জনস্বাস্থ্যের পরিচালক রহিম এখনও বহাল

অপরাধ এইমাত্র স্বাস্থ্য

সরকারের দূরদর্শিতায় ফরমান বাতিল


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : সরকারের দূরদর্শিতায় তালেবান স্টাইলের ফরমান বাতিল হলেও এখনও বহাল রয়েছেন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম।
সরকারি বিধি নয়, নিজের নিয়মে প্রতিষ্ঠান চালাতে চাচ্ছিলেন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. আবদুর রহিম। সেজন্য গত বুধবার এক বিতর্কিত অফিস আদেশ জারি করেন তিনি। তাতে এ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দুই ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে সবাইকে অফিস চলাকালীন মোবাইল ফোন ‘সাইলেন্ট’ বা ‘বন্ধ’ রাখতে বলা হয়। পাশাপাশি মুসলিম ধর্মাবলম্বী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোশাকের ব্যাপারেও নিয়ম জারি করা হয়। সেখানে বলা হয়Ñ ‘মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য পুরুষ টাকনুর ওপরে (গোড়ালির ওপর) এবং মহিলাদের হিজাবসহ টাকনুর নিচে কাপড় পরিধান করা আবশ্যক এবং পর্দা মানিয়া চলার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
গত বুধবার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তির অনুলিপি প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক বিভাগে অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়।
গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি জানাজানির পর সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগসহ বিভিন্ন মহলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা দেখা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গতকাল সকালেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবকে এ ব্যাপারে জানান অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। পরে দুপুরের মধ্যেই পরিচালককে এমন নির্দেশনা জারির জন্য কারণ দর্শানোর নোটিস দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শারমিন আক্তার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে পরিচালকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এমন বিজ্ঞপ্তি তিনি কোন বিধিবলে ও কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জারি করেছেন তার স্পষ্টকরণ ও ব্যাখ্যা আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে দিতে হবে।
পরে রাত ১০টার দিকে পোশাক নিয়ে নির্দেশনাটি বাতিল করে ক্ষমা চান পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম। রাতে দেওয়া আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে তিনি আগের নির্দেশনা বাতিলের কথা জানান। নতুন বিজ্ঞপ্তিতে আবদুর রহিম বলেন, ‘উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সংবাদটির জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত এবং সবার কাছে অনিচ্ছাকৃত এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে গোটা জাতির কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল হবে না বলে প্রতিজ্ঞা করছি।
এদিকে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, পরিচালক শুরু থেকেই পোশাক ও পর্দার ব্যাপারে নানা ধরনের মৌখিক বিধিনিষেধ আরোপ করে আসছিলেন। বিভিন্ন সময় তিনি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নানা ধরনের নির্দেশনা দিতেন। এমনকি চলতে-ফিরতে প্রকাশ্যেও তিনি নানা ধরনের কথাবার্তা বলতেন। তবে এসব বিধিনিষেধ তিনি কাউকে মানাতে পারছিলেন না। ফলে গত বুধবার তিনি নোটিস জারি করেন এবং বিভিন্ন কক্ষে কক্ষে কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান। এতে ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে প্রচ- ক্ষোভ দেখা দেয়।
আরও যত অনিয়ম : তার বিরুদ্ধে ফ্লাট বরাদ্দে অনিয়ম, কর্মচারিদের হেনস্থা, বদলী বাণিজ্য, করোনা কালীন ভাতা প্রদানে অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রে জানা যায়, পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম কর্মচারীদেরকে কথায় কথায় বান্দরবানে বদলী ও বেতন বন্ধের হুমকি দেন। এছাড়া করোনা কালীন সময়ে তার অনুসারী কর্মকর্তারা মাসের পর মাস অফিসে না আসলেও কোন জবাবদিহিতা করা হয় না। কিন্তু অন্য কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সেটি ভিন্ন। অসুস্থ থাকলেও তাদেরকে অফিসে যেতে হয়। অসুস্থতার কারণে তারা অফিসে যেতে না পারলে মৌখিকভাবে বেতন বন্ধ করে হেনেস্থা করা হয়। পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে সেই বিল পাস করেন তিনি।
এছাড়া সরকারের ছুটির নির্দেশ থাকা সত্বেও কর্মচারীকে অফিসে আসতে বাধ্য করেন তিনি। নিজে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরেও অফিসে এসেছিলেন তিনি এবং তার রুমে সকল কর্মচারীদের ডেকে খারাপ আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শতাধিক কর্মচারী করোনায় আত্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছে ২জন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিচালকের সাথে বিশেষ রফায় অনেকে অফিসে না এসে বা করোনা সংশ্লিষ্ট কোন কাজে যুক্ত না থেকেও সরকারের বিশেষ প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। সূত্র মতে, এখন পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ৯৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে করোনাকালীন ভাতা প্রদাণ করা হয়েছে। যেখানে কিনা ভাতা পাওযার যোগ্যতা রাখে মাত্র ২০জন।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, কোন বিধান না থাকা সত্বেও সমস্ত স্টাফদের সার্ভিস বই বাসায় নিয়ে যায় ডা. মুহাম্মদ আব্দুর রহিম। ফলে কারো ছুটির প্রয়োজনে, অগ্রীম লোন বা অন্যান্য প্রয়োজনে তার সাথে দেখা করে বিশেষ রফায় ফাইল ফেরত নিতে হয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত ফাইল থাকাবে অফিসে বিশেষ ব্যবস্থায়।
এদিকে নিয়োগ বাণিজ্যেও সমান পারদর্শী পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম। অভিযোগ রয়েছে আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে নিয়োগকৃত ৫০জন কর্মচারীর মধ্যে ২০জনের বাড়ি তার নিজ এলাকা মাইজদিতে।
এছাড়া অনিয়মের মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী শহিদুল ইসলাম মিয়াকে সহ প্রকৌশলী পদে পদায়ন এবং উচ্চমান সহকারী (চলতি দায়িত্বে সিকিউরিটি অফিসার) মো. জামান আহম্মেদ জুনিয়র কর্মচারী হওয়া সত্বেও প্রধান সহকারীর পদে পদায়ন করেছেন তিনি।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বাসা বরাদ্দের কোনো নিয়মনীতিই মানেন না পরিচালক। বাসা বরাদ্দ কমিটিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে টাকার বিনিময়ে নিজের ইচ্ছামত বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেখা গেছে, যারা বাসা পাওয়ার যোগ্য না টাকার বিনিময়ে তাদেরকেও দেওয়া হয় বাসা। এভাবে অবৈধভাবে বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
টাকার বিনিময়ে বাসা বরাদ্দ পেয়েছে যারা:
(ক) মো. শাহীন কাদিরের নামে আইপিএইচ ২৪ ইউনিটে ১টি সরকারি বাসা আছে। তিনি সেই বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যত্র থাকেন। তার পরেও তিনি ১লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে আইপিএইচ এস ১/এ নতুন করে বাসা বরাদ্দ করান। ১/এ বাসায় যিনি থাকেন তার চাকরি ২০২৫ সাল পর্যন্ত আছে।
খ) খালেদা বেগম। তিনি বর্তমানে যে বাসায় থাকেন, সেই সরকারি বাসাটি প্রথমে তার নামে ছিল। পরে তার ছেলের নামে পরিবর্তন করিয়েছেন খালেদা বেগম। বর্তমানে ১লাখ টাকার বিনিময়ে নতুন করে আরেকটি সরকারি বাসা বরাদ্দ করিয়েছেন খালেদা বেগম।
গ) গাড়ি চালক মো. আনিছুর রহমান ভূঁইয়া একটি সরকারি কোয়াটারে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। তার পরেও টাকার বিনিময়ে আরেকটি বাসা বরাদ্দ করান তিনি। যেটি কিনা ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বাসা।
ঘ) উচ্চমান সহকারি মো. তফাজ্জল হোসেন ২লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে একটি ১ম শ্রেণীর বাসা বরাদ্দ করিয়েছেন।
ঙ) মো. নুরুল ইসলাম স্বপন, মো. তাজুল ইসলাম, বিউটি খাতুন, ল্যাব এ্যাটেন্ড অমল চন্দ্র দাস, মালি পদের মো. মোখলেছুর রহামান, পেকার পদের মো. রফিকুল ইসলাম ১লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারি বাসা বরাদ্দ করিয়েছেন।
চ) ল্যাববেয়ারার পদের মো. জাফর আলী সিকদার ১লাখ ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে সরকারি বাসা বরাদ্দ করিয়েছেন।
ছ) নিরাপত্তা শাখার মো. সোহরাব হোসেন ও গাড়ি চালক মো. জাহাঙ্গীর ২ লাখ টাকা দিয়ে সরকারি বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন।
জ) সহিস পদের মো. ফারুক খান (বর্তমানে ক্যাশিয়ারে দায়িত্ব) আইপি এইচ এস ২৬নং বিল্ডিং (২০ ইউনিট) সরকারি বাসা বরাদ্দ পান। সেখানে তিনি বসবান না করে ভাড়া দিয়েছেন। তারপর তিনি আইপিএইচ পোল্ট্রি ফার্মের ভিতরে নতুন করে পরিচালকে ১ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে বাসা বরাদ্দ করিয়েছেন। তার ২য় স্ত্রী জাতয়ি চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালের নার্স। তার নামেও রয়েছে ১টি সরকারি বাসা।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবদুর রহিম বলেন, কাজ করতে গেলে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়। আপনারা ভালো জিনিসগুলো তো লিখেন না। আমার সাড়ে ৫৭ বছরের অভিজ্ঞতায় ভালো কিছু লিখতে দেখি নাই। আপনাদের যা ইচ্ছে তাই লেখেন।