মোঃ হাবিবুর রহমান, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) : বাঁশ তিরপাল আর পলিথিন দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ছোট বড় অনেক দোকান। ওইসব দোকানে রয়েছে পুতুল, লেইস ফিতা, চুড়ি,চেইন, আংটি, ক্লিপ, ব্যাগ, সানগ্লাস, মেলামাইন সামগ্রী, কেরকেরি গাড়ি, বাঁশি, বল, বন্দুক, গাড়ি, মাটি ও কাঁঠের তৈরীসহ নানা প্রকারের জিনিস। ওইসব জিনিস বিক্রি করছেন নারী ও পুরুষ। প্রতিটি দোকানে রয়েছে ৪-৫ জন লোক। মালামাল ক্রয় বিক্রয় ও তৈরী সবই যেন তারাই করছেন।

এমন দৃশ্য চোখে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর শহরের খড়মপুর এলাকায়। এখানে হয়রত সৈয়দ আহমদ গেছু দারাজ প্রকাশ্যে কেল্লা শহীদ (রহ:) মাজারে ওরশকে কেন্দ্র করে মাস ব্যাপী মেলা বসেছে। ওই মেলায় পৌর এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক নারী পুরুষ নানা প্রকারের পণ্য নিয়ে ছুটে এসেছেন।
মেলায় আসা ক্ষুদ্র একাধিক ব্যবসায়ী জানায় যেখানে মেলা হচ্ছে সেখানেই ছুটে যায়। জীবিকার প্রয়োজনে বছরের বেশীভাগ সময় আমাদের বাহিরে থাকতে হয়।

একটি সুত্র জানায়, জেলার অন্ত:ত অর্ধশতাধিক পরিবার এই পেশায় যুক্ত হয়ে আছে। এরমধ্যে আখাউড়া পৌর এলাকার রয়েছে অন্ত:ত ২০টি পরিবার। তারা নানা প্রতিকুলতা অপেক্ষা করে দীর্ঘ ৩০ বছরের উপর ধরে এ ব্যবসা করে আসছেন। এতেই চলছে তাদের জীবিকা।

এ দেশ পীর আউলিয়ার দেশ। এদেশে অসংখ্য পীর আউলিয়ার মাজার রয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরেই একটি রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে মাজার কেন্দ্রীক বার্ষিক ওরশ, বাংলা ও ইংরেজি সনের বিশেষ মাস উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন হয়।
স্থানীয় সূত্রে তথ্য মতে আখাউড়া পৌর শহরের তারাগন শেরআলী শাহ (রহ:) দরবার শরীফ, খড়মপুর শাহ পীর কল্লা শহীদ (রহ:) মাজার, দেবগ্রাম শাহ সুলতান মাজার, উপজেলার ধরখার ছতুরা শরীফ, কসবা উপজেলার আড়াইবাড়ি দরবার শরীফ, জেলার চাপুর লতিফিয়া দরবার শরীফ, ভাদুঘরের বৈশাখী মেলা, বিজয়নগরের বৈশাখী মেলা, দৌলতবাড়ি দরবার শরীফ, নবীনগরের হযরত গনি শাহ (রহ:) মাজার শরীফ, কুমিল্লার বেলতলির সুলমান শাহ(রহ:) মাজার, শাহজীবাজারের শাহ ফতেগাজী (রাহ) মাজারসহ অস্যখ্য স্থানে বার্ষিক ওরশ মোবারকে মেলা হয়ে থাকে।
ওইসব মেলায় রকমারি পণ্য নিয়ে তারা সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। তবে স্ব স্ব স্থানের লোকজনরাই ওইসব আয়োজনের নিয়ন্ত্রন করে থাকে। খড়মপুর মেলায় কথা হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ভাদুঘর এলাকার মো: মহসিনের সাথে। তিনি জানায়, আসলে মেলা কেন্দ্রীক পেশা হলো আমাদের বাপ দাদার। তাদের হাত ধরেই মূলত এ পেশায় আসা।
অন্য কোন কাজ জানা না থাকায় দীর্ঘ বছর ধরে এ পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করছি। আমার সাথে রয়েছে স্ত্রী ছেলে ও ছোট ভাই। দেশের যেখানেই মেলা হয় সেখানেই রকমারি মাল নিয়ে ছুটে যায়। তিনি আরও বলেন, যেখানেই মেলা হয় মানুষ সমাগম ভালো হয়। তবে আকাশ ভালো থাকলে মানুষের সমাগম বেড়ে বিক্রি ভালো হয়। আগে মালামালের দাম কম ছিল গত কয়েক বছর ধরে দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রিতে কম লাভ হচ্ছে। এরপর মেলাতে দোকান ভালই চলে বলে জানায়।
কুমিল্লার হোমনার ফরিদ মিয়া, নাঙ্গলকোটের ইয়াছিন মিয়া জানায়, আমরা দীর্ঘ বছর ধরে মেলা ব্যবসা করছি। দেশের কোথাই কখন মেলা হয় তা আমাদের জানা আছে। কারণ এটা আমাদের বাপ দাদার পেশা। এই মেলায় বাঁশি, বল, বন্দুক, গাড়ি, পুতুল, নানা রকম খেলনা জিনিস, লিস ফিতা, চুড়ি, চেইন, আংটি ভ্যান রকমারি সাজনিসহ বিভিন্ন জিনিসের মালামাল রয়েছে। এখানে এক মাস থাকা হবে। মেলায় অন্য বছরের চাইতে এবার লোকসমাগম বেশী ও মালামাল ভালো বেচা কিনা হচ্ছে।
মো: বাহাদুর আলম বলেন, স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান মিলে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কাঁঠের নানা খেলনাসহ নানা প্রকারের জিনিস তৈরী করে মেলায় ব্যবসা করছি। মালামাল তৈরী বিক্রি এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়ত কষ্ট হলেও মেলায় পরিবেশ ভাল থাকলে দৈনিক ভালো টাকা বিক্রি হয়। মেলায় যাতায়ত, খাওয়াসহ যবতীয় খরচ বাদে প্রতিদিন ৩-৪ হাজার টাকা আয় হয়।
আলেয়া বেগম বলেন, স্বামী-স্ত্রী মিলে দীর্ঘ ১৭ বছরের উপর মেলায় ব্যবসা করছি। এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বেশীভাগ সময় আমাদের বাইরে থাকতে হয়।
মেলায় পরিবেশ ভাল থাকলে দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার টাকা বিক্রি হয়। যাতায়ত, খাওয়াসহ যবতীয় খরচ বাদে মেলায় প্রতিদিন ২-৩ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানায়। তিনি আরও বর্তমানে এ ব্যবসায় প্রায় ৩ লাখ টাকার উপর পুঁজি রয়েছে। যে সময় মেলা থাকে না তখন এলাকায় ফেরি করে মালামাল বিক্রি করি।
এতে দৈনিক ৭-৮ শ টাকা আয় হয়। মো: মানিক মিয়া বলেন, আমাদের এই ব্যবসা মূলত মেলা কেন্দ্রীক। দেশের যেখানেই মেলা হয় সেখানে যায়। বেশীভাগ মেলা ১ দিন থেকে ৭ দিন থাকে। মেলায় বাঁশ তিরপাল আর পলিথিন দিয়ে দোকান তৈরী করতে হয়।
দোকানে মালামাল সাজাতে অন্ত:ত ৩-৪ঘন্টা সময় লেগে যায়। প্রতিটি দোকানে নিচে ২-৪জন লোক থাকে। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব কিছু দোকানেই করতে হয়। মেলায় দোকানে কষ্ট হলে ও ভালো টাকা আয় হয়।
মো. হাবিব মিয়া বলেন, গত প্রায় ২০ বছর পূর্বে মাত্র ৫ হাজার টাকা পুঁজিতে মেলা ব্যবসা শুরু করি। বর্তমানে ৩ লাখ টাকার উপর মালামাল রয়েছে। এ কাজে স্ত্রী ও ছেলে সার্বিক ভাবে সহযোগিতা করছেন। মেলায় লোকসমাগম ও পরিবেশের উপর নিভর করে কেনা বেচা। তবে এবার এখানে ভালো কেনা বেচা হচ্ছে।
আংটি ও চেইন বিক্রেতা ফরিদ বলেন, সংসারে স্ত্রী,দুই মেয়ে রয়েছে। যেখানে মেলা হয় সেখানেই চলে যায়। মেলা না থাকলে হাট বাজারে বসে ওইসব বিক্রি করছি। বাজার থেকে মেলায় বিকি ভালো হয়। ওইসব বিক্রি করেই চলে জীবিকা। ক্রেতা মো: আলমগর হোসেন বলেন, খড়মপুর ওরশকে কেন্দ্র করে মেলা বসেছে। তাই ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসা। মেলাঘুরে অনেক কিছু দেখেছে। পুতুল, লেইস ফিতা, চুড়ি,চেইন, কেরকেরি গাড়ি, বাঁশি, বল, বন্দুক তারা পছন্দ করে ক্রয় করেছেন। তারা মেলায় আসতে পেরে খুবই খুশি।
খড়মপুর মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো: রফিকুল ইসলাম খাদেম মিন্টু বলেন, শাহপীর কল্লা শহীদ (র:) সপ্তাহব্যাপী বার্ষিক ওরশ মোবারক শনিবার মধ্য রাতে শেষ হবে। তবে ওরশকে কেন্দ্র করে এখানে যে মেলা বসেছে তা প্রায় ১ মাস থাকবে। প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে অসংখ্য লোকজন আসছে।