গ্রামমুখী রাজধানীবাসী

জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী সারাদেশ স্বাস্থ্য

*এ যেন অচেনা এক ঢাকা
*ভিড় নেই বাস কাউন্টারে

 

এম এ স্বপন : শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি দাপ্তরিক কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়ায়, এখন অনেকটাই গ্রামমুখী রাজধানীবাসী। ফলে, গণপরিবহন থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের পরিবহনের গন্তব্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাস বা লঞ্চ টার্মিনাল। ফলে, জনবহুল এলাকাগুলো অনেকটাই ফাঁকা।
দুপুর ১২টা। রাজধানীর মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে রেলগেট সংলগ্ন স্টপেজে এক তরুণ বাস হেলপার উচ্চস্বরে ‘এই আসেন, আসেন…যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ গুলিস্তান, সিট খালি সিট খালি’ বলে ডাকাডাকি করছিলেন। মিনিট দুয়েক ডাকাডাকি করে মাত্র একজন যাত্রী উঠিয়ে বাসটি স্টপেজ ছেড়ে চলে গেল। একইভাবে পরপর কয়েকটি বাস কয়েক মিনিট করে অপেক্ষা করেও যাত্রী না পেয়ে প্রায় যাত্রীশূন্য বাস নিয়ে চলে গেল।
শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে রয়েছে মানুষের ভিড়। দৈনন্দিন প্রয়োজনেই ভিড়। কাঁচাবাজারে আসা নগরবাসী যত দ্রুত পারছেন ফিরে যাচ্ছেন ঘরে। অনেক বছর ধরে ব্যস্ততম এই ফার্মগেট মোড়ে দোকান করছেন তিনি। এই অবস্থাকে অনেকটা ঈদের মতো ফাঁকা মনে হচ্ছে তার কাছে। পার্থক্য হচ্ছে, রাস্তায় ছুটে চলা মানুষের মনে উৎসব নয়, করোনা আতঙ্ক।
গণপরিবহন, রিক্সা বা মোটর সাইকেল, সবগুলোতেই যাত্রী কম। মূলত: এখানে যাত্রীরা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না। তার বেশিরভাই ছুটছেন বাসস্ট্যান্ড বা লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে, কারণ সবাই আসলে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে পা বাড়াচ্ছে।
বাসস্ট্যান্ডে আসা যাত্রীদের চোখে এখন তাড়াহুড়ো আর করোনা আতঙ্ক। ভয় থেকেই ঢাকা ছাড়ছেন অধিকাংশ মানুষ।
নগর নাকি গ্রাম। কোনটা নিরাপদ সেই উত্তর হয়তো দেবে ভবিষ্যৎ। সব প্রতিকূলতা জয় করে মেগাসিটি ঢাকা আবার ফিরে পাক তার নিজস্বতা।
একেতো সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার, তারওপর উচ্চমাত্রার ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে প্রায় সব ধরনের গণপরিবহনে যাত্রী সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। শুধু গণপরিবহনে নয়, রাজধানীর রাস্তাঘাটেও মানুষের উপস্থিতি কমে গেছে। যারা এই রাস্তায় বেরিয়েছেন তাদের অনেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরে বেরিয়েছেন। রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত বিভিন্ন সড়ক ঘুরে প্রায় সব ধরনের গণপরিবহনে যাত্রী সংকট দেখা যায়।
রাজধানীর মিরপুর থেকে বাস যোগে আজিমপুরে আসেন মিরপুরের বাসিন্দা ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, অন্যান্য সময় বাসে সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু আজ চিত্র ছিল একদম ব্যতিক্রম। আনুমানিক ৩৫/৪০ আসনের বাসে সর্বসাকুল্যে যাত্রীসংখ্যা ছিল ১০/১২ জন। তাছাড়া সকালে আসার সময় রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতিও কম দেখতে পান।
রাজধানীর লালবাগের বাসিন্দা আবুল হোসেন জানান, চিরচেনা ঢাকা শহর কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও মানুষের উপস্থিতি দেখতে পাননি। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই গোটা এলাকা প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংক্রমিত হওয়ার আগে দেশে এখন পর্যন্ত ১৭ জন আক্রান্ত এবং ১ জন মারা গেছেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫ হাজার প্রবাসী ১৪ দিনের হোম কোয়ারান্টিনে রয়েছেন। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গণপরিবহন পরিহার করার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্প্রতি যারা বিদেশ থেকে ফিরেছেন বা তাদের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের গণপরিবহন পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তাদের ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টিনে থাকতে অনুরোধ করেছেন।
যাত্রীর ভিড় নেই বাস কাউন্টারে : বৈশ্বিকভাবে এখন বড় সমস্যার নাম করোনাভাইরাস। মরণঘাতি এ ভাইরাস দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে। বাদ যায়নি বাংলাদেশও। দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা। এ অবস্থায় দেশে গণপরিবহনে যাত্রী কমেছে।
আগামী এক সপ্তাহ করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিভাগ। দেশে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় প্রয়োজনে বাস চলাচল বন্ধ করা হবে বলেও জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। যদিও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে গণপরিবহন বিশেষ করে বাসে চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই ব্যবহারসহ বেশ কিছু বিষয় মেনে চলতে যাত্রী সাধারণ ও গণপরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা গত ১৬ মার্চ নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে কারও জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা হলে গণপরিবহন ব্যবহার না করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, গণপরিবহনে চলাফেরার ক্ষেত্রে আমরা অনুরোধ করবো, যাদের মধ্যে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেবে না, কিন্তু জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা হয়েছে, তারাও গণপরিবহন ব্যবহার করবেন না। এটা অনেকটা গণজমায়েতের মতোই। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গণপরিবহনে চলাচল সীমিত করা উচিত।
আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, যারা গাড়ির চালক ও হেলপার রয়েছেন, তারাও এ ক্ষেত্রে সচেতন থাকুন। তাদের মধ্যে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে তারা যেন সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন এবং যেন গণপরিবহন ব্যবহার না করেন, না চালান। আমরা যদি গণপরিবহনের ক্ষেত্রে এ দুটি পরামর্শ মেনে চলি, তাহলে গণপরিবহন থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ সীমিত হবে।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী ও কল্যাণপুরের বাস কাউন্টারে ভিড় নেই। অধিকাংশ কাউন্টারই বলতে গেলে ফাঁকা। যদিও গণপরিবহন চলাচল বন্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা জারি করা হয়নি।
হানিফ পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মোশারফ হোসেন বলেন, বাস চলাচল বন্ধ হয়নি তবে যাত্রী কমেছে।
তিনি বলেন, গত ১৬ মার্চ বিকেল থেকে ১৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত বাস কাউন্টারে অনেক ভিড় ছিল। ১৭ মার্চ ছুটির কারণে অনেকে বাড়ি গেছেন। এখন ফিরতি যাত্রীদের ভিড় বাড়তে পারে তবে ঢাকা থেকে বিভিন্ন জেলায় যাবার যাত্রী নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, করোনার কারণে আতঙ্ক আছে, সতর্কতাও জরুরি। বাসের চালক সহকারীসহ যাত্রীদের সুরক্ষার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে বাস চলাচল করবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বাস পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আন্তঃজেলা বাস সার্ভিসের প্রতিটি বাসে হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়েছে, সঙ্গে টিস্যু পেপারও রাখা আছে। যেসব যাত্রী গাড়িতে উঠবে তারা আগে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করবে।
প্রতিটি বাসের সিট জীবাণুমুক্ত রাখতে যতটুকু পরিষ্কার রাখা যায়, ততটুকু ব্যবস্থা করা হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় বাস বন্ধ রাখার, তাহলে আমরা বন্ধ করে দেব।
এনা পরিবহনের মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ আরও বলেন, রাজশাহীতে করোনা আতঙ্কের কারণে কিছু চিকিৎসক সুরক্ষার দাবি জানিয়ে কর্মবিরতিতে গেছেন। সেই আতঙ্কে রাজশাহী থেকে বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয় শ্রমিকরা। তবে সেখানে কথা বলেছি। বাস চলাচলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, করোনায় সতর্কতা ও সাবধানতাই বেশি জরুরি। করোনা মোকাবিলায় যদি গণপরিবহন বন্ধ করতে হয়, সেই নির্দেশনা সরকার দিলে অবশ্যই বন্ধ করবো। গতকালও মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা হয়েছে। এখনো তেমন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ৪০ শতাংশ যাত্রী কমেছে। কমাই স্বাভাবিক। নিয়মের মধ্যে অনেকে হোম কোয়ারান্টাইন মেনে চলার কারণে গণপরিবহনে চলাচল কমেছে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *