ত্রিপুরার অন্যতম তীর্থস্থানের  মাতাই পুখিরিতে তিনদিনব্যাপি তীর্থ মেলায় পূর্ণার্থীদের উপচেপড়া ভিড়

Uncategorized ইতিহাস ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার খবর চট্টগ্রাম জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন সংগঠন সংবাদ সারাদেশ

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি  :  সমগ্র ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের অন্যতম তীর্থস্থান মাতাই পুখিরি’র তিনদিনব্যাপি তীর্থমেলা শুভ উদ্বোধন করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরা এবং এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান। সোমবার(১৩এপ্রিল) সকালে খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার মাইসছড়ির নুনছড়ি থেকে পায়ে হেঁটে উঁচু-নিচু পথ পেরিয়ে পাহাড়ের উপরে মাতাই পুখিরি এর তীর্থমেলার উদ্বোধন করেন তিনি। এ তীর্থ মেলাটি ত্রিপুরা হারি বৈসু থেকে শুরু হয়ে বৈসুমা ও বিসিকাতাল মোট তিনদিন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়


বিজ্ঞাপন

পুকুরেই হাজার হাজার পূর্ণার্থী গোসল করে পবিত্র হয়ে পূজা ও ফুল অর্পন করেন পূর্ণার্থীরা।


বিজ্ঞাপন

ত্রিপুরাদের ধারণা, স্থানীয় ব্যক্তিদের আশীর্বাদস্বরূপ দেবতা নিজে এ পুকুর করে দিয়েছেন। তাদের মতে, এ পুকুরে গোসল করলে মনোবাসনা পূরণ হবে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ওপর এই পুকুরের অবস্থান। প্রতিবছর বৈসুকে এখানে তীর্থ মেলা বসে। খাগড়াছড়ি-মহালছড়ি সড়ক থেকে প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার গেলে মাইসছড়ি। এই মাইসছড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলে নুনছড়ি গ্রাম। এই নুনছড়ি গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথ বেয়ে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই দেবতা পুকুর। এ পুকুরের স্বচ্ছ স্থির জলরাশি পূর্ণার্থী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে প্রশান্তি জোগাচ্ছেন।
এমনটা আপনার কাছে কল্পনা হলেও পাহাড়ি জনপদ বাস্তবতা। উঁচু পাহাড়ে পানি জমানো দুষ্কর, কষ্টসাধ্য এবং ব্যয় সাপেক্ষে হলেও পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ সৃষ্টির মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের নজির থাকলেও দেবতা পুকুর’ সেসব থেকে ব্যতিক্রম। পৃথিবীর অনেক আশ্চর্য্যের মধ্যে আপনার কাছে ‘দেবতা পুকুর’ হতে পারে এক ধরনের আশ্চর্য। এখানে বৈসু উপলক্ষে ৩দিনব্যাপি নানান ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ নানান ধরনের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ণার্থীরা তাদের মনোবাসনা পূরণের জন্য প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই পুকুরে গোসল করে,কবুতর উড়িয়ে ও ফুল বিসর্জন দিয়ে প্রার্থনা পারিবার,সমাজ ও দেশের জন্য মঙ্গল কামনা করে থাকে।


বিজ্ঞাপন

দেবতা পুকুর’ রূপকথার দেবতার আশির্বাদের মতোই স্রোতহীন সঞ্চার। পাহাড়ের চূড়ায় এ পুকুরটির স্বচ্ছ জলরাশি মনভোলা প্রশান্তি মুহূর্তের মধ্যে ধর্মপ্রাণ মানুষের উদাসীন করে তুলতে পারে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর খাগড়াছড়ি-মহালছড়ির সড়কে ১১ কিলোমিটার দক্ষিণে মূল সড়ক থেকে ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে নুনছড়ি মৌজার পর্বতশ্রেণী থেকে সৃষ্ট ছোট্ট নদী থলিপাড়ার মাতাই পুখিরি। থলিপাড়ার সমতল ভূমি থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট উপরে পাহাড়ের চূড়ায় ‘মাতাই পুখিরি(দেবতা পুকুর’।

জানা যায়,সবুজ অরণ্যবেষ্টিত দেবতার পুকুরের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার ফুট এবং গড় প্রস্থ ৬০০ ফুটের মতো। সময়ের ব্যবধানে ‘দেবতা পুকুর’ স্থানীয় ত্রিপুরাদের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে বেশি পরিচিত। এটাকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরা তাদের পবিত্র তীর্থস্থানও বলে থাকে। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে দেবতা পুকুরে বসে তীর্থ মেলা এবং তান্ত্রিক বিধান মতে ত্রিপুরারা বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে থাকে।

পাহাড়ের পাদদেশ ১ হাজার ৩৮৬টি সিঁড়ি বেয়ে দেবতা পুকুরে পৌঁছাতে হয়। সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ৪৫মিনিটের পথ পেরুলেই দেখা মিলবে স্বপ্নের দেবতা পুকুর। সিঁড়ি নির্মাণের আগে প্রায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লাগতো দেবতা পুকুরে পৌঁছাতে।

ত্রিপুরা জনঅধ্যুষিত এলাকায় এর অবস্থান বলে এটি ত্রিপুরা ভাষায় ‘মাতাই পুখির’ নামেই অধিক পরিচিত। মাতাই অর্থ ‘দেবতা’ আর পুখির অর্থ ‘পুকুর’। পুকুরের চারিদিকে ঘন সবুজ অরণ্য যেন সৌন্দর্যের দেবতা বর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাতাই পুখিরিতে আসা পূর্ণার্থীরা জানান,আমরা প্রতি বছর এ তীর্থমেলায় আসি। পুরাতন বছরের সমস্ক দুঃখ-কষ্ট,গ্লানি দূর করে নতুন বছরে যেন নতুনভাবে জীবন যাপন করতে পারি। সেজন্য এই পুকুরে ফুল দিয়ে প্রার্থনা করে থাকি এবং জগতের সকল জীবের কল্যানের জন্য প্রার্থনা করে থাকি

মাতাই পুখিরি তীর্থমেলা উদযাপন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নবলেশ্বর ত্রিপুরা(লায়ন) বলেন,প্রতি বছর মাতাই পুখিরি তীর্থমেলা অনুষ্ঠিত। এ তীর্থমেলায় ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি চাকমা,মারমা বাঙ্গালিসহ বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের লোকজন চলে আসেন এবং মেলা উপভোগ ও প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পুকুর দর্শন করেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মো. আমান হাসান বলেন,মাতাই পুখিরি ত্রিপুরাদের একটা তীর্থস্থান। আমার মনে হয় যেকোন সম্প্রদায়ের সাথে যদি মিশতে চাই,ওদের সম্পর্কে জানতে চাই,তাহলে ওদের রীতি-নীতি পালন গুলো দেখতে হবে,জানতে হবে। এজন্য এখানে আসা। বিশেষ এখানে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের তীর্থ মেলা চলছে।এখানে এসে আমরা অনেক লোকের মিলনমেলা দেখলাম। এখানে না আসলে আমরা জানতেই পারতাম না যে এখানে এত লোকের সমাগম হবে। আমার আইডিয়া ছিলোনা যে এত লোকের সমাগম হবে। এমন একটা অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করতে পেরে নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করছি।

জানা যায়,স্থানীয় বাসিন্দাদের জলতৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বয়ং জলদেবতা এ পুকুর খনন করেছেন। দেবতা পুকুরের পানি কখনোই শুকায়না। পুকুরের পানিকে স্থানীয় ত্রিপুরা সম্প্রদায়েরা দেবতার আর্শীবাদ বলে মনে করেন। দেবতা পুকুর দেবতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পুকুরের তলদেশে গুপ্তধন লুকায়িত আছে যা দেবতারা পাহাড়া দিচ্ছে। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ছাড়াও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের হাজারো নারী-পুরুষ-শিশু দেবতা পুকুর দর্শনে হাজির হয়।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *