ওরা ভদ্রবেশী ছিনতাইকারী

অপরাধ এইমাত্র রাজধানী

নগরবাসীকে প্রাইভেটকার যোগে ধাবরিয়ে বেড়াচ্ছে

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : ওরা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী। দামি দামি গাড়ি নিয়ে ওরা নগরীর অলি গুলি ধাবরিয়ে বেড়ায়। বেশ বুশায় ওদের বোঝার উপায় নেই ওরা যে অপরাধী। ভদ্রবেশী লেবাসধারী! দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বুঝতে পারে না যে, ওরা ছিনতাইকারী।
রাজধানীর প্রায় অর্ধশত স্পটে এসব ভদ্রবেশী ছিনতাইকারীর সদস্যরা বেপরোয়া তৎপরতা চালাচ্ছে। এসব এলাকায় এই চক্র ভোরেই বেশী তৎপর হয়ে ওঠে। এরমধ্যে নগরীর শাহবাগ কমলাপুর ও চিটাগাং রোড অন্যতম। আর গত আট বছরে নগরীর শাহবাগেই ৮৩টি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি চাঞ্চল্যকর ধানমন্ডির ৭নম্বর সড়কে এক ছিনতাইয়ের ঘটনা নৃশংসতাকে হার মানিয়েছিল। প্রাইভেটকারযোগে ছিনতাইয়ের সময় হেলেনা বেগম নামে এক নারীর ব্যাগ ধরে টান দিয়েছিল ছিনতাইকারীরা। ঘাড়ে পেঁচানো অবস্থায় সেই ব্যাগসহ রাস্তায় পড়ে যান সেই নারী। আর ছিনতাইকারীরাও নিষ্ঠুর নাছোড়বান্দা ছিল। ব্যাগ ছেড়ে না দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে সেই নারীকে টেনেহিঁচড়ে কিছুদুরে নিয়ে যায়। আর গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তার। পরে তার ব্যাগটি নিয়ে যায় ছিনতাইাকারীর। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বহিনী অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি প্রায়ভেটকারসহ ছিনতাইচক্রের কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করে। আর এই চক্রের অনেকেই বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়। এরপর প্রাভেটকার নিয়ে ভদ্রবেশী ছিনতাইয়ের ঘটনা হ্রাস পেলেও পুনরায় আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, গত ১৭ জুলাই রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় মুনা আক্তার নামের একজন শিক্ষিকা রিকসাযোগে কমলাপুর এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন সকাল সাড়ে ৬টা। এসময় হঠাৎ একটি প্রাইভেটকার যোগে তার রিকসার পাশে আসে। আর তিনি কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তার কাছে থাকা একটি ব্যাগ নিয়ে দ্রুত প্রাইভেটকারটি চালিয়ে যায়। উক্ত ব্যাগে ১৫ হাজার টাকা, একটি মোবাইল সেট ও স্বর্ণালংকার ছিল।
এছাড়া মিন্টু নামের এক ফটো সাংবাদিক জানান, গত ১১ জুলাই ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের যাওয়া পথে টানিং পয়েন্ট এলাকায় একটি প্রাইভেটকার তার গতিরোধ করে। একপর্যায়ে তার কাছে থাকে ২টি ক্যামেরা ও ৫ হাজার ২০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসব ভদ্রবেশী অপরাধীরা প্রাইভেটকার নিয়ে বিশেষ করে ভোর বেলায় রিকসা যাত্রীদের জিম্মি করে সবকিছুই ছিনিয়ে নিয়ে যায় বলে ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, ভোরবেলায় যে সব এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, প্রেসক্লাবের সামনে, রেল ভবনের সামনে, হাইকোর্ট মাজার মোড়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে, টিএসসি মোড় এবং বাংলা একাডেমির সামনের সড়কে বেশি ছিনতাই হয়। এসব এলাকার রাস্তাগুলো চওড়া এবং ছিনতাই করে যে কোন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। চলতি বছরের প্রথম দিকেই বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা কয়েকজন নিহত হয়েছেন।
আদালতের সূত্র জানায়, ২০১২ সাল থেকে গত আট বছরে রাজধানীতে ৮৪৬টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। আর এ সময় ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন মোট ৩৬ জন। গত ২০১৮ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় নগরীর বিভিন্ন থানায় ৭৮টি মামলা হয়। আর গত বছর তা বেড়ে হয় ১১৯টি মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। আর বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হওয়া ৩৬ জনের মধ্যে তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এবং হাতিরঝিল এলাকায় ছয়জন খুন হন। আর যাত্রাবাড়ী ও শাহবাগে তিনজন করে এবং মিরপুর, ওয়ারী, বাড্ডা, খিলক্ষেত ও হাজারীবাগে দুজন করে খুন হন। ছাড়া দক্ষিণখান, বনানী, গুলশান, উত্তরা, ধানমন্ডি, খিলক্ষেত, দারুসসালাম, নিউমার্কেট, রমনা, মতিঝিল, শাহজাহানপুর, সবুজবাগ এবং খিলগাঁও এলাকায় একজন করে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন।
২৯ ফেব্রুয়ারির ভোর পাঁচটার দিকে তারিনা বেগম নামের এক নারী তার স্বামী-সন্তানের সঙ্গে রিকশা যোগে রাজারবাগ থেকে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাচ্ছিলেন। তারা দক্ষিণ মুগদা এলাকায় আসার পর একটি প্রাইভেটকারে ওঁৎ পেতে থাকা ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা হঠাৎ তার ব্যাগ ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়। এতে তিনি রিকসা থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মিজানুর রহমানকে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা বনানী থেকে অটোরিকশায় তুলে নিয়ে খুন করে। পরে তার লাশ ফেলে যায় হাতিরঝিলের উড়ালসড়কের ওপর। এ ঘটনার আগে গত ৪ জানুয়ারি টেইলারিং মাস্টার মনির হোসেনকে খিলক্ষেতের কুড়িল উড়ালসড়কের ওপর খুন করে লাশ ফেলে যায় ছিনতাইকারীরা। এ ঘটনায় পুলিশ ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এছাড়া, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাড্ডা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন ইমরান হোসেন নামের এক ব্যক্তি। তার মোবাইল ফোনটি ছিনতাই হয়। রূপনগর এলাকায় খোকন শেখ নামের এক ব্যক্তিকে মারধর করে তাঁর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা।এর আগে গত ১১ জানুয়ারি কামরুল হাসান নামের এক ব্যক্তি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য কারওয়ান বাজারের উত্তরা ব্যাংকের সামনে মোটরসাইকেলে করে আসা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যরা কামরুলকে মারধর করে ৩৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়।
ভুক্তভোগিরা জানান, শাহবাগ ছাড়াও ছিনতাইপ্রবণ এলাকার মধ্যে ওয়ারী থানাধীন টয়েনবী সার্কুলার রোড, খিলগাঁও নাগদারপাড় বাইপাস বিশ্বরোড, কল্যাণপুর বাসস্টান্ডের সামনের সড়ক, ধানমন্ডির সিটি কলেজের সামনের রোড, ঢাকা ময়মনসিংহের কুড়িল উড়ালসড়ক, ফার্মগেট হয়ে খেজুরবাগান মোড় পর্যন্ত। আবার আগারগাঁও পাসপোর্ট থেকে শ্যামলির মোড়, রমনার হাতিরঝিল থেকে মগবাজার মোড়, বারডেম থেকে হোটেল শেরাটন মোড়, এলেনবাড়ী উড়ালসড়ক, যাত্রাবাড়ীর ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে সড়ক (শনির আখড়া) উল্লেখযোগ্য।
এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের সাথে ছিনতাইকারী চক্রের গোলাগুলিতে এক সন্ত্রাসী নিহত হয়েছেন।
জানা গেছে, গত ৩০ জুন মোহাম্মদপুর থানার তাজমহল রোড এলাকা থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা ছিনতাই এর ঘটনায় মামলা হয়। ওই মামলায় গ্রেফতারকৃত দুইজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ভুয়া ডিবি চক্রের মূল হোতা জহিরকে (৩৫) গ্রেফতার করতে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩ টায় বসিলা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশের একটি টিম। এ সময় পুলিশের অবস্থান বুঝতে পেরে সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশও আত্মরক্ষার্থে সন্ত্রাসীদেরকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। উভয়ের গোলাগুলির এক পর্যায়ে এক সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ সন্ত্রাসীকে পুলিশ দ্রুত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি এলজি বন্দুক ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (জনসংযোগ) মো. ওয়ালিদ হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।


বিজ্ঞাপন