করোনা ঝুঁকিতে পথশিশুরা

জাতীয় জীবন-যাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সব মানুষ। কোভিড-১৯ যেকোনও সময়, যে কারও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে চলার জন্য বলা হলেও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য তা অনেকাংশেই সম্ভব হয়ে উঠছে না। আর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুরা। নগরীর বিভিন্ন বস্তি, রেলস্টেশন এলাকায় এদের বিচরণ। এসব শিশু বেশিরভাগ সময় দলবদ্ধভাবে চলাফেরা ও বসবাস করে। তবে এদের বেশিরভাগেরই নেই কোনও সুনির্দিষ্ট আবাসন ও খাবারের ব্যবস্থা। করোনা পরিস্থিতিতে এদের জীবনধারণ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। পথশিশুদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে সরকারিভাবে এদের জন্য তেমন কোনও বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা (সেভ দ্য চিলড্রেন) বিষয়টি জানেন না।
দেশে আনুমানিক ৭-৮ লাখ পথশিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেন। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে কী পরিমাণ পথশিশু রয়েছে তা সার্ভে করা ছাড়া বলা সম্ভব না।
মহাখালীর ফ্লাইওভারের নিচে কথা হয় শিশু আবিদ করোনা পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থার কথা সে জানিয়ে বলে, সারাদিন এলাকাতেই থাকি। ওই রেললাইনের পাশে একটি ছোট ঝুপড়ি ঘরে আমার সঙ্গে মা আর বইন থাকে। রাস্তায় দাঁড়াইলে অনেক সময় কেউ খাওন দেয়, আবার দেয় না। মায়ে অসুস্থ, এই খাওন না পাইলে অনেক সময় না খাইয়া থাকতে হয়। ইফতারের আগে সইন্ধ্যাবেলা অনেকেই খাওন দেয়। খাওন পাইলে সেইটা ঘরে নিয়া মা আর বইনরে লইয়া খাই।
কাওরান বাজারে কথা হয় অপর এক পথশিশু রাতুলের সঙ্গে। রাতুল বলে, রাতে অনেকেই খাওন দিতে আসে। খাওনের লাইগ্যা অপেক্ষা করি। কোনও কোনও দিন খাওন নিয়া আসে, আবার কোনও দিন আসে না। এভাবেই চলতাছে।
পথশিশুদের কথা চিন্তা করে অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। যার যতটুকু সাধ্য তা দিয়ে চেষ্টা করছে পথশিশুদের পাশে থাকতে। অনেকে বাড়িতে রান্না করা খাবারও প্যাকেট করে পৌঁছে দিচ্ছে শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে।
এমনই একজন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার কাজী তাহমিনা বলেন, করোনাভাইরাসের এই সাধারণ ছুটির সময়টাতে ঘরে বসেই সময় কাটাচ্ছি আমরা। তাই আমি এবং আমার স্বামীর উদ্যোগে বাসায় রান্না করা খাবার পথশিশুদের মধ্যে বিতরণে কাজ করছি। আমার এই উদ্যোগ দেখে আমার আত্মীয়স্বজনও এতে সম্পৃক্ত হয়েছে। তারাও আমাকে অর্থ সহায়তা করছে, পথশিশুদের খাওয়ানোর জন্য। প্রতিদিন আমি প্রায় ৩৫-৪০ জন পথশিশুর খাবার রান্না করি। থাকি। দুর্যোগের শেষ সময় পর্যন্ত আমি চেষ্টা করে যাবো।
এদিকে রাজধানীতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এক রঙা ঘুড়ি’র প্রতিষ্ঠাতা এসএম মাসুদুল ইসলাম (নীলসাধু) বলেন, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা চেষ্টা করছি পথশিশুদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করার। পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন, ভাই-বন্ধুদের কাছ থেকে অর্থসংগ্রহ করে আমরা তাদেরকে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি। করোনাভাইরাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবো।
রাজধানীতে শুধু এরাই নয়, আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পথশিশুদের অন্তত একবেলার আহার মুখে তুলে দিতে সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো পথশিশুদের জন্য কী করছে, জানতে চাইলে সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ক সুশাসন কার্যক্রমের পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, আমরা সেভ দ্য চিলড্রেনের পক্ষ থেকে সব শিশুদের সুরক্ষার কথা ও তাদের ঘরে থাকতে বারবার বলেছি। তবে এই সময় সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে পথশিশুরা। কারণ তাদের তো ঘরই নেই। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মধ্যে পথশিশুরা ঢাকাসহ বড় বড় মহানগর ও শহরগুলোতে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে যেসব এলাকায় কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেখানে খাবার সরবরাহ করার চেষ্টা চলছে।
পথশিশুদের নিরাপদে রাখতে সরকারের প্রকল্প থাকতেও তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের একটা ‘পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম’ নামে প্রকল্প আছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু, এই কোভিড সময়ে সেখান থেকে কোনও বড় রকমের উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। আমরা মনে করছি, সরকারের পক্ষ থেকে পথশিশুদের নিয়ে আলাদা কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। যেহেতু সরকারের একটি প্রকল্প আছে। কিন্তু এই সময় আমাদের নাগরিক এবং শিশুদের জায়গা থেকে যদি রাতারাতি আবাসনের সমস্যাটির সমাধান না হয়, তাহলে একটি এলাকা থেকে অন্য একটি এলাকায় যেন তারা মুভ করতে না পারে, সেটি অন্তত নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে হয়, সরকারের একটি অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন এবং সেখানে এনজিওদের সম্পৃক্ত করা উচিত। সরকারি বন্ধের কারণে অনেক স্কুল খালি রয়েছে, সেখানে এ ব্যবস্থা করা যেতে। সেখানে অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা এনজিওরা করতে পারবে, কিন্তু সরকারকে অনুমতি দিতে হবে।
করোনা পরিস্থিতিতে পথশিশুদের জন্য নেওয়া সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু অধিদফতরের ‘পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম’ প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, সরকারের পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের আন্ডারে দুটি শেল্টার রয়েছে। একটি কাওরান বাজারে আরেকটি কমলাপুরে। দু’টি শেল্টারে পথশিশু রয়েছে ১২০ জন। যেদিন থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে এদেরকে আর শেল্টারের বাইরে যেতে দেওয়া হয় না। তাদেরকে নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করা হয়। এর বাইরে খুব একটা পথশিশু নেই। তবে কেউ কেউ খাবারের সন্ধানে বাইরে থাকতে পারে’।
বর্তমানে সারাদেশের পথ শিশুদের জন্য কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পথ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আমরা একটা প্রজেক্ট সাবমিট করেছি। সেটা করোনাভাইরাসের কারণে আটকা পড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে সারাদেশের জন্য পথ শিশুদের পুনর্বাসন করার একটি প্রজেক্ট। ১৬৪ কোটি টাকার প্রজেক্ট। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই হয়তো চালু হবে এটি। এই মুহূর্তে আর কোনও কিছুই করার নেই না কারও জন্য।


বিজ্ঞাপন