অগ্নিসংযোগের পর পরবর্তী দুই দিন পর্যন্ত চলে অবাধে লুটপাট। এতে নগর ভবনের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯ টাকা। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত নগর ভবন সংস্কার কাজ শুরু করা হয়। অভিযোগ উঠেছে কোনো নিয়ম-নীতি অনুসরণ ছাড়াই সংস্কার কাজগুলো করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার দুদকের অভিযানিক দল রাসিকের প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কোন নিয়মে কিভাবে এসব সংস্কার কাজ করা হচ্ছে? জবাবে রাসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী দুদক টিমকে বলেছেন, জরুরিভিত্তিতে কাজ করার প্রয়োজনে যাকে পাওয়া গেছে তাকে দিয়েই করানো হচ্ছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দুদক টিমের সদস্যরা।

অন্যদিকে নগর ভবন সংস্কারে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ উঠার ফলে গত ৩০ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ‘রাজশাহী সিটি করপোরেশন, টেন্ডার ছাড়াই কাজ করছেন বিএনপি নেতা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। সংবাদটি দুদকের নজরে আসে। এরপরই বৃহস্পতিবার দুদক টিম নগর ভবনে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেন।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক ও নগরীর দড়িখড়বোনা এলাকার বিএনপি নেতা ইয়াহিয়া খান মিলু সিংহভাগ সংস্কার কাজ করছেন। ইতোমধ্যে নগর ভবনের রঙ করার কাজ শেষ হয়েছে। লাগানো হয়েছে নতুন গ্লাস। এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে মেয়রের দপ্তর সংস্কার করা হচ্ছে। তবে এসব কাজের কোন টেন্ডার হয়নি। ‘কোটেশন পদ্ধতিতে’ কাজ করার কথা রাসিকের পক্ষ থেকে বলা হলেও এ সংক্রান্ত কাগজপত্রই তারা দুদকের অভিযানিক দলকে সরবরাহ করতে পারেনি। মোট ঠিক কত টাকার কাজ হচ্ছে সেটাও হিসাব করে দুদক টিমকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে রাসিকের প্রকৌশল শাখা।

দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, দুদক কর্মকর্তারা অভিযানে গেলে দীর্ঘ সময় তাদের রাসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে বসিয়ে রাখা হয়। পরে বিল পরিশোধ হয়ে গেছে এমন তিনটি সংস্কার কাজের কাগজপত্র হস্তান্তর করা দুদক দলকে। তবে চলমান সাতটি কাজের কোনো কাগজপত্রই সরবরাহ করতে পারেননি রাসিকের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তর। টেন্ডার কার্যাদেশ ছাড়াই ঠিকাদার কিভাবে এসব কাজ করানো হচ্ছে তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযান শেষে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, তারা ফরিদা ইয়াসিমন, মাইসা এন্টারপ্রাইজ এবং শাহরিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাগজ পেয়েছেন। মাইসা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ইয়াহিয়া খান মিলু। শাহরিন এন্টারপ্রাইজের কাগজপত্রে স্বত্বাধিকারী হিসেবে এমএম মাহফুজুর রহমান নাম লেখা আছে। তবে মোবাইল নম্বরে ফোন করে দেখা গেছে, নম্বরটি তার নয়। চাঁদপুরের এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেছেন, তিনি ঠিকাদার নন। তিনি রাজশাহীতে কখনো যাননি।

এদিকে শাহরিন এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪০ টাকার কাজ সম্পন্ন করেছে।

এই কাজের কাগজ জাল বলে মনে করে দুদক কর্মকর্তা আমির হোসাইন বলেন, যারা কাজ করছেন বলে রাসিক দাবি করছে আসলে তারা একই ব্যক্তি। স্বামী-স্ত্রীর আলাদা আলাদা নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দেখিয়েছেন। এসব গুরুতর অনিয়ম।

দুদক কর্মকর্তা আরও বলেন, কাগজ দেওয়ার জন্য আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা বসিয়ে রাখা হয়েছে; কিন্তু মাত্র তিনটা ফাইল তারা আমাদের দিয়েছেন। আমরা ধারণা করছি আমাদের বসিয়ে রেখে তড়িঘড়ি করে এসব কাগজপত্র তৈরি করা হয়েছে। আর আমরা ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এখনো সাতটা কাজ চলমান আছে; কিন্তু এই সাতটা কাজের কোনো কাগজপত্র নেই। কাজগুলো ইতোমধ্যে অর্ধেক হয়ে গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদকের অভিযানিক টিমের প্রধান।

দুদকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন বলেন, আমরা নিয়ম মেনেই কাজ করছি। টেন্ডার করা হয়নি কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাজগুলো জরুরিভিত্তিতে করা হচ্ছে। এজন্য যাকে পাওয়া গেছে তাকে দিয়েই করানো হচ্ছে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *