নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার হাতিরঝিলে বিয়ামে ফাউন্ডেশনে সমিতির এসি বিস্ফোরণে ঘটনায় হত্যা মামলার দুই কর্মচারীকে হত্যার রহস্য উদঘাটনসহ ঘটনার সাথে জড়িত ০২ আসামীকে গ্রেফতার করেছে পিবিআই এর স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন এন্ড অপারেশন ইউনিট (এসআইএন্ডও, অর্গানাইজড ক্রাইম-উত্তর),কল্যানপুর, ঢাকা। গ্রেফতারকৃত আসামীরা হলেন-১) বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম এবং তার ভাড়াটে সহযোগী মোঃ আশরাফুল ইসলাম। গত ২৫ জুলাই, তাদেরকে কুড়িগ্রাম ও ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাত্রি অনুমান ৩ টা ২০ মিনিটের সময় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যান বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর বিয়াম ভবনস্থ ৫০৪ নং কক্ষে প্রচন্ড শব্দসহ বিস্ফোরন ঘটে। বিস্ফোরনে ৫০৪ নং কক্ষে রক্ষিত সমিতির দলিলপত্রাদি, নামজারী সংক্রান্তে কাগজপত্রাদি, ব্যাংক হিসাব সমূহের চেক বহি, জমি ক্রয় সংক্রান্ত ০৪ টি চুক্তিপত্র, ইলেকট্রিক সামগ্রী, আসবাবপত্র কক্ষের এসি ইত্যাদি সহ অন্যান্য মালামাল পুড়ে ভস্মীভূত, চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। ঘটনার সময় অফিস সহায়ক মোঃ আব্দুল মালেক ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করে এবং সমিতির সেক্রেটারির গাড়ি চালক মোঃ ফারুক গুরুত্বরভাবে আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য জাতীয় বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড্রাইভার মোঃ ফারুক মৃত্যুবরণ করে।

এই ঘটনায় বিসিএস (প্রশাসন) কল্যান বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোঃ মশিউর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল (ডিএমপি) থানার মামলা নং-০৩(০৩)২৫, ধারা-৩২৬/৩০২/৩৩৬ /৪২৭/৩৪ পেনাল কোড দায়ের করেন। হাতিরঝিল থানা পুলিশ ২ মাস মামলাটি তদন্ত করেন।

থানা পুলিশের নিকট তদন্তাধীন অবস্থায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে গত ৬ মে, পিবিআই এসআইএন্ডও (উত্তর) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে এবং এসআই (নিঃ) জনাব মোহাম্মদ গোলাম মওলাকে তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

পিবিআই চীফ অতিরিক্ত আইজিপি মোঃ মোস্তফা কামাল এর সঠিক দিক নির্দেশনায় বিশেষ পুলিশ সুপার (এসআইএন্ডও)জনাব মোঃ আবদুর রহমান ও পিবিআই এসআইএন্ডও (উত্তর) এর ইউনিট ইনচার্জ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জনাব থোয়াইঅংপ্রু মারমা, বিপিএম-সেবা এর তত্ত্বাবধানে মামলাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য একাধিক বিশেষায়িত টিম গঠন করে।
বিশেষায়িত টিম মামলার ঘটনার তারিখ ও সময়ের সংগ্রহকৃত সিসিটিভি ফুটেজে বিশ্লেষণে জানতে পারেন চলতি বছরের ২৭ ফেবুয়ারী, দিবাগত রাত অনুমান ২ টা ৩০ মিনিটের সময় মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, পায়ে স্যান্ডেল পরিহিত অবস্থায় অনুমান ৩০-৩৫ বছর বয়সী এক সন্দেহভাজন যুবক বিয়াম ভবন মাঠের পশ্চিম দিক থেকে এসে সিড়ি দিয়ে ভবনের পঞ্চম তলায় চলে যায় এবং সিসিটিভি বন্ধ করে দেয়। পিবিআই এসআইএন্ডও (উত্তর) এর বিশেষায়িত টিম আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স এর মাধ্যমে আসামীর ছবি সনাক্ত করে।
তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই এসআইএন্ডও (উত্তর) এর একাধিক আভিযানিক টিম গত ২৫ জুলাই, আত্নগোপনে থাকা ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত আসামী মোঃ আশরাফুল ইসলাম (৩৬), পিতা-মোঃ আবু বকর সিদ্দিক, মাতা-মোছাঃ সাহেরা বানু, সাং-কাশীর খামার, থানা-উলিপুর, জেলা-কুড়িগ্রামকে একই থানার পশ্চিম কানুডাঙ্গা গ্রামের তার নিকটাত্মীয়ের বাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামী মোঃ আশরাফুল ইসলাম ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্যমতে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোঃ জাহিদুল ইসলাম (৩৮), পিতা-মোঃ আজাহার আলী, মাতা-হাওয়া বেগম, সাং-মাস্টারপাড়া, থানা-কুড়িগ্রাম সদর, জেলা-কুড়িগ্রামকে গত ২৫/০৭/২০২৫ খ্রিঃ তারিখে ঢাকার ভাটারায় তার বর্তমান বাসা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
পিবিআই এর জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ আশরাফুল ইসলাম জানায়, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম তার পূর্ব পরিচিত এবং এলাকার ভাই। জাহিদুল ইসলাম তাকে গত ০৫ আগস্ট ২০২৪ এর ২/৩ মাস আগে ঢাকায় এনে মগবাজার থ্রি-স্টার হোটেলে একটানা ৫/৬ মাস রাখে। জাহিদুল ইসলাম এর সূত্র ধরে সে প্রায়ই বিয়াম প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত করতো এবং ঐ অফিসের কয়েকজনের সাথে সু-সম্পর্ক তৈরী হয়।
সমিতির মূল নথিপত্র স্থায়ীভাবে ধ্বংসের লক্ষ্যে বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম জাহিদুল ইসলাম আসামী আশরাফুল, অফিস সহায়ক আঃ মালেক ও ড্রাইভার ফারুক মিলে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ শেষে তাদেরকে ১০/১২ লাখ টাকা দেয়ার মৌখিক চুক্তি করে। পরিকল্পনা মোতাবেক একদিন জাহিদ আশরাফূলকে কিছু টাকা দিয়ে বিয়ামের ৫ম তলার সিসি ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে।
জাহিদের দেওয়া টাকায় আশরাফুল মাস্ক, মাস্কিং ক্যাপ, হ্যান্ড গ্লাভস ও ফুল স্লীপ শার্ট জামা কিনেন। ঘটনার দিন আশরাফুল মাথায় মাস্কিং ক্যাপ, মুখে মাস্ক এবং হ্যান্ডগ্লাভস পরে বিয়াম ভবনের ৫ম তলায় উঠে ক্যামেরা বন্ধ করে দেয়।
ক্যামেরা বন্ধ করার পর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অফিস সহায়ক মালেক ও ড্রাইভার ফারুক ৪র্থ তলার ৫০৪ নং কক্ষে প্রবেশ করে। তখন আশরাফুল দরজার পাশে সিঁড়ির কোনায় দাঁড়িয়ে ছিল। ৫০৪ নং কক্ষে প্রবেশ করে ড্রাইভার মালেক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
আশরাফুল ৫ম তলা থেকে ৩য় তলা নামতেই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ হয়। ঘটনাস্থলেই অফিস সহায়ক আঃ মালেক মারা যায়। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসলে আশরাফুল কৌশলে হোটেল রুমে চলে যায়। জাহিদ গাড়ি নিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ড্রাইভার ফারুককে জাতীয় বার্ন ইউনিট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করায়।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় ড্রাইভার ফারুক মৃত্যুবরণ করলে জাহিদ তাকে ডেকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতে বলে। জাহিদের কথা মতো পরদিন সে রংপুর চলে যায়। এই কাজে আশরাফুলকে ১০/১২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও জাহিদ এখন পর্যন্ত তাকে ৬/৭ লাখ টাকা দিয়েছে।
গত ২৬ জুলাই, বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসামীরা হলেন, জাহিদুল ইসলাম এবং মোঃ আশরাফুল দ্বয়কে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হলে গ্রেফতারকৃত আসামীদের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে । মামলাটির তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে বিশেষ পুলিশ সুপার (এসআইএন্ডও) বলেন, “আমরা দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার এর মাধ্যমে আসামী সনাক্তপূর্বক, তথ্য-প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামী মোঃ আশরাফুল ইসলামকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামী মোঃ আশরাফুল ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকার করে এবং তার দেওয়া তথ্যমতে ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বিয়ামের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসামী জাহিদুল ইসলামকে সনাক্ত ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।
উভয়ে বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেছে। পিবিআই সদা সত্য উদঘাটনে বদ্ধ পরিকর। ন্যায় বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করছি। মামলার তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। ঘটনার সাথে আরও কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।