দিশেহারা উপকূলবাসী

জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

*থেমেছে ঝড় থামেনি সংগ্রাম
*বিদ্যুৎবিহীন কোটি গ্রাহক
*আম্পানে ১১ জনের মৃত্যু

 

বিশেষ প্রতিবেদক : অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে এড়ানো যায়নি কাঁচা ঘরবাড়ি, গাছপালা ও ফসলের ক্ষতি। প্রবল জোয়ারে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে সুন্দরবনের আশপাশসহ উপকূলীয় নি¤œাঞ্চল। লোকালয়ে প্রবেশ করেছে লোনাপানি। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এক কোটির বেশি গ্রাহক। ঝড়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, আম্পানের প্রভাবে ঝড় ও জোয়ারে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যশোরে গাছ চাপা পড়ে মা-মেয়ে নিহত হয়েছেন। পটুয়াখালীতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে দুই জন মারা গেছেন। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও ট্রলারডুবে দুই জন মারা গেছেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াতে দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছেন আরেক ব্যক্তি। আর সাতক্ষীরা সদরে আম কুড়াতে গিয়ে গাছ চাপায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। চাঁদপুরে গাছ চাপা পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলাসহ খুলনার আনাচে কানাচে সব স্থানেই ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তা-ব চিহ্ন রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ, মাছের ঘের ভেসে যাওয়া, ঘর বাড়ি ভেঙে ও বিধ্বস্ত হওয়ার চিহ্ন এই অঞ্চলের সবখানে। খুলনা শহরেরও আম্পানের আঘাতে ক্ষতির চিহ্ন রয়েছে।
বুধবার সন্ধ্যায় খুলনার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে আম্পান। রাতভর চলে তা-ব। ঝড়ের আঘাতে ল-ভ- হয়ে গেছে উপকূলীয় এলাকা। কয়রা উপজেলার ১১টি জায়গায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি ও মহারাজপুর ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাছ পালা, কাঁচা ঘর-বাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
পাইকগাছা উপজেলার লস্করের তহসিল অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খেয়াঘাট সংলগ্ন স্লুইচ গেটের ওপর দিয়ে বাঁধ ছাপিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে এলাকা নিমজ্জিত হয়। ৪ নম্বর দেলুটি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলার জালিয়াখালী চর এলাকার ঘের পানিতে ভেসে গেছে। বাড়ি-ঘর ভেঙে গেছে। দাকোপে ঘের ভেসে গেছে। গাছপালা ভেঙে পড়েছে। আমের বাগানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কয়রার স্বেচ্ছাসেবক মো. আবু সাঈদ খান বলেন, কয়রায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা এলাকার নিরাঞ্জন ও মাজিদ গাজীর বাড়ির সামনে, ছোট আংটিহারা এলাকার বাকের গাজীর বাড়ির সামনে, গোলখালী গ্রামের তসলিম মোল্লার বাড়ির সামনে, চরামুখা খেয়াঘাট এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাজীপাড়া ও কাশিরহাট খোলা, কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করছে। আংটিহরা স্লুইচ গেটের পুর্ব ও পশ্চিম পাশের ১ কিলোমিটার এলাকার বাধ ভেঙে গেছে।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজিজুল হক জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় এখন পর্যন্ত কোনও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে অনেক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হওযার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙেছে। তালিকা তৈরির কাজ চলছে। বিকাল নাগাদ ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান জানা যাবে।‘
কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাষ্টার হুমায়ুন কবির বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পনের ফলে নদীর পানির চাপে নাজুক অবস্থায় থাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
মহারাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু বলেন, কপোতাক্ষ নদীর পানি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হামকুড়ুর ও দশহালিয়া গ্রামে মজিবার মাস্টারের বাড়ি সংলগ্ন পাউবোর বেড়িবাঁধ উপচে ও বাঁধ ভেঙে লবণ পানিতে এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুর কুমার সাহা বলেন, আম্পানের প্রভাবে কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে চার থেকে পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পায়। বাতাসের তীব্রতাও ছিল বেশি। ফলে বেড়িবাঁধ উপচে ও ১১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করেছে।
খুলনা ৬ আসনের সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বিভিন্ন ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ ভেঙে ১৫টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। ঘর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুত এ সব ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ আটকানোর প্রচেষ্টা চালানো হবে।
উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় তা-ব চালিয়েছে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’। পুরো জেলা যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। জেলার ২২টি পয়েন্টে ভেঙেছে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। শ্যামনগর-আশাশুনির অসংখ্য স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বিদ্যুতের খুঁটি ও গাছপালা উপড়ে পড়েছে। সবজি, ধান ও আমসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আশাশুনি, প্রতাপনগর- বন্যতলা, হিজলা, কাটলা এলাকায় বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা প্লাবিত। কালিগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের চিংড়ী গ্রামের পাউবো’র বাঁধ তলিয়ে গেছে।
সাতক্ষীরারর শ্যামনগর উপজেলার বুডিগোয়ালিনি মাসুদমোড়, পদ্মপুকুর, গোলাখালী, আশাশুনি উপজেলার সদর, প্রতাপনগর-চাকলা, বন্যতলা, হিজলা, কাটলাসহ ১১টি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা প্লাবিত।
এদিকে ঝড়েরর তা-বে গাছ চাপা পড়ে শহরের বাঁকাল এলাকায় শামসুর রহমান (৬০) ও কামালনগর সঙ্গীতা মোড়ে করিমন নেছা (৪০) নামে দু’জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাতক্ষীরায় ৭৮টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার সব স্থানেই ঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েছে। জেলার সাতটি ইউনিয়নে ২২টি পয়েন্টে উপকূল রক্ষাবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, বুড়িগোয়ালিনী এবং আশাশুনি উপজেলার খাজরা, প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনম আবুজার গিফারী বলেন, গাবুরা, পদ্মপুকুর, কাশিমাড়ি, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের অন্তত আটটি পয়েন্টে কয়েকশত মিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মীর আলিফ রেজা জানান, তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙন কবলিত হাজরাখালি এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান পর্যবেক্ষক জুলফিকার আলী রিপন জানান, বুধবার রাত ৮টার দিকে ১৪৮ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এরআগে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১২০কিলোমিটার। টানা চারঘণ্টা একই গতিতে দাপট দেখিয়ে সবকিছু ভেঙে তছনছ করে যায় আম্পান।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে বাগেরহাটের মোংলার পশুর নদীতে একটি ট্যুরিস্ট লঞ্চ ডুবে গেছে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাসহ কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। প্লাবিত হয়েছে চিংড়ি ঘেরও। তবে এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনও খবর পাওয়া যায়নি।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এই এলাকায় ঝড়ো হাওয়া এবং গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি দেখা গেছে। এদিকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে মোংলা বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকতে দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস।
বন্দরের পশুর চ্যানেলের তীরবর্তী কানাইনগর, কলাতলা, সুন্দরতলাসহ বিভিন্ন জায়গার দুর্বল বেড়িবাঁধের কয়েকটি জায়গা ধসে গেছে। তবে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী কয়েক ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের কথা বলা হলেও মোংলা সমুদ্র বন্দরের পশুর চ্যানেলসহ সুন্দরবনের নদ-নদীর পানির উচ্চতা অনেকটা স্বাভাবিকই ছিল। ফলে মোংলাসহ আশপাশের এলাকায় জলোচ্ছ্বাস প্লাবিত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যদিও বেড়িবাঁধ ভেঙে কিংবা উপচে জোয়ারের যে পানি বাঁধের ভেতরে প্রবেশ করেছিল তা আবার ভাটার সময়ে নেমে গেছে। পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে দুর্গতদের মাঝে রান্না খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন জানান, আম্পানের তা-বে পূর্ব সুন্দরবনের ঢাংমারী স্টেশন, লাউডোব, দুবলা ও মরাপশুর ক্যাম্পের জেটি, ঘরবাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা এবং বনের গাছপালার বেশ ক্ষতি হয়েছে। তবে এতে কোনও জেলে নৌকা ডুবি, জেলে নিখোঁজ কিংবা হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
মোংলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাহাত মান্নান বলেন, সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের মাঝে বৃহস্পতিবার সকালেও খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তার আগে বুধবার দিনে এবং রাতে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যায় ৪৮ হাজার মানুষ। ঝড় কিছুটা কমে যাওয়ায় তারা এখন নিজ বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। ঝড়ে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের তালিকা পাওয়ার পর জানানো হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফখর উদ্দিন বলেন, যেহেতু সিগনাল নামিয়ে আনা হয়েছে, তাই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য বোঝাই-খালাসের কাজ শুরু করা হবে।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া ও সুবর্ণচর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে বেড়িবাঁধ, কাঁচাঘর, ফসলী জমি ও মাছের ঘেরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, সুখচর, নলচিরা, চরঈশ্বর, তমরদ্দি ও নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানিতে ভেঙে গেছে। দমকা ও ঝড়ো হাওয়ায় ৪০টি কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুই শতাধিক কাঁচা ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া, ৫০ একর জমির সবজি ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে নিঝুম দ্বীপের আটটি মাছের ঘের ভেসে গেছে।
তিনি আরও জানান, উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ, নলচিরা ইউনিয়নের ৩ কিলোমিটার, চরঈশ্বর ইউনিয়নের ৩ কিলোমিটার, তমরদ্দি ইউনিয়নের ২ কিলোমিটার ও চানন্দী ইউনিয়নের ৩ কিলোমিটারসহ প্রায় ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জোয়ারের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএসএম ইবনুল হাসান ইভেন বলেন, সুবর্ণচরে বিশটি কাঁচা ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ৬৫০ হেক্টর জমির সবজি ও ফসলী জমি পানিতে ডুবে গেছে।
জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা অলি উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির কোনও রিপোর্ট হাতে এসে পৌঁছেনি।
জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাব শেষ হওয়ায় সকালে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেছেন। হাতিয়ায় কিছু কিছু জায়গায় বেড়িবাঁধ ভাঙা থাকায় জোয়ারের পানি ঢুকে এবং ভাটার সময় নেমে যায়। এর আগে, উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় বত্রিশ হাজার মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আগাম প্রস্তুতি থাকায় জেলায় কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
বুধবার মধ্যরাত থেকে রংপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রচ- ঝড় ও বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ের কারণে শত শত গাছপালা উপড়ে গেছে, কয়েকশ কাঁচাবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ঘর চাপা পড়ে আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন। এ ছাড়াও ঝড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় রংপুর নগরীসহ জেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, বুধবার রাত ১টা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয় এই অঞ্চলে। বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। বেলা ১১টা পর্যন্ত ৫৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে আম্পানের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুত সংযোগ রাত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। রংপুর বিদ্যুৎ বিভাগের কন্ট্রোল রুমে কর্মরত সাহেব আলী নামে এক কর্মচারী জানান, ঝড় শুরু হওয়ার পর থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঝড় কমলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বিচ্ছিন্ন হওয়া বিদ্যুতের তার ও খুঁটি মেরামত করার পর বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। তবে কখন সংযোগ দেওয়া হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে প্রচ- ঝড়ো হাওয়ায় রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গাছ পালা উপড়ে গেছে। এ ছাড়াও বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া, পীরগাছা উপজেলায় কয়েক শতাধিক গাছপালা উপড়ে গেছে। শত শত কাঁচাঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
এদিকে মোবাইল নেটওর্য়াক একেবারে কাজ করছে না। ফলে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে ময়মনসিংহে বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা পর্যন্ত একটানা মুষলধারে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে ময়মনসিংহ মহানগরীর হাট-বাজার বাসাবাড়ি রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। পানির কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। গত ২৪ ঘন্টায় জেলায় সর্বোচ্চ ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এই তথ্য নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান জানান, গত রাত থেকেই হালকা দমকা হাওয়ার সাথে মুষলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে আপনের প্রভাবে জেলায় কোনও হতাহতের ঘটনা ঘটেনি জানান তিনি।
বরিশালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এবার ব্যাপক কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে বেশ কিছু কাঁচা ঘর-বাড়ি, ফসল, বিদ্যুৎ ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে।
ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল দু-একটি জায়গায় বিদ্যুতের পোস্ট ভেঙে কয়েকঘন্টা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে ওইসব ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ স্বাভাবিক হয়েছে। ৯৫ ভাগ জায়গায় বিদ্যুত সংযোগ স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জানান, বিদ্যুৎ, কাঁচা ঘর-বাড়ি, বেরিবাধ, মৎস্য ও কৃষি বিভাগের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে দ্রুততার সঙ্গে কাজ চলছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার কথা জানান জেলা প্রশাসক।
বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী জানান, ঘূর্ণিঝড়ে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় মোট পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে গাছ চাপা পড়ে দুই জন, নৌকাডুবিতে দুই জন এবং দেয়াল চাপা পড়ে একজন মারা যান।
বিভাগে ১৫ লাখ ৪৯ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল। এছাড়া তিন লাখ ৩০ হাজার ৮৪টি গবাদি পশু আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। তবে বিভাগে মারাত্মক কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানান বিভাগীয় কমিশনার।
বিদ্যুৎবিহীন কোটি গ্রাহক: ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। দেশের প্রায় এক কোটি গ্রাহক এখন বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছেন। সারারাতের ঝড়বৃষ্টির পর এখন মেরামতের কাজে নেমেছে বিতরণ সংস্থার লোকেরা। কিছু কিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হলেও সেটার পরিমাণ কম। বড় বড় গাছ উপড়ে বিদ্যুতের তারের উপর পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে। কোথাও কোথাও উপড়ে পড়েছে বা ভেঙে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি।
পল্লি বিদ্যুৎ বোর্ডের (আরইবি) সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অঞ্জন কান্তি দাশ বলেন, ‘আম্পানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হলাম আমরা। আমাদের গ্রাহক বেশি। উপকূলের অধিকাংশ জেলা বিদ্যুৎবিহীন। আমরা ঝড় কমার পর ভোর থেকেই মেরামতের কাজে নেমে গেছি। বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠিসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে কিছু কিছু করে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। আরইবির গ্রাহকদের মধ্যে ঢাকার আশপাশ ছাড়া কমবেশি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, বরিশাল বেল্টে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙেছে প্রায় ২০০ এর মতো। অসংখ্য বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে বড় বড় গাছ পড়ে। আমাদের দুই কোটি ৮৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে।’ দুপুরের মধ্যে আরও বেশ কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে উপকুলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন জানান, এর আগে এই ধরনের ঝড় আসলে আমাদের কেউ দেখেনি। প্রায় সারারাতই ঝড় হয়েছে। ফিডারগুলো একটা পর্যায়ে এক এক করে সব বন্ধ হয়ে যায়। কয়েকটি গ্রিডও বন্ধ হয়ে গেছিল। কোথাও ১৩২ লাইন ট্রিপ করে, কোথাও ওভার ভোল্টেজে ট্রান্সফরমার ট্রিপ করে। এতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। আর আমাদের অসংখ্য খুটি ভেঙে গেছে ও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে।
তিনি জানান, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছি আমরা। আমাদের প্রায় ১২ লাখ গ্রাহকই ক্ষতিগ্রস্ত। সকাল থেকে আমাদের টিমগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ শুরু করেছে। আস্তে আস্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক করা হচ্ছে। বরিশাল, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছি। কিন্তু সেখানে আবার কিছু কিছু ফিডার চালু করা এখনও সম্ভব হয়নি।’ আজ বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে বেশিরভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে বলে তিনি জানান।
এদিকে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া জানান, উপকূলীয় এলাকাগুলোতে আমাদের সমস্যা হয়েছে। ভোলা থেকে শুরু করে সুন্দরবন পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়েই চলেছে ঝড়ের তা-ব। ফলে ক্ষতিও হয়েছে অনেক। আমাদের গ্রিডে এখন বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু বিতরণ লাইনের সমস্যার কারণে তারা বিদ্যুৎ নিতে পারছে না। আমাদের এখন একমাত্র সমস্যা কুষ্টিয়াতে। শহরসহ আশেপাশে বিদ্যুৎ নেই। আমরা ভেড়ামারা থেকে বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ দেওয়ার চেষ্টা করছি। হাসপাতালগুলোতে জেনারেটর দিতে অনুরোধ করেছি।
এর বাইরে পিডিবিরও বেশ কিছু লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারাও সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। আজ রাতের মধ্যে সরবরাহ ঠিক হবে বলে তারা আশা করছে। এদিকের ঢাকায় বিদ্যুতের কোনও সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছে বিতরণ কোম্পানি দুইটি।
সাত জেলায় ১১ জনের মৃত্যু : তীব্র ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি ঝড়িয়ে সাগর থেকে উপকূলে উঠেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর মূল চোখ ভারতের দিকে। তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন অংশের ওপর তোপ দাগার পর আম্পানের বাংলাদেশ অংশটি উঠে গেছে স্থলভাগে। এটি এখন উত্তরবঙ্গে। অন্যদিকে, অন্য উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ের তীব্রতা খুব বেশি না হলেও বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যশোরে গাছ চাপা পড়ে মা-মেয়ে নিহত হয়েছেন। পটুয়াখালীতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে দুজন মারা গেছেন। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও ট্রলারডুবে দুই জন মারা গেছেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াতে দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছেন আরেক ব্যক্তি। আর সাতক্ষীরা সদরে আম কুড়াতে গিয়ে গাছ চাপায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। চাঁদুপুরেও আম কুড়াতে গিয়ে একজন মারা গেছেন।
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানান, সাগরের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে বুধবার সন্ধ্যায় ৫ থেকে ৭ ফুট জোয়ার হয়েছে। ভারী বৃষ্টি হয়েছে প্রায় সারারাতই। সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে সদরের শহরের বাঁকাল এলাকায় শামসুর রহমান (৬০) ও কামালনগর সঙ্গীতা মোড়ে করিমন নেছা (৪০) নামে দু’জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চল, আশাশুনি ও সাতক্ষীরা সদরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাঁচাঘর বাড়ি মৎস্যঘের ও ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। আশাশুনির ৬টি পয়েন্ট ও শ্যামনগরের একটি পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গাবুরা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আম্পানে ল-ভ- হয়ে গেছে পুরো গাবুরা ইউনিয়ন। আমার বাড়ির অধিকাংশ গাছ পড়ে গেছে। এই ঝড়ে আমাদের কংক্রিটের প্রাচীর পর্যন্ত পড়ে গেছে। সেই বিকাল থেকে ঝড় শুরু হয়েছে একটানা গভীর রাত পর্যন্ত চলছে।
শ্যামনগরের গাজী আল ইমরান নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বুড়িগোয়ালীনির ইউনিয়নের দাতানিখালি এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে নদীতে জোয়ার বৃদ্ধির কারণে প্রতাপনগরের কুড়ি কাউনিয়া, সুভদ্রা কাটি, চাকলা, হাজরাখালি পয়েন্টে বেঁড়ি বাধ লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
ভোলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ে গাছের নিচে চাপা পড়ে ছিদ্দিক ফকির (৭০) ও ট্রলারডুবিতে মো. রফিকুল ইসলাম নামের দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ছিদ্দিক ফকির জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চর মানিকা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও রফিকুল ইসলাম জেলার বোরহানউদ্দিন থানার মনিরাম এলাকার বাসিন্দা। বুধবার দুপুরে উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার প্রধান সড়কে ঝড়ে গাছের ডাল পড়ে ছিদ্দিক ফকিরের মৃত্যু হয়। বিকালে সদর উপজেলার রাজাপুরের মেঘনা নদীতে ট্রলার ডুবিতে রফিকুল ইসলামের মৃত্যু হয়।
‘আম্পানের’ প্রভাবে যশোরে প্রবল ঝড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছ-পালা উপড়ে পড়েছে। চৌগাছা উপজেলার চানপুর গ্রামে ঘরের উপর গাছ পড়ে এক নারী ও তার মেয়ে নিহত হয়েছেন। বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন চানপুর গ্রামের মৃত ওয়াজেদ হোসেনের স্ত্রী খ্যান্ত বেগম (৪৫) ও তার মেয়ে রাবেয়া (১৩)।
যশোরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আম্পানের কেন্দ্র রাত সাড়ে ১০টা থেকে যশোরের পশ্চিম দিয়ে অতিক্রম শুরু করে। আম্পানের প্রভাবে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে। রাত ১২টায় সর্বশেষ বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৩৫ কিলোমিটার।
চৌগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে চৌগাছা উপজেলার চানপুর গ্রামে একটি ঘরের ওপর গাছ পড়ে খ্যান্ত বেগম ও তার মেয়ে রাবেয়া নিহত হন। স্থানীয়দের মাধ্যমে তিনি এ তথ্য জানতে পেরেছেন।
অন্যদিকে, পটুয়াখালী সংবাদদাতা জানিয়েছেন, গাছ চাপা পড়ে একজন এবং মানুষকে সতর্ক করতে গিয়ে নৌকা ডুবে উপজেলার প্রচারাভিযানে একটি ইউনিটের দলনেতা মারা গেছেন।
গলাচিপা থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে এর নিচে চাপা পড়ে রাসেদ নামে ৬ বছরের একটি শিশু। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক নিশ্চিত করেছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জন সচেতনতার প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া এলাকায় খালে নৌকা ডুবে সিপিপি’র দলনেতা শাহআলম নিখোঁজ হন। পরে ডুবুরি দল তার লাশ উদ্ধার করেছে।
তিনি জানান, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্তত ১৭টি গ্রাম।
এদিকে, পটুয়াখালীতে আম্পানের ক্ষয়-ক্ষতি মনিটরিং করার জন্য জেলা ও উপজেলায় ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলায় মোট ৭৫২টি আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ৩২৫টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। পায়রা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কাবস্থানে রয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্দরের সব কার্যক্রম।
পটুয়াখালীতে আম্পান মোকাবিলায় কাজ করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, কোস্টগার্ড, ফায়ার কর্মী, আনসার, স্বেচ্ছাসেবী সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, পিরোজপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সড়কে দেয়াল চাপা পড়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তার নাম শাজাহান মোল্লা (৬০)। রাত সাড়ে আটটায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মঠবাড়িয়া থানার ওসি মাসুদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি গিলাবাদ।
চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার আগেই জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার (২০ মে) দুপুরে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার পৌর সদরের ২ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বৌধি চাকমা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। উপকূলে ঘাস কাটতে গিয়ে সালাউদ্দিন জোয়ারের পানিতে পড়ে যান বলে তিনি জানান।
চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে গাছ চাপা পড়ে জান্নাত বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি চাঁদপুর সদর উপজেলার ৯ নম্বর বালিয়া ইউনিয়নের রাড়িরপুল এলাকার ওহাব গাজীর মেয়ে। বুধবার রাতে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়া জেলায় আর তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, আম্পানের প্রভাবে ঝড়ো বাতাস চলাকালীন রাত ২টার দিকে জান্নাত বেগম আম খুঁজতে গেলে গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
বাগেরহাট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী এলাকার বেরিবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত ছাড়া আর কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি । জেলা সদরসহ সবকটি উপজেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জেলার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রায় ২ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া প্রায় ২৩ হাজার গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মো. কামরুল ইসলাম এই তথ্য জানান।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, শুধু উপকূল নয়, দেশের উত্তরপ্রান্তের জেলা পঞ্চগড়েও আম্পানের প্রভাবে রাতে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়েছে। সারাদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও রাত ১০টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে একাধিকবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের বরাত দিয়ে পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এবং শনিবারও হাল্কাসহ ভারীবর্ষণ হতে পারে। এটা রবিবার পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।
পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি ও পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌহিদুল বারী বাবু জানান, হিমালয়ের কাছাকাছি পঞ্চগড়ের অবস্থান এজন্যই পঞ্চগড়ে আম্পানের কিছুটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পঞ্চগড়ে ভারীবর্ষণ হতে পারে। এ সময় পঞ্চগড়ের কৃষকদের বোরো ক্ষেত ও ভুট্টাসহ বেশ কিছু ফল ও ফসলের ক্ষতি হতে পারে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, জেলার পাঁচ উপজেলার কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে কোথাও ক্ষয়ক্ষতি হলে তা তাৎক্ষণিক জানানো এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।


বিজ্ঞাপন