দেনা বাড়ছে চিনি শিল্পে

অর্থনীতি

অবিক্রীত ২৫ কোটি টাকার চিনি
৬ মাস বেতন পাচ্ছে না শ্রমিকরা

 

বিশেষ প্রতিবেদক : দেশের অধিকাংশ চিনি মিলে বাড়ছে দেনা। সরকারের কাছে আখ চাষিরা পাবে বিপুল অংকের টাকা। করোনা মহারির দুর্দিনেও মিলছে না পাওনা টাকা। এ নিয়ে আখ চাষি ও শ্রমিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বিভিন্ন জায়গায় চিনি কলের শ্রমিকরা তাদের পাওনা আদায়ে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। তবে চিনি শিল্পে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহেলায় আখ চাষি ও শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
গত ছয় মাস ধরে বেতন পান না রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন পাবনা সুগার মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এতে প্রায় সাত শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী তাদের পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি জানিয়েছেন মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাবনা সুগার মিলে এখনও ২৫ কোটি টাকা মূল্যের চার হাজার টন চিনি অবিক্রিত অবস্থায় গোদামজাত হয়ে পড়ে আছে। এই চিনি বিক্রি হলে শ্রমিকদের বকেয়ার টাকা পরিশোধ করা যেত। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
১৯৯৬ সালে প্রায় ৬০ একর জমি নিয়ে পাবনা সুগার মিলের যাত্রা শুরু হয়। তবে মিলের নিজস্ব কোনো আখ চাষের জমি নেই। জেলার ৯ উপজেলার আখচাষিদের আখেই চলে মিল। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আবারও শুরু হবে আখ মাড়াই। তবে বর্তমানে বেতন-ভাতা না পাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা। শ্রমিক-কর্মচারী, কৃষক ও আখ সরবরাহকারীদের পাওনা মিলিয়ে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দেনা আছে মিলটি।
বর্তমানে পাবনা সুগার মিলে মিলে নিয়মিত শ্রমিক রয়েছেন ৪শ জন, মৌসুমী শ্রমিক রয়েছেন ২শ জন এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রয়েছেন ১শ জন। শ্রমিক-কর্মচারীরা টানা ছয় মাস কোনো বেতনভাতা পাননি। তাদের বকেয়া এসে দাঁড়িয়েছে আট কোটি টাকায়। আর যারা মিলের আখচাষি রয়েছেন তাদের পাওনা আরও তিন কোটি টাকা।
আফসার আলী সরদার নামে এক আখচাষি বলেন, আমি এই চিনিকলে নিয়মিত আঁখ সরবরাহ করি। পাওনা টাকা ও ভর্তুকিসহ ৭০ হাজার টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। আশ্বাসের পর আশ্বাসেও মিলছে না পাওনা টাকা। পরিবার নিয়ে এই করোনার সময় বেশ কষ্টে দিন অতিবাহিত করছি। অচিরেই বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি জানাই।
মিলের শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমি এখানে লেবার হিসেবে কাজ করি। ছয় মাসের কাজের বিল এখানে পড়ে আছে। কোনোভাবেই টাকা পাচ্ছি না। শুধু কর্মকর্তারা আশ্বাস দেন। বিভিন্ন জনের কাছে ধরণা দিয়েও টাকা তুলতে পারছি না। পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি।
পাবনা সুগার মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসের এই দুর্যোগে টাকা না পেয়ে ক্ষোভ ও হতাশায় দিন কাটছে আখচাষিসহ শ্রমিক-কর্মচারীদের। ছয় মাসের বকেয়া বেতন ও কৃষকের আখ চাষের দাম পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
পাবনা সুগার মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল বলেন, আমরা শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। অচিরেই সমস্ত দেনা পরিশোধসহ চিনি শিল্পকে উন্নত শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
এদিকে বকেয়া বেতনের দাবিতে গত বুধবার (২৬ আগস্ট) সুগার মিলের প্রধান ফটকে ও অফিস কক্ষের সামনে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন শ্রমিক নেতারা। আগামী সাতদিনের মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধ করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
পাবনা সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, গত মৌসুমের অবিক্রিত ২৫ কোটি টাকার চিনি এখনও মজুত আছে। এই চিনি বিক্রি হয়ে গেলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদফতরকে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও কোনো নির্দেশনা আসেনি। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি খুব দ্রুত এই সমস্যার সামাধান হবে যাবে।
গত মৌসুমেও পাবনা সুগার মিল দেনার দায় মাথায় নিয়ে আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু করেছিল। চলতি বছরের নভেম্বর মাসে আবারও নতুন বছরের আখ মাড়াই শুরু হবে।
এর আগে, রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫টি চিনিকলে আখ চাষিদের বকেয়া প্রায় ২০০ কোটি পাওয়ার দাবিতে পাবনা চিনিকলের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করা হয়েছে। আখচাষি কল্যাণ সমিতির পাবনা শাখা এবং বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের উদ্যোগে এই সমাবেশ করা হয়।
চিনিকলের আখচাষি প্রতিনিধিরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সমাবেশে অংশ নিয়ে তাদের ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। অনেক চাষি নিরাশ হয়ে মিল গেটে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে তাদের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী বরাবর বিভিন্ন দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছে দেন।
পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে চিনিকলের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও আখচাষি সমাবেশে বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও আখচাষি কল্যাণ সমিতি পাবনা সুগার মিলস্ লি. এর সভাপতি আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশা ওরফে পেঁপে বাদশা, আখচাষি কল্যাণ সমিতি পাবনা সুগার মিলস্ লি. এর সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী ডিলু, আমজাদ হোসেন মালিথা, মাহাতাব উদ্দিন মোল্লা, হাসান আলী, পাসুমি’র ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম শাহীন প্রমুখ। সমাবেশে বক্তারা বলেন, পাবনা চিনিকলের আখ চাষিদের বকেয়া প্রায় ২০ কোটি টাকা। আর দেশের ১৫টি চিনি কলে আখ বিক্রির পর তাদের পাওনা প্রায় দু’শ কোটি টাকা।
তারা জানান, করোনা সংকটে আজ তারা অনেকেই কর্মহীন। এদিকে তাদের দীর্ঘ ১৬ মাসের ফসল আখ বিক্রি করে ৪ মাস ধরে তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না। জনদরদি প্রধানমন্ত্রী প্রায় ১লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ প্রোগ্রাম ঘোষণা করেছেন। চাষিদের ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফের কথা বলেছেন। অথচ দেশের এই মহাসংকটের সময় প্রায় ৫ লাখ আখচাষি এসব সুবিধার বাইরে। তারা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।
তারা জানান, মিষ্টি জাতীয় খাদ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল আখ। সেই আখ উৎপাদনকারী চাষিরা আজ অভুক্ত। চাষিরা তাদের ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন।
এসব দাবির মধ্যে রয়েছে- নগদ টাকায় আখ নিয়ে চাষিকে আখ চাষে উৎসাহিত করা; আখ চাষের প্রয়োজনীয় উপকরণ- বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ, আখের পরিচর্যা খরচ সময়মতো প্রদান; অর্থ মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী কৃষি ঋণের সুধ-আসল দিগুণের পর চক্রবৃদ্ধি হারে আর না বাড়ানো, তামাদি ঋণ পরিশোধের স্বার্থে সার্টিফিকেট মামলা প্রতাহার করে ঋণ পরিশোধের জন্য দুই বছরের সময় বৃদ্ধি করা; আখের মূল্য পেতে নাজেহাল বন্ধ করে আখ চাষির আখের টাকা পরিশোধের স্থায়ী সমাধানের জন্য ২০০০ (দুই হাজার) কোটি টাকার সিডমানি প্রদান; নিবন্ধিত আখ চাষি হওয়ায় চিনিকলে আখ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আখ চাষের ঋণ ১১ শতাংশ সুদ পরিবর্তন করে প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধাভুক্ত করা, জাতীয় বাজেটে রোপা পদ্ধতিতে আখ চাষ; মুড়ি বা সরাসরি সকল পদ্ধতিতে আখ চাষে স্থায়ী ভর্তুকি কৃষি মন্ত্রণালায়ের পরিবর্তে শিল্প মন্ত্রণালয়ে মাধ্যমে প্রদান এবং কৃষি ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ দেশের সকল কৃষকের স্বার্থে জিও, এনজিও, অর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তফসিলি ব্যাংক থেকে নেয়া কৃষি ঋণ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতা দুই বছর করা।
ঈশ্বরদীর পাকুড়িয়া গ্রামের ৭০ বছরের বেশি বয়সী আখ চাষি আব্দুল মালেক মালিথা বলেন, আমি ২৫-৩০ বিঘা আখ চাষ করি। আর চাল কিনে খাই। ১৬ মাস ধরে পরিচর্যা করে আখ পাই। অথচ সেই আখ বিক্রির টাকা পচ্ছি না। চলতি করোনা দুর্যোগে ও রমজানে টাকার প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও তা পাচ্ছি না। সন্তানদের লেখাপড়ার চাহিদা মেটাতে আর পাওনাদারদের চাপে আমরা দিশেহারা।
ঈশ্বরদীর সাড়া গোপালপুর গ্রামের আখচাষি মাহাতাব মোল্লা জানান, আমরা চরম সমস্যায় আছি। ১৬ মাস ধরে ফসল চাষ করে মিলে আখ দিয়ে টাকা পাচ্ছি না। এতে জমিতে নতুন আখ ক্ষেতেরও পরিচর্যা করতে পারছি না।
বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও আখচাষি কল্যাণ সমিতি পাবনা সুগার মিলস্ লি. এর সভাপতি আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশা জানান, সাংসারিক সমস্যার পাশাপশি তারা টাকার অভাবে অন্য ফসল পর্যন্ত চাষবাস করতে পারছেন না। এখন আখ চাষের পরিচর্যা করার জন্য বাড়তি টাকা দরকার হচ্ছে। অথচ তারা চার মাস আগে চিনিকলে আখ বেচেও টাকা পাচ্ছেন না। অর্থাভাবে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
তিনি চলতি মুজিববর্ষে ৫০০ কোটি টাকার আপদকালীন তহবিল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তার লিখিত বক্তব্যে ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন। পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমদ বলেন, পাবনা চিনিকলে প্রায় ৫ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন চিনি অবিক্রিত রয়েছে। ফলে আর্থিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আর এ সমস্যা সারা দেশেই। তিনি আখ চাষিদের দুরাবস্থার কথা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন বলে জানান। পরে আখ চাষিদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী বরাবর করা এসব দাবি সম্বলিত একটি স্মারকলিপি পাবনা জেলা প্রশাসকের কাছে দেন।


বিজ্ঞাপন