হেলিকপ্টারে উঠেই র‌্যাব কর্তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় সাহেদ

অপরাধ আইন ও আদালত

সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত ৪৮টি চেকবইয়ের পাতাসহ সহযোগি গ্রেফতার

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : হেলিকপ্টারে উঠেই প্রতারক সাহেদ র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিলেন। র‌্যাবের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, সাহেদকে গ্রেফতারের পর হলিকপ্টারে ওঠানো হয়। এসময় র‌্যাব কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে সাহেদ বলেন, ‘কত দিন আমাকে আটকে রাখবেন? যখন বের হব তখন আপনাদের দেখে নেব।’ সাতক্ষীরা থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনার পথে র‌্যাব কর্মকর্তাদের এ হুমকি দেন।
অপরদিকে সাভার এলাকায় প্রতারক সাহেদের সিল ও স্বাক্ষরিত ৪৮টি চেকবইয়ের পাতাসহ রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াস উদ্দীন জালালীকে আটক করেছে র‌্যাব। এ সময় তার ব্যবহৃত প্রাইভেটকারসহ চালক মাহমুদুল হাসানকেও আটক করা হয়। তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য।
জানা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর থেকে সাহেদ আর নিজের বাড়িতে থাকেননি। প্রথম দিন তিনি ঢাকায় একটা আবাসিক হোটেলে ছিলেন। পরদিন তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিএস) নরসিংদীর বাড়িতে চলে যান। এরপর সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে কক্সবাজার যান সাহেদ। আর কুমিল্লা ছাড়ার আগে নানাজনকে ফোন করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এসে একটি গাড়ি ভাড়া করে চলে যান সাতক্ষীরায়। রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম একের পর এক প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। প্রতারণার শিকার অনেকেই এখন র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করছেন। এ ছাড়া সাহেদ জালিয়াতি করে নিজের নতুন জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার সাহেদকে আদালতে হাজির করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ অস্ত্র ও জাল টাকার আরও দুটি মামলা করেছে র‌্যাব।
র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ৬ জুলাই রিজেন্টের উত্তরা শাখায় অভিযান চালানোর পর বলেছিলেন, রিজেন্ট প্রায় ছয় হাজার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছে। হাসপাতালটি কীভাবে প্রতারণা করেছিল রোগীদের সঙ্গে? ভুক্তভোগি একাধিক ব্যক্তি নমুনা নিয়ে রিজেন্ট জালিয়াতি করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন।
এজন ভুক্তভোগির অভিযোগ করে বলেন, গত জুনের শেষ সপ্তাহে তার ছেলে ও ছেলের বউয়ের করোনা পরীক্ষা করানো হয়। তারা ঘরেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলে রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হন। একদিন পরই হাসপাতাল ছাড়তে চাইলে রিজেন্ট ৫২ হাজার টাকার বিল ধরিয়ে দেয়। এরমধ্যে রক্তের একটি নমুনা থেকে বিলে ১০টি পরীক্ষা করানোর কথা বলা হয়। আর একটি ছিল ইসিজি। প্রতারকচক্র রক্ত থেকে ইসিজি পরীক্ষা করা সম্ভব বলেও রোগির স্বজনদের জানিয়েছেন।
হাসপাতালে ভর্তির পরই তারা জানতে পারেন রিজেন্ট বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। এরপর রিজেন্টের লোকজন ২৮ হাজার টাকা নিয়ে ছয়জনের নমুনা সংগ্রহ করে। যে ব্যক্তি নমুনা নিয়ে গেছেন তিনি এমন ভাব করছিলেন যেন ডাক্তার। র‌্যাবের অভিযানের পর তারা জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি আসলে রিজেন্টের জনসংযোগ কর্মকর্তা তারিক শিবলী। আর নমুনা নিয়ে যাওয়ার পর রিজেন্ট তাদের একটি জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচ) স্পিপ দেয়। সরকারি ওই কর্মকর্তা যে কলোনিতে থাকেন, সেখানে আইপিএইচের একজন কর্মকর্তা থাকেন। তাকে স্পিপটি দিতেই ওই কর্মকর্তা বলেন, যে সিরিয়াল দেওয়া হয়েছে ওই সিরিয়ালের নমুনা আইপিএইচে নেই।
তাদের সন্দেহের মধ্যেই তারা রেজাল্ট পেয়ে যান। কোনো সরকারি প্রতষ্ঠানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করালে সেই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ফল দেখা যায়। কিন্তু এই পরিবারটির ফল দেখা যায়নি। তারা কারণ জানতে চাইলে রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ আবারও লোক পাঠায়। এর ২৪ ঘণ্টা পর ওয়েবসাইটে তারা আবার ফল দেখতে পান।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি সাংবাদিকদের জানান, রিজেন্ট কোনো নিয়মকানুন না মেনে নমুনা পাঠাচ্ছিল, আবার টাকাও নিচ্ছিল। সে কারণে তারা খুব অসুবিধায় পড়ছিলেন। বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানো হয়েছিল। একপর্যায়ে গত জুনে নিপসম রিজেন্টের নমুনা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, প্রতারক সাহেদ একাধিক পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন, এমন আলোচনা ওঠায় নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগ বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের মহাপরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, সাহেদ ২০১৯ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেন। তাকে এনআইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন করার বছরখানেক আগে সাহেদ একটি নতুন পরিচয়পত্র করতে এসেছিলেন। তখন তার আঙুলের ছাপ নেওয়ার পর দেখা যায়, তার নামে একটি পরিচয়পত্র আছে। তাই আরেকটি পরিচয়পত্র করার সুযোগ পাননি। তবে নাম সংশোধনের জন্য প্রমাণ হিসেবে কেমব্রিজের ও লেভেলের একটি সনদ, জন্মনিবন্ধন সনদ, নাগরিকত্ব সনদ ও পাসপোটের কপি দাখিল করেছিলেন। প্রাথমিক তদন্তে তার দেওয়া জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ যথাযথ পাওয়া গেছে।
সাহেদের সই করা ৪৮টি চেকসহ রিজেন্ট গ্রুপের এমডির ভায়রা আটক
এদিকে সাভারের আশুলিয়ায় রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের সিল ও স্বাক্ষরিত ৪৮টি চেকবইয়ের পাতাসহ রিজেন্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের ভায়রা গিয়াস উদ্দীন জালালীকে আটক করেছে র‌্যাব। এ সময় তার ব্যবহৃত প্রাইভেটকারসহ চালক মাহমুদুল হাসানকেও আটক করা হয়। তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য।
গত বৃহস্পতিবার রাতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর আগে বিকেল ৫টায় আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। আটককৃত গিয়াস উদ্দীন জালালী (৬১) ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার রুপসাদী গ্রামের মৃত ফকির সুলতান জালালীর ছেলে ও রিজেন্ট গ্রুপের এমডি মাসুদ পারভেজের ভায়রা। আর তার প্রাইভেটকারচালক মাহমুদুল হাসান (৪০) শরিয়তপুর জেলার জাজিরা থানার ছোট কৃষ্টনগরের ফয়জুল মাতবরের ছেলে।
র‌্যাব জানায়, মাদকদ্রব্য কেনা বেচার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকায় আশুলিয়া-কাশিমপুর সড়কে অভিযান চালিয়ে গিয়াস উদ্দীনকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের সিল ও স্বাক্ষরিত প্রিমিয়ার ব্যাংক, গরিবে নেওয়াজ এভিনিউ শাখার ৪৮টি চেকবইয়ের পাতা ও রিদম ট্রেডিংয়ের নামে ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রগতি স্মরণী শাখার একটি চেক বই পাওয়া যায়। এছাড়া তার ব্যবহৃত প্রাইভেটকার তল্লাশি করে ১০ বোতল ফেনসিডিল ও ২১২০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন