চির বিদায় কথাসাহিত্যিক সাংবাদিক রাহাত খান

জাতীয়

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর গভীর শোক
বিশেষ প্রতিবেদক : সাংবাদিক ও কথাশিল্পী রাহাত খান মারা গেছেন (ইন্না ল্লাহি….রাজিউন)। শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় তিনি তাঁর রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে নিজ বাসায় প্রয়াত হন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে ভুগছিলেন।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংবাদিক রাহাত খানের মরদেহ জাতীয় প্রেস ক্লাবে নামাজে জানাজা শেষে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। শনিবার বেলা ১১টায় প্রেস ক্লাবে জানাজা শেষে সাংবাদিকরা শেষ শ্রদ্ধা জানান গুণী এই সাংবাদিকের মরদেহে। এর আগে শুক্রবার রাতে নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রাহাত খান।
কথাসাহিত্যিক ও বরেণ্য সাংবাদিক রাহাত খানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার রাতে পৃথক শোক বার্তায় এ শোক জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখক হিসেবে রাহাত খান মুক্তবুদ্ধির চর্চায় ও সমাজ উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
পৃথক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণীজনের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদানের কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক সম্পাদক রাহাত খানের মৃত্যু গভীর শোক প্রকাশ করেছেন দৈনিক সকালের সময় সম্পাদক ও প্রকাশক মো. নূর হাকিম। শোক বার্তায় তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
অপরদিকে, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খান এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহেদুর রহমানের পাঠানো শোক বার্তায় তিনি মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় মন্ত্রী জানান, রাহাত খান ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক। ছোটগল্প ও উপন্যাস উভয় শাখাতেই তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিক হিসেবেও রাহাত খানের অবদান প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে পাঠকসমাজের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।
এছাড়া, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দু:খপ্রকাশ করেছেন তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে এই বরেণ্য প্রতিভার প্রয়াণে শোকাহত তথ্যমন্ত্রী তার শোকবার্তায় রাহাত খানকে দেশের অনন্য খ্যাতিমান কথাশিল্পী ও সাংবাদিক হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ছোটগল্প উপন্যাসসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে ও ধারাবাহিকভাবে সাংবাদিকতায় তার অবদান স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
মন্ত্রী রাহাত খানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন রাহাত খান। করোনাকালে জটিল চিকিৎসা প্রক্রিয়া হওয়ায় তার সার্জারি করা যাচ্ছিল না বলে বাসাতেই অবস্থান করছিলেন গুণী এই সাংবাদিক। রাহাত খান বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন কথাশিল্পীও। ছোটগল্প ও উপন্যাস উভয় শাখাতেই তার ছিল অবাধ বিচরণ। সাংবাদিক হিসেবেও রাহাত খানের অবদান উল্লেখযোগ্য। ষাটের দশক থেকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক রাহাত খানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রী রাহাত খানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন ও তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। শুক্রবার এক শোকবার্তায় অর্থমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিকতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাসসহ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে তিনি অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। রাহাত খান ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান কথাশিল্পী। তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিককে হারালো। সৃষ্টিশীল প্রতিভা ও অনন্য লেখনীর জন্য এদেশের সাহিত্যপ্রেমীরা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
জাতীয় প্রেসক্লাবে দেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক রাহাত খানের নামাজে জানাজা হয়। শনিবার বেলা ১১টার দিকে জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে মরহুমের নামাজে জানাজা শেষে তার মরদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সর্বস্তরের মানুষ। সকালে মরহুমের জানাজায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন সাহা, বিএফইউজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকারিয়া কাজল, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁইয়া, ডিইউজে’র সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খানসহ মরহুমের পরিবারের সদস্য ও সাধারণ জনগণ।
গত ২০ জুলাই রাহাত খানকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর আগের দিন বাসায় খাট থেকে নামতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান তিনি। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে এক্স-রে করা হলে পাঁজরে গভীর ক্ষত ধরা পড়ে। এর পাশাপাশি তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে তাকে বারডেম হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি করা হয়।
রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হলেও কর্মসূত্রে রাহাত খান আপাদমস্তক সাংবাদিক। তিনি ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান কিছুদিন জোট পারচেজ ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। তারপর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।
১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি। পরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। রাহাত খান ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন।
বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে রাহাত খান কথাশিল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয় প্রকাশিত হয়। তার পরবর্তী উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খেলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি।
ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৯৬) পেয়েছেন।
রাহাত খানের মৃত্যুতে এডিটরস গিল্ডের শোক : একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও প্রবীণ সাংবাদিক, প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক রাহাত খানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছে এডিটরস গিল্ড।
শুক্রবার রাতে সংগঠনটির সভাপতি মোজাম্মেল বাবু এক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার প্রতি মাগফেরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা ও দুঃখ প্রকাশ করেন। এডিটরস গিল্ড সভাপতি বলেন, সাংবাদিকতা ও সাহিত্য জগতে রাহাত খানের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বিজ্ঞাপন