নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন আহমেদ। রোববার রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর গ্রীন লাইফ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জানা গেছে, প্লাজমা থেরাপি দিয়েও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে করোনাভাইরাসের টিকা নেই, বাজারে কোনো ওষুধও আসেনি এখনও। নানা ওষুধ প্রয়োগে রোগ উপশমের উপায় চিকিৎসকরা খুঁজলেও পরীক্ষামূলক ব্যবহারের বাইরে কোনো ওষুধ কিংবা প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
এর আগে বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় যে প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। পাশাপাশি ‘রেমডেসিভিরসহ’ অন্যান্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার না করারও সুপারিশ করেছিলো জাতিসংঘের স্বাস্থ্য এই সংস্থাটি।
সম্প্রতি কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের দেহ থেকে রক্তরস বা প্লাজমা নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বাংলাদেশেও শুরু হয়েছিলো। এর মধ্য দিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এন্টিবডি তৈরি হয়ে তা সেরে ওঠায় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করেছিলো চিকিৎসকরা।
তবে সম্প্রতি চট্টগ্রামে প্লাজমা থেরাপি নেয়া এক কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু ঘটে। এর পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন প্লাজমা থেরাপি নেয়ার পরও মারা যান।
করোনায় মৃত্যুবরণ করা ঢাবি অধ্যাপকের ব্যাপারে প্রক্টর গোলাম রব্বানী গণমাধ্যমকে বলেন, অধ্যাপক শাকিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের পাশে শিক্ষকদের কোয়ার্টার অধ্যাপক আবুল খায়ের ভবনে থাকতেন। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন আর সকল ধরনের চিকিৎসা সুবিধার সাথে তাকে তিন দিন আগে প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়েছিল। তারপরও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে বিভিন্ন হাসাপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি ও পরীক্ষামূলকভাবে রেমডেসিভির, আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিনসহ গুটিকয়েক ওষুধের পাশাপাশি কনভালেসেন্ট প্লাজমা ব্যবহার হচ্ছে যা পরীক্ষামূলক ব্যবহারের ফল না দেখে দেয়া ঠিক নয় বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, দেশে কোনো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য প্রটোকল অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। আর বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) থেকে রিসার্চ ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়।
এই দুটি প্রতিষ্ঠান বলছে, করোনা চিকিৎসায় কোনো ওষুধ পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য কোনো ধরনের অনুমতি কেউ তাদের কাছ থেকে নেয়নি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কয়েকটি ওষুধে সায় দিলেও তা শুধু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা হাসপাতালে পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য। এ সময় দেশে কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসার জন্য আলোচনায় আছে প্লাজমা থেরাপি।
আবার অন্যদিকে প্লাজমা থেরাপির পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রোগীকে প্লাজমা দান করতে ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন স্বজনরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ১৬ মে আনুষ্ঠানিকভাবে প্লাজমা সংগ্রহ শুরু করে। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ২১জন প্লাজমা দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চারজনসহ ৮টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ১৮জনের শরীরে পরীক্ষামূলকভাবে প্লাজমা প্রয়োগ করা হয়েছে।
প্লাজমা থেরাপির জন্য গঠিত কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এমএ খান বলছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের রিসার্চ ইথিকস কমিটির কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছেন তারা। প্রটোকল অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ৪৫ জনের ওপর তারা এটি প্রয়োগ করবেন।
তিনি আরো বলেন, করোনাভাইরাসের যেহেতু কোনো ওষুধ নাই তাহলে এটা চেষ্টা করতে তো সমস্যা নাই। এখন যে যার মত করে দিচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে এটির প্রয়োগ হলে কাকে প্লাজমা দেয়া হচ্ছে, ফলাফল কী আসছে, তা বিস্তারিত জানা সম্ভব হবে। নিয়ম অনুযায়ী সারাদেশের হাসপাতালগুলোতে যেন প্লাজমা থেরাপি দেয়া যায়, সেজন্য কর্মসূচি নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে অনুরোধও করেছেন তিনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মাহমুদ উজ জাহান বলছেন, প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগের জন্য ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স ঢাকা মেডিকেল দিতে পারে না।
কোনো ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগের আগে বিএমআরসির রিসার্চ ইথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স নিতে হলেও এখনও কোনো ওষুধের জন্য তা নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
মাহমুদ আরো বলেন, আপনি একটা বিষয়ে গবেষণা করবেন, কিন্তু তার নিয়ম মানবেন না, তা হতে পারে না। এজন্য ন্যাশনাল রিসার্চ ইথিকস কমিটির অনুমোদন লাগে। প্লাজমা থেরাপির জন্য এই ধরনের অনুমতি নেওয়া হয়নি। লোকাল ইথিকস কমিটি এই অনুমতি দিতে পারে না। এজন্য আমরা তাদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানতে চেয়েছি।
এ সময় আলোচনায় থাকা আইভারমেকটিন ও ডক্সিসাইক্লিন প্রয়োগ করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এই ওষুধ অন্যান্য হাসপাতালেও ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. তারেক আলম বলেন, এখন আর ওই ওষুধ তারা ব্যবহার করছেন না। তবে বিভিন্ন দেশে এই ওষুধটি ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়ার দাবি ওঠায় এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা যায়। আমি একটা স্টাডি দেখেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার, সেখানে তারা এই ওষুধটি দিয়েছিল। আমিও ট্রাই করেছিলাম, রোগী ভালো হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে ১০টা করে রোগীকে ওষুধটা দিয়ে দেখেন।
করোনা চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যে গাইডলাইন, তাতে আইভারমেকটিন, ডক্সিসাইক্লিন ব্যবহারের কথা বলা নেই। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে এই ওষুধ প্রয়োগ হচ্ছে।
২৬ এপ্রিলের পর থেকে কোভিড-১৯ লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদের ওপর আইভারমেকটিন প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানান কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসান উল হায়দার। তিনি বলেন, তাদের পর্যবেক্ষণে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন আছে।
ইবোলা ভাইরাসের ওষুধ রেমডেসিভির তৈরি করে তা সরকারের কাছে দিয়েছে দেশের একটি ওষুধ কোম্পানি। বিভিন্ন হাসপাতালের আইইসিইউতে থাকা কোভিড-১৯ রোগীদের উপর তার প্রয়োগ হচ্ছে।
কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ১৪জন রোগীর ওপর এই ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়েছে বলে জানান হাসপাতালের সমন্বয়ক ডা. শিহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের আইসিইউতে যে রোগী আছে, তাদের উপর এটা প্রয়োগ করছি। এটা অনেক প্রাথমিক পর্যায়, এজন্য কাজ করছে কি না, বোঝা কঠিন। এটা বিস্তারিত গবেষণা করেই কেবল বলা সম্ভব।
ওষুধ প্রয়োগে কোভিড-১৯ সারানোর চেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। বতর্মানে কোভিড-১৯ মোকাবেলা গঠিত কারিগরী কমিটির সদস্য তিনি। তিনি বলেন, সম্পূর্ণ ব্যবহারের আগে ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের’ ফল দেখতে হবে। তারাও নানা উপায়ে চেষ্টা করছেন। তবে এগুলো সবই পরীক্ষাধীন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে যদি তারা প্রমাণ দেখাতে পারেন তাহলে আমরা একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারব।
রেমডেসিভির ঔষধ প্রশাসনের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে হলে বিএমআরসির অনুমোদন লাগবে, যা কেউ নেয়নি বলে জানান ডা. মাহমুদ উজ জাহান।
এদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে রেমডেসিভির। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে শুধু পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য। তিনি আরো বলেন, কোনো চিকিৎসক যদি মনে করেন এটা ব্যবহার করে ভালো রেজাল্ট পেয়েছেন, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমরা কখনোই বলিনি আইভারমেকট্রিন-ডক্সিসাইক্লিন করোনার ওষুধ। এখন এই ওষুধের অন্য কোনো ব্যবহার করতে হলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল লাগবে। আর সেজন্য আমাদের অনুমতি লাগবে।
‘একইভাবে প্লাজমা থেরাপির জন্য যদি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করে তাহলে আমাদের কাছ থেকে প্রটোকল অনুমোদন নিতে হবে’ বলে জানান তিনি।