গাজীপুর কারাগারে বন্দীর কাছে নারীর স্বাক্ষাৎ নিয়ে তোলপাড়

অপরাধ ঢাকা সারাদেশ

করোনার মধ্যে ভিজিটদের স্বাক্ষাৎ বন্ধ থাকলেও মাদক ও জুয়ার আসর রমরমা

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় কারাগারে ভিজিটরদের স্বাক্ষাত বন্দ থাকলেও মাদক পাচার বন্ধ নেই। লকডাউনে বাইরে মাদক পাওয়া অনেকটা কঠিন। কিন্তু ভেতরে পাওয়া সহজ। টাকা হলে সবই পাওয়া যায়। শুধু মাদকই নয়, এবার কারাগারে টাকার বিনিময়ে বন্দীর কাছে এক নারীর স্বাক্ষাত করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গাজীপুর কারাগারের ভেতরে এই করোনার মধ্যেই ২১ হাজার টাকার বিনিময়ে এক আসামির কাছে নারী পাটানোর অভিযোগ উঠেছে। গত ২৭ মে অফিস কলের মাধ্যমে ওই কারাগারের বাইরে থেকে মাদক মামলার এক আসামির কাছে ওই নারীকে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুর কারাগের কারারক্ষী ওয়াজেদ মিয়া, বিল্লাল হোসেন ও আব্দুল আজিজ নামে তিন কারারক্ষী মিলে সেখানে ইয়াবা, গাঁজা, মদ ও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক পাচার করেই আসছে। আর শিপন নামের এক মাদক মামলার আসামির কাছে প্রতি নিয়মিত টাকার বিনিময়ে হেরোইন, গাঁজা, মদ ও ইয়াবা পাচার করতো। মাঝে মধ্যে তার স্ত্রী পরিচয়ে ঢুকলেও গত ২৭ তারিখ সকালে অফিস কলের মাধ্যমে এক নারী প্রবেশের ঘটনায় কারাগারের কারারক্ষীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে তোলপাড় চলছে। আর এঘটনাটি খোদ ঢাকায় ডিআইজি কার্যালয়ে পর্যন্ত পৌছেছে। গত বৃহস্পতিবার দুর্নীতিবাজ তিন কারারক্ষীর পক্ষে ঢাকায় ডিআইজি কার্যালয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এসেছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছেন।
কারাগারে আসামিদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নারী সরবরাহ করারো অভিযোগ আগেও উঠেছিল। করনোর মধ্যে বাইরে নেশা করা অনেকটা কঠিন হলেও নিরাপদ জেলখানা! ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইনসহ যেকোনো নেশাদ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে বলে সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন এমনই দাবি করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারা হাসপাতাল, বন্দিদের খাবার সরবরাহ, ক্যান্টিন ব্যবসা, জুয়ার আসর ও মাদক কারবারের অভিযোগ উঠেছে খোদ কারাগারের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাজা পাওয়া আসামির বিরুদ্ধে। এসব ব্যক্তিরা ‘কারা মাফিয়া’ হিসেবে ব্যাপক ক্ষ্যতি অর্জন করেছেন। দিনের পর দিন কারাগারে এমন অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও কারা মাফিয়াদের থামানো যাচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই অনিয়ম-দুর্নীতি চালানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিপরীতে সিগারেটের প্যাকেট দিলে সুবেদার, কারারক্ষীরা বাইরে থেকে মাদক এনে দেন। তবে বাইরের চেয়ে কারাগারে মাদকের দাম কিছুটা বেশি। এখানে ফেনসিডিল প্রতি বোতল ১৫০০ টাকা, ইয়াবা প্রতি পিস ৫০০ টাকা, গাঁজা ছোট পুরিয়া ৪০০ টাকা, হেরোইন এক পুরিয়া এক হাজার টাকা, আর যেকোনো ব্র্যান্ডের মদ চাহিদামতো দামে পাওয়া যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কারারক্ষী জানান, গাঁজা সেবনের অপরাধে বন্দীদের কারা কেস টেবিলে নেওয়া হয়। সেখানে প্যাকেট ব্যানসন সিগারেট দিয়ে ম্যানেজ করায় তাদেরকে শাস্তি দেওয়া থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আবার কারাগারের ভেতরে জমজমাট জুয়া খেলার অভিযোগ রয়েছে। টাকার পরিবর্তে সিগারেটের প্যাকেটের ছড়াছড়ি থাকে। টাকার পরিবর্তে এক প্যাকেট সিগারেটই হচ্ছে উত্তম। সন্ধ্যায় লকআপ হয়ে যাওয়ার পর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এবং হাসপাতালের ভেতরে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর জুয়া খেলার জন্য তাস কারারক্ষীরাই সরবরাহ করেন। সেখানে সারারাত বন্দিরা জুয়া খেললেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। খেলা শেষে সিগারেটের প্যাকেটগুলো জমা থাকে লকআপ ইনচার্জের কাছে।
সূত্র জানায়, দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৮৮ হাজার বন্দি রয়েছে। এর এক-তৃতীয়াংশই মাদক মামলার আসামি। প্রায় প্রতিদিনই মাদকের মামলায় কারাগারে যেমন বন্দি ঢুকছে। আবার অনেক আসামি করোনার আগে জামিনে মুক্তি নিয়েও বের হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে মাদকের মামলায় দেশের বিভিন্ন কারাগারে ২৬ হাজার ২৩২ জন বন্দি ছিল। এসব বন্দীর মধ্যে ৯৪৬ জন নারী, বাকি ২৫ হাজার ২৮৬ জন পুরুষ ছিল। আর চলতি বছরের গত ১২ ফেব্রুয়ারি মাসে কারাগারে ৪১৯ জন মাদক মামলার আসামি ঢুকেছিল। আর জামিনে বেরিয়ে মুক্তি পেয়েছেন ৫৪৭ জন বন্দী।
সূত্রটি আরো জানায়, মাদক পাচার, বহন ও বিক্রির অভিযোগে প্রত বছর দেড় লাখের বেশি লোককে গ্রেফতার করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর গ্রেফতারকৃতদের আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আইনি প্রক্রিয়া শেষে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান।
আর এক সূত্র জানায়, গত বছর ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৬ জন মাদক কারবারিকে পুলিশই গ্রেফতার করেছিল। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে লক্ষাধিক।আর আড়াই হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বিজিবি। আর র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় ৭ হাজারের বেশি মাদক কারবারি গ্রেফতার হয়েছিল।
উল্লেখ্য, গত ১৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম রোগীর মৃত্যুর পর সরকার বন্দী ও কারারক্ষীদের জন্য আইসোলেশন কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়।পরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের কারাগারগুলোর বন্দীদের জন্য কিশোরগঞ্জের পুরোনো কারাগার নিযুক্ত করা হয়। আর সিলেট বিভাগের বন্দীদের জন্য সিলেটের পুরোনো কারাগার, চট্টগ্রাম বিভাগের বন্দীদের ফেনীর পুরোনো কারাগার, বরিশাল বিভাগ ও যশোরের জন্য পিরোজপুরের পুরোনো কারাগার, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের বন্দীদের জন্য মাদারীপুরের পুরোনো কারাগার নিযুক্ত করা হয়েছে। আর রংপুর বিভাগের বন্দীদের জন্য দিনাজপুরের পুরোনো কারাগার, রাজশাহী বিভাগের বন্দীদের জন্য কারা উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি প্রিজন রাজশাহী) এর বাংলোকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়। তাছাড়া, কেরানীগঞ্জের মহিলা কারাগারকে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দেশের ৬৮ কারাগারের বন্দীদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কারাগারের নির্ধারিত মুঠোফোন নম্বরে প্রত্যেক বন্দীকে স্বজনদের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সব কারাগারে দর্শনার্থী সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হবে।
গাজীপুরের কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার নেসার আহম্মেদের সেল ফোনে মাদক মামলার আসামির কাছে নারীর স্বাক্ষাৎ করানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার কারণে আমাদের কারাগারের প্রধান গেট বন্ধ। এখানো কোন বন্দীর সঙ্গে কেউ স্বাক্ষাতের সুযোগ নেই। অভিযোগটি মিথ্যা বলে দাবি করেন তিনি।


বিজ্ঞাপন