দায়িত্বে নেই বলেই খালাস বিদায়ী পিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আমি এখন আর এই প্রকল্পের দায়িত্বে নেই, তাই প্রকল্পের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না’ সেকশন নির্মাণে ধীরগতি প্রসঙ্গে প্রকল্পের সদ্য বিদায়ী প্রকল্প পরিচালক মো. তানভিরুল ইসলাম এমন মন্তব্য করেন। এক বা দুই বছর নয়, একে একে কেটে গেছে ৯টি বছর। অথচ এই দীর্ঘ সময়ে রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৭ শতাংশ। প্রকল্পটির কাজ শেষে করতে বাড়তি আরও ৯ বছর সময় লাগবে।
অথচ যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে প্রধানমন্ত্রীর তাগিদ থাকলেও এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে সে তাগিদ কোনো কাজে আসেনি। প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক বলেছেন, তিনি সবেমাত্র দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই সবকিছু বুঝে না নিয়ে তিনি কোনো কথা বলতে পারবেন না। আর সদ্য বিদায়ী প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, তিনি যেহেতু এই প্রকল্পের সঙ্গে আর নেই, সে কারণে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।
জানা গেছে, ২০১১ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। শুরু থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ও বাস্তব অগ্রগতি মাত্র প্রায় ১৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রমের প্রায় ৮৩ শতাংশ এখনও বাকি। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা মাত্র শূন্য ৯ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে আরও প্রায় ৯ বছর সময়ের প্রয়োজন হতে পারে।
১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকার টাকার প্রকল্প ২০১৫ সালে সংশোধন করে ৬৭৮ কোটি টাকা হয়। মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটিতে ভারতীয় ঋণ ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফরের সময় প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৯৬ সালের ৪ ডিসেম্বর চালু হয় সেকশনটি। এটি ভারতের আসাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত। তবে দীর্ঘ ১০৬ বছর চালু থাকার পর বাজেট স্বল্পতার কারণে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এক সময় ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে সেকশনটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনটি ২০০২ সালের ৭ জুলাই বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০১১ সালে মিটারগেজ লাইন সংস্কার করে সেকশনটি চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। এ লক্ষ্যে ১১৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ মে প্রকল্পটি প্রথম সংশোধন করে ৬৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে জুন ২০১৭ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এ প্রকল্পটির ওপর চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভা প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত মোট ব্যয় হয়েছে ১১২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিলের ১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা এবং ঋণ থেকে ৯৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। জুন ২০২০ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ১৭ শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৬১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের দুই মাসে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৯ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের আওতায় কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের মধ্যে মেইন লাইন ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার ও লুপ লাইন ৭ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। নতুন ৬০ কেজি রেল ও পিসি স্লিপার দ্বারা ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল লাইনে পুনর্বাসন করা হবে। বিদ্যমান ৬টি (বি ক্লাস ৪টি ও ডি ক্লাস ২টি) স্টেশন ভবন নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ এবং প্লাটফরম নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান ৫৯টি রেল সেতু নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে মেজর ১৭টি ও মাইনর ৪২টি সেতু নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ করা হবে। নন-ইন্টারলকড কালার লাইট সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ কাঙ্খিতভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
সর্বশেষ বর্ধিত সময়সীমা অনুযায়ী প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ এ সমাপ্ত হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীর অগ্রগতির কারণ অনুসন্ধান, পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
প্রকল্পের কাজ সঠিক সময়ে সম্পন্ন করার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন সক্ষমতা উন্নীত করতে হবে এবং চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অগ্রগতি বৃদ্ধি করতে হবে। পরবর্তী সভায় প্রকল্পের আওতাভুক্ত রেললাইন নির্মাণ, স্টেশন ভবন নির্মাণ, প্ল্যাটফরম নির্মাণ, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি কার্যক্রমের জুন ২০২০ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি এবং অবশিষ্ট কাজের সময়ভিত্তিক বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা ও অগ্রগতির বিবরণ উপস্থাপন করতে হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ধীর অগ্রগতির কারণ অনুসন্ধান করে পর্যালোচনা ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদানের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) এর নেতৃত্বে রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পরিকল্পনা কমিশন, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিনিধি এবং প্রকল্প পরিচালককে নিয়ে একটি অন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করতে হবে।
এদিকে, অবহেলায় পড়ে থাকা রেলের উন্নয়নে নজর দিয়েছে সরকার। এ মুহূর্তে বড় বড় ৪০টিরও বেশি প্রকল্পের কাজ চলছে। তবে প্রকল্প শুরুর পর ব্যয় বৃদ্ধিসহ নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কোনও কোনও প্রকল্পে ২শ’ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির নজির আছে।
পদ্মা সেতুর দুই পাড় ও ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের খরচ ৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এর এক বছর পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে নতুন লাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারের খরচ ধরা হয় ৪৪ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
টঙ্গী-ভৈরব বাজার ডাবল লাইনে নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ২শ’ গুণ, সময় লেগেছে ১৪০ শতাংশ বেশি। লাকসাম থেকে চিকনী পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ব্যয় বেড়েছে ২শ’ ৬০ শতাংশ। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল লাইন নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮শ’ ৪৭ কোটি টাকা। ২০১২ সালের এ প্রকল্পে আবার ৩শ’ কোটি টাকা বাড়লেও কাজ এগোয়নি। কয়েকটি ছোট কালভার্ট নির্মাণ ছাড়া লাইন নির্মাণে খুব একটা অগ্রগতি নেই।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, যখন আপনি কাজ করতে গেলেন, তখন দেখবেন যে ওই বাজেটে কাজ হচ্ছে না। স্টেশন বিল্ডিং করা হচ্ছে তখন যদি বলা হয় এ ধরনের নয় অন্যভাবে করতে হবে। তখন কিন্তু আমাদের চাহিদার উপর নির্ভর করে কিছুটা ভেরিয়েশন আসে। তিনি আরো বলেন, সব প্রকল্পেই জটিলতা থাকে। তাই নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করাটা কঠিন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবতার সাথে মিল রেখেই প্রকল্প নেয়া উচিত। বুয়েটের গণপরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, যেটা আমরা আস্তে আস্তে দেখতে পাচ্ছি প্রজেক্টের আওতায় যারাই জড়িত তারাই ভেনিফিসিয়ারি হয়ে যাচ্ছেন। তখন সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আসলে অ্যাকাউনটিবিলিটা তাহলে কে আদায় করবে? এটা কিন্তু শঙ্কার ব্যাপার, এটা কিন্তু ভাবনার ব্যাপার। তবে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেল যোগযোগ নতুন মাত্রা পাবে বলে আশাবাদী রেল কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, দেশের জরাজীর্ণ রেলব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত প্রায় এক দশকে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় পৃথক ‘রেলপথ মন্ত্রণালয়’ গঠন করা হয়েছে ২০১১ সালে। আওয়ামী লীগের সব শেষ দুই মেয়াদে পর পর তিনজন মন্ত্রী হাল ধরেছেন মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বেগতির রেলে গতি আর আসছে না। গৃহীত প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগই চলছে ঢিমেতালে। প্রকল্প ঝুলে থাকায় দাতাদের অনেকে অর্থ প্রত্যাহারও করে নিয়েছে।