নিজস্ব প্রতিবেদক : পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা পরিবহন ও লাইটারিং পরিষেবার দরপত্র নিয়ে শুরু হয়েছে চরম বিতর্ক ।

জানা গেছে, এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি নামক একটি যৌথ কোম্পানির দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিতর্কিত সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেডের (এসএইইটি) নাম সবার উপরে রাখা হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
অনেকেই বলছেন এটা শেখ হাসিনা আমলের পলাতক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর পাতানো ফাঁদ। এটা বাংলাদেশ প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট এর বিরোধীও বটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানিটি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিপিসিএল) চায়না অংশের মূল কোম্পানি চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান।

এই কোম্পানিটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক হয়েও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকে সন্তুষ্ট করে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে বিনা টেন্ডারে ১০ বছরের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের সুযোগ করে নেয়। এই কাজে সহযোগিতা করেন সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের এমডি খুরশেদ আলম।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিসিপিসিএল’র বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াংজি একইসঙ্গে বিতর্কিত সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানিরও কার্যনির্বাহী এবং মূল নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি হিসেবে যুক্ত আছেন। যা বাংলাদেশের প্রচলিত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮ এর ৫৫ ও শিডিউল ৯ অনুযায়ী স্পষ্ট স্বার্থবিরোধী বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের আওতাভূক্ত। সিএমসি এই অবৈধ সুযোগ কাজে লাগিয়ে উচ্চ মূল্যে কয়লা ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করায় বাড়ছে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ। এর চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ওপর।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জন্য আমদানি করা কয়লা গভীর সমুদ্র থেকে লাইটারিং করে বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানোর টেন্ডারেও চলছে সিএমসি’র প্রতারণা। আগের টেন্ডারে সাউথ এশিয়া এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি কোম্পানি নিজস্ব ও বিশেষায়িত জাহাজের দলিলাদি উপস্থাপন করলেও তারা চীন থেকে সেই জাহাজ পায়রায় আনেনি। বিপরীতে নিম্নমানের ছোট জাহাজ স্থানীয়ভাবে সংগহ করে জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালিয়েছে।
এতে বেড়েছে সিস্টেম লস ও দুর্ঘটনা। এবারও একই কাজ করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। নিজেদের জাহাজ না থাকারও পরও নিজেরা সিএমসির একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান হয়ে অন্য একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের দরপত্রে অংশ নিয়ে কয়লা সরবরাহের সুযোগ নিতে যাচ্ছে। ,
অভিযোগ রয়েছে, বিপিসিপিএল’র সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোর্শেদ আলম এবং তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর মেয়াদকালে এসএইইটি ও সংশ্লিষ্ট চীনা কোম্পানিগুলোকে একাধিকবার টেন্ডারবিহীনভাবে সরাসরি চুক্তি প্রদান করা হয়েছে। যা রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী ও জনসম্পদ ক্ষতিসাধনমূলক হতে পারে।
এসব অনিয়মের ফলে পূর্ববর্তী চুক্তিগুলোতে কয়লা সরবরাহ ও লাইটারিং সার্ভিসে অনিয়ম এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটেছে বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সিএমসির মালিকানাধীন কোম্পানিটি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকারী কোম্পানি বিসিপিসিএল’র অর্ধেক অংশের শেয়ার হোল্ডার, চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি) বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা কিনতে ঋণ দেয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চীনা অংশীদার সিএমসি। আর সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভির এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের দরপত্রে সবচেয়ে কম দরদাতা হিসেবে তালিকায় সবার আগে স্থান পাওয়ায় বিষয়টি বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের টেন্ডারে মোট ৬ থেকে ৭টি কোম্পানি অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩টি কোম্পানিকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে দেশ ট্রেডিং কর্পোরেশন অ্যান্ড বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (জেভি)।
এই প্রতিষ্ঠানটি টেন্ডারে বিড মূল্য ধরেছিল ৫৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লিমিটেড (বিএমটিএল) বিড মূল্য ধরেছিল ৫৭৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি বিড মূল্য দিয়েছিল ৫৩৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিসিপিসিএল’র মালিক হিসেবে সিএমসির বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান এসএইইটি-সিনোট্রান্স জেভি -এর পায়রায় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে তালিকায় নাম আসার বিষয়টি পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত তৈরি করবে।
বিসিপিসিএল-এ সিএমসির ৫০ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও তাদেরই প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতার হওয়ার প্রশ্নের বিষয়ে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থপনা পরিচালক মো. নাজমুল হক বলেন, এই বিষয়টি আমাদের বোর্ড দেখছেন। মূলত কম রেট আমাদের মূখ্য। এ বিষয়ে বোর্ড যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই চূড়ান্ত হবে।
কয়লা সরবরাহের আর্থিক প্রস্তাবের জন্য জমা দেওয়া চিঠিতে বিএমটিএল’র পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের উল্লেখিত মূল্যে ২০ শতাংশ ভ্যাট ও কর যুক্ত করা হয়েছে। যদি বিসিপিসিএল এই ভ্যাট ও কর ছাড় দেয় তাহলে তাদের মোট মূল্য ২০ শতাংশ কমে যাবে। বিএমটিএল কর্তৃপক্ষ আর্থিক প্রস্তাবের বিড মূল্য ১০ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ ট্যাক্সসহ ধরে ৫৭৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দিয়েছিল। আর এটি বাদ দেওয়া হলে বিএমটিএল’র বিড মূল্যই হবে সর্বনিম্ন বিড মূল্য।
এ বিষয়ে মো. নাজমুল হক বলেন, টেন্ডার ডকুমেন্টের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। টেন্ডার ডকুমেন্টে যদি ভ্যাট-ট্যাক্সের বিষয়টি যদি উল্লেখ থাকে তাহলে সেভাবেই বিবেচনা করা হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিসিপিসিএল) হচ্ছে বাংলাদেশ ও চায়না দুই দেশের একটি যৌথ কোম্পানি। বিসিপিসিএল ১৩২৯ মেগাওয়াটের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে। আর এই কোম্পানিটির সমানভাবে মালিকানা আছে বাংলাদেশের নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (সিএমসি)।
অভিযোগকারীরা আরও দাবি করেছেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্ববর্তী সময়ে উচ্চ পর্যায়ের কিছু ব্যক্তি ও কর্মকর্তার প্রভাবের কারণে সিএমসি ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো একাধিক প্রকল্পে টেন্ডার ছাড়াই বা সীমিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ পেয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের ফলে সরকারি অর্থব্যয়ে অস্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সময়ে কিছু প্রকল্পে নির্দিষ্ট পক্ষের প্রতি সুবিধা প্রদানের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। যার প্রভাব পড়ে পায়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিতে।
এই পরিস্থিতিতে, প্রোকিউরমেন্ট ব্যবস্থার উপর জনআস্থা দুর্বল হয়েছে এবং নীতিগত প্রতিযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
বিশ্লেষকরা বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ও তাদের যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পে বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে স্বার্থবিরোধ ও প্রভাবের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। তারা মনে করেন, নিয়মিত অডিট, স্বাধীন তদন্ত এবং সিপিটিইউ ও বিপিপিএ কর্তৃক কঠোর নজরদারি ছাড়া এ ধরনের অভিযোগ পুনরায় দেখা দিতে পারে। তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করেছেন- বিসিপিসিএল’র বর্তমান ও পূর্ববর্তী সব টেন্ডার প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করা হোক, এসএইইটি ও সিএমসি’র অংশগ্রহণ সংক্রান্ত নথিপত্র স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হোক, মন্ত্রণালয় ও কোম্পানি পর্যায়ে প্রভাব খাটানো বা স্বার্থবিরোধের সম্ভাবনা থাকলে তা আইন অনুযায়ী যাচাই করা হোক।
বিশেষজ্ঞরা দ্রুত নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে রাষ্ট্রীয় অর্থব্যয়, বিদ্যুৎ খাতের সুশাসন এবং প্রোকিউরমেন্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়।