নিজস্ব প্রতিনিধি (সিলেট) ; ঘুস দুর্নীতি লুটপাটের অভিযোগে দুদকে অভিযুক্ত সেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মফিজুরকে রংপুরে কাগজ পত্রে বদলি করা হলেও তিনি কৌশলে বহাল তবিয়্যতে রয়ে গেলেন সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরেই। অভিযুক্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নাম (ইউএনও) মফিজুর রহমানকে সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা থেকে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে বদলি (ন্যাস্ত) করা হয় গেল ২৪ মে।

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় মাঠ প্রশাসন শাখা-২ এর উপসচিব আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বিসিএস ৩৫তম ব্যাচের ওই কর্মকর্তাকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা থেকে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে ন্যাস্ত করা হয়। মঙ্গলবার অভিযুক্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মফিজুর রহমান নিজেও বদলি বিষয়টি স্বীকার করে বললেন, বিশ্বম্ভরপুরে নতুন ইউএনও যোগদানের পর উধ্বর্তন কতৃপক্ষের ছাড়পত্র দিলে রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করব। তাই আপাতত বিশ্বম্ভরপুর থেকে রংপুর যাওয়া হচ্ছেনা বলে জানান ইউএনও ।

প্রসঙ্গত ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইউএনও হিসাবে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় যোগদান করেন মফিজুর রহমান। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান বরাবর ওই উপজেলার সাধারণ নাগরিক হিসাবে অভিযোগ করেন শফিকুল ইসলাম, শাহীন আহমেদ, ওয়াদুদ, আতাউর রহমান টিপু, মো. জুবায়ের আহমেদ। অভিযোগকারীরা দুদকের চেয়ারম্যানের নিকট ইউএনওর নানা ঘুস, দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য সংযুক্ত করে লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন। এসব আবেদনের অনুলিপি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার বরাবর পাঠানো হয়েছে।

এরপর সংক্ষুদ্ধ উপজেলাবাসীর পক্ষে ওই ইউএনওকে ঘুসখোর দুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করে তার দ্রত প্রত্যাহার দাবি করে জেলা প্রশাসকের নিকট স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সাধারণ জনগণের পক্ষে দেওয়া অভিযোগে ইউএনওর ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব বিবরণী যুক্ত করা হয়েছে।
একই সঙ্গে বিগত সময়ে বিশ্বম্ভরপুরে ইউএনও মফিজুর রহমান নানা ঘুস, দুনীতি, সীমান্ত চোরাচালান, রাষ্ট্রীয় সম্পদ খনিজ বালি পাথর চুরির কান্ডে গোপন সহযোগিতা ছাড়াও নানামুখী অনিয়মের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগে দাবি করা হয়েছে।
দুদক এর চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও মফিজুর রহমানের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ডাচ বাংলা ব্যাংক, ব্রাঞ্চ কোড, ৬৭ লাখ ৩০ হাজার ৩৯১ টাকা গেল ১১ এপ্রিল পর্যন্ত জমা ছিল। ৫ আগস্টের পর তিনদিনের মধ্যে ইউএনওর হিসাবে লাখ লাখ টাকা জমা হওয়া অর্থের উৎস সন্দেহজনক দাবি করা হয়েছে অভিযোগে।
অভিযোগে আরোও উল্ল্যেখ করা হয়, গত ৫ আগস্টের পূর্বে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার সীমান্ত চোরাচালান প্রবণ এলাকা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে গোপন সমঝোতায় চোরাকারবারিদের মাধ্যমে ভারত থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে নিয়ে আসা চিনি, কসমেটিকস, মসলা, খাদ্য সামগ্রী, কাপড়, গবাদিপশু (গরু, মহিষ, উট) চোরাচালানের সঙ্গে ইউএনও মফিজুরের গোপন সম্পৃক্ততা ছিল।
উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা মাল্টিপারপাস সেন্টারে একটি পাঠাগার থাকার পরও বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ লুটপাটের জন্য কৌশলে উপজেলা নির্বাচন অফিসের পাশে আরো একটি পাঠাগার স্থাপন করা হয়।
প্রসঙ্গত, ইউএনওর ঘুস ও দুর্নীতির তদন্ত এবং তাকে অপসারণের দাবিতে সম্প্রতি উপজেলার কারেন্ট বাজারে উপজেলাবাসীর ব্যানারে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর ওই আন্দোলন প্রতিহত করতে ইউএনও ভাড়া করেছেন স্থানীয় সন্ত্রাসীদের। তারা যুবদল, সমন্বয়ক ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী পরিচয়ে সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেছেন।
এ ঘটনায় অন্ত ১০ জন আহত হয়েছেন। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বহুল আলোচিত ধোপাজান ও জাদুকাটা নদীতে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশকে অবৈধ বালু ব্যবসার সুযোগ দিয়েছেন ইউএনও। তারা ইউএনওকে লাখ-লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি নিজেরাও বিপুল অঙ্কের টাকা ভাগাভাগি করছেন।
অননুসন্ধানে জানা গেছে, মফিজুর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বম্বরপুর উপজেলায় যোগদান করেন । তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সাদিরচরে। সরকার পরিবর্তনের পর খোলস পালটে বিএনপি বলয়ের সঙ্গে মিশে গেছেন তিনি। এমনকি স্থানীয় সীমান্ত চোরাকারবারি, কালোবাজারি ও বালুখেকোদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ডাচবাংলা ব্যাংকে তার একটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকার বিবরণী যুগান্তরে কাছে এসেছে। এতে দেখা গেছে, প্রায় ৬৯ লাখ টাকা জমা হয়েছে এই কর্মকর্তার হিসাবে। একটি বিশেষ সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইউএনও মফিজুরের অবৈধ আয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মফিজুরের ব্যাংক হিসাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা গেছে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর পিরোজপুর সদরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকাবস্থায় বেসরকারি ওই ব্যাংকে হিসাবটি (নং ২৬৪১৫১০০১৫৬৩৭) খোলেন তিনি।
খোলার সময়ই সেখানে জমা করেন প্রায় ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এরপর গত ৮ আগস্ট জমা করেন ২০ লাখ টাকা। ৫ আগস্টের পর ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করায় একসঙ্গে ২০ লাখ টাকা জমা দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা। এ কারণে মোট ১১ বারে এই টাকা জমা দেওয়া হয়। সেখানে জমাকারী হিসাবে একটি মোবাইল নাম্বার উল্ল্যেখ রয়েছে।
জানা গেছে , মোবাইল নম্বরটি বিশ্বম্বরপুরের মো. আলাল উদ্দিন নামে একজনের। জানতে চাইলে আলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি ওই সময় বিশ্বম্ভরপুর ইউএনও অফিসে মাস্টাররোলে কাজ করছিলাম। ইউএনও স্যার ৮ আগস্ট আমাকে ২০ লাখ টাকা দিয়ে বলেছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপকের কাছে দিয়ে আসতে। আমি ওইদিন সকালে টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার আমার মোবাইল নাম্বারসহ নাম লিখে রাখেন। আমি শুধু ইউএনও স্যারের নির্দেশ পালন করেছি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বিগত সরকারের দোসর হিসাবে পরিচিত কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান , সীমান্ত চোরাকারবারি ও বালু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা ইউএনওকে মোটা অঙ্কের টাকা ভাগ দিতেন। সরকার পরিবর্তনের পর সীমান্ত চোরাচালান, অবৈধ বালু ব্যবসায় নিয়োজিত হয় বিএনপি পরিচয়ে কিছু লোক। তাদেরকে বগলদাবা করেছেন মফিজুর। এ ছাড়া বিগত সরকারের সময়ে উপজেলায় বরাদ্দ আসা টিআর-কাবিখাসহ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচির বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন।
ইউএনওর ঘুস কেলেঙ্কারি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মফিজুর তার বাসভবনের সামনে ৩০ লাখ টাকা খরচ করে অপ্রয়োজনীয় ডাইনিং রুম বানিয়েছেন। ৭ লাখ টাকায় পুকুর সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নির্মাণ করেছেন ঘাটলা। লাখ লাখ টাকায় ছোট ছোট কায়েকটি নৌকা কিনে পুকুরে ভাসিয়েছেন।
এ ছাড়া কাগজেকলমে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে দুটি কক্ষ বানিয়ে সরকারি তহবিলের অপচয় করেছেন। উপজেলা প্রশাসনের অভ্যন্তরে মাল্টিপারপাস সেন্টারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার থাকার পরও উপজেলা নির্বাচন অফিসের পাশে আরেকটি পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করে টাকা আত্মসাতের ক্ষেত্র তৈরি করেন। এসব প্রকল্পে দরপত্র প্রক্রিয়ায় ক্রুটি রয়েছে।
যে কারনে বিশ্বম্ভরপুর ছাড়তে নারাজ মফিজুর: ওই উপজেলার সংক্ষুদ্ধ নাগরিকরা জানান, হাওরের বেরীবাঁধ সহ, টিআর, কাবিকা, এডিপির বরাদ্ধে পুর্বে লুপাট, বিভিন্ন সরকারি বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে যেসব কাজে নয় ছয় করে ঘুস বাণিজ্য আদায় করেছেন সেসব কাজের বিপরীতে বকেয়া প্রাপ্তি এমনকি সামনে জুন ক্লোজিং থাকায় আরো ব্যাপক হারে লুপাট করতেই তিনি বদলির পরও বহাল তবিয়্যতে রয়ে গেলেন বিশ্বম্ভপুরেই।
মঙ্গলবার জানতে চাইলে বিশ্বম্বরপুরের ইউএনও মফিজুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। এসব অভিযোগ উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ দেখবেন বলেও জানান মফিজুর।