মোঃ আরিফুল ইসলাম মুরাদ : দীর্ঘ দু’শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন আর পাকিস্তানী শাসন-শোষণের লড়াই-সংগ্রামের পরিণতিতে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতাকে সাধারণ জনগণের জন্য অর্থবহ করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সংবিধানে একটি শক্তিশালী, গতিশীল ও সমন্বিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে রচিত সংবিধান আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিক নির্দেশনাও দেয়।

যদিও বারবার গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হওয়ার কারনে সেই স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা হোঁচট খেতে থাকে, যার ছায়া পড়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল স্তরে। সেখানে জনঅংশগ্রহণের পরিবর্তে আমলতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, অপচয়, দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, কখনো কখনো ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতাই প্রাধান্য পেতে থাকে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে।

বহুমুখী হস্তক্ষেপের কারণে ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলা পরিষদ জেলা পরিষদ পৌরসভা সিটি কর্পোরেশন বর্তমানে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট সাংবিধানিক অঙ্গিকার থাকা সত্ত্বেও, পুরো ব্যবস্থাই আজ প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয় এবং এর পরিনামও ভয়াবহ হতে বাধ্য। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্র কায়েম হয় না, এর জন্য সকল প্রশাসনিক একাংশ বা স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন কায়েম হওয়া আবশ্যক। আবশ্যক ‘গ্রাসরুট ডেমোক্রেসি’ বা তৃণমূলের গণতন্ত্র।
প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমেই তা সম্ভব। এছাড়াও সর্বস্তরে প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া একমাত্র নির্বাচিত সংসদকেন্দ্রীক ব্যবস্থাকে ‘খুটিহীন’ গণতন্ত্র বলা চলে, আর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, খুটিহীণ গণতন্ত্র টিকে থাকে না। আমাদের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। জনগণের দোরগোড়ার সরকার হিসেবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহনের মাধ্যমে তারা এ ক্ষমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে।
আমরা জানি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৯,১১,৫৯,৬০, অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবেই প্রত্যেক প্রশাসনিক এককগুলোতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুত ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা রাখবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্রমাগতভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের করণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঠিকভাবে তাদের দয়িত্ব পালন করতে পারছে না। ফলে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারন মানুষ, ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা নেতৃত্ব সৃষ্টির সূতিকাগার। বলা বাহুল্য যে, অতীতে সর্বস্তরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সৃষ্টি না করার কারণে আজ আমাদের দেশে সকল স্তরে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন নেতৃত্বেও ব্যাপক শূন্যতা বিরাজ করছে। দুর্ভাগ্যবশত জাতিকে আজ এর মাশুল গুণতে হচ্ছে।
এ মুহূর্তে মেয়াদোত্তীর্ণ স্থাণীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্বাচন না হওয়ায় পরিষদগুলোর কার্যকারিতা ঝিমিয়ে পড়েছে। ফলে উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে স্থানীয় সাধারন জনগণ।
দুর্ভাগ্যবশত সংবিধানকে পদদলিত করে, আদালতের রায় উপেক্ষা করে এবং জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সাংসদের অন্যায় আবদার রক্ষার জন্য যে উপজেলা আইন পাশ করা হয়েছে, তা ভবিষ্যতে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো যে, অন্যায়, অনৈতিকতা ও অরাজকতার পরিণতি মঙ্গলকর হয় না। তবে এর পরিণতি শুধু ক্ষমতাসীন দলকেই নয়, সম্ভবত পুরো জাতিকেই ভবিষ্যতে গুণতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের অণ্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সুফল সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হলে স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়িত করার কোনো বিকল্প নেই। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি তাই আর্থিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা প্রয়োজন।
এ প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় এককগুলোর কাছে আর্থিক যোগানসহ যথাযথ দায়িত্ব ও কৃর্তৃত্ব হস্তান্তর করার মাধ্যমেই দেশের সকল জনগোষ্ঠী ও এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা সম্ভব। পাশাপাশি, স্থানীয় সকল কর্মকান্ডে জন অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থাও গ্রহন করা প্রয়োজন।
আর এসব কিছুর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে একটি গণতান্ত্রিক জাতীয় বিকেন্দ্রীকরন নীতিমালা প্রণয়ন করা এবং সে আলোকে স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
এ প্রেক্ষিতে প্রস্তাবনা : ১।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের তফসিলের সাথে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তফসিল একই সাথে ঘোষণা করা।
২। কেন্দ্রীভূত আমলা প্রশাসনকে আরো গণমুখী করা। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনের সর্বস্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব চালু করা
৩। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
৪। স্থানীয় সরকারকে সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা । বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত ছাড়া স্থানীয় সরকার পরিষদ বাতিল বা নির্বাচিত জন প্রতিনিধিকে বরখাস্ত না করার বিধান চালু করা। স্থানীয় সরকারের উপর আমলা কর্তৃত্বের অবসান, স্থানীয় সরকারের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং এমপিদের তদারকি বন্ধ করে স্বাধীন ও স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা।
৫। স্থানীয় পর্যায়ে পুলিশসহ প্রশাসনকে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্বে সুবিন্যাস্থ করা।
৬। স্থানীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, কর ধার্য ও আদায়ের সকল দায়িত্ব সরকারকে প্রদান করা। জাতীয় রাজস্ব আয়ের ৪০ ভাগ স্থানীয় সরকারকে প্রদান করা। জাতীয় বাজেটের উন্নয়ন খাতের জেলা ও উপজেলা ওয়ারী আলাদাভাবে প্রকাশ করা।
স্থানীয় সরকার কর্তৃক গৃহিত উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাংক কর্তৃক অর্থায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়ণ করা।
৭। স্থানীয় সরকারের শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। নির্বাচিত নারী প্রতিনিধির দ্বায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারন করা।
৮। জেলা পরিষদ আইন যুগোপযোগী করে তা যত দ্রুত সম্ভব কার্যকর করা।
৯। উপজেলা পরিষদের আইন পর্যালোচনা করে, সংবিধানের আলোকে অন্যান্য স্থানীয় সরকার স্তরের আইনের সাথে সংগতি রেখে মাননীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করার বিধান রেখে যত দ্রুত সম্ভব উপজেলা পরিষদ কার্যকর করা।
১০। সিটি কর্পোরেশন গুলোকে নগর সরকার হিসেবে গড়ে তোলার বিধান কার্যকর করা।
১১। পৌরসভার বাৎসরিক আয়-ব্যয়ের হিসাব, বার্ষিক পরিকল্পনা ও এন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বিবেচনা করে বার্ষিক বরাদ্দ নির্ধারন করা।
১২। পার্বত্য ও সমতলের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক জয় ব্যবস্থাকে স্থানীয় সরকার কাঠোমোর প্রক্রিয়ার সাথে সমন্বয় করা।
১৩। উপজেলা পরিষদ আইনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সেবা মূলক এর কার্যক্রমসমূহ (উপজেলা পরিষদে ১৪ টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৭ টি দপ্তর) অধিক কার্যকরী করার লক্ষ্যে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব উপজেলা পরিষদের নিকট প্রকৃত অর্থে ন্যস্ত করার বিধান কার্যকর করা।
১৪। ইউনিয়ন পরিষদ আইনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সেবামূলক ( ইউনিয়ন পরিষদে ৭টি মন্ত্রণালয়ের অধিনে ৯টি দপ্তর) অধিক – কার্যকরী করার লক্ষ্যে, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের নিকট প্রকৃত অর্থে ন্যস্ত করার বিধান কার্যকর করা।
১৫। স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্র পরিচালনার সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা।