বাবা আর আসবে না?

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় সারাদেশ

এএসপি করিমের ৩ বছরের ছেলের প্রশ্ন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : এমন হাসিখুশি পরিবারে এখন বিষাদের ছায়া। পিতার কোলে আর যেতে পারবে না ছোট্ট শিশুটি। শিশুটি জানেও না তার পুলিশ অফিসার বাবা কখনো ফিরবে না। তিনি নিথর হয়ে গেছেন। পৃথিবীর নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে না ফেরার দেশে বাবা। রাজধানী আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম শিপনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে তার পরিবার। বাড়িজুড়ে কান্নার রোল। এদিকে একমাত্র সন্তান সাফরানকে (৩) নিয়ে শোকে স্তব্ধ এএসপি করিমের স্ত্রী শারমীন। আনিসুল করিম সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে বরিশাল মহানগর পুলিশে (বিএমপি) কর্মরত ছিলেন। বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়।
মানসিকভাবে অসুস্থ এএসপি আনিসুল করিমকে সুস্থ করে তুলতে ঢাকায় নিয়ে আসেন স্বজনরা। ভর্তি করা হয় আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে। কিন্তু মুহূর্তেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। সুস্থতার পরিবর্তে গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে ফেরে আনিসুল করিমের নিথর দেহ। অকালে স্বামীকে হারিয়ে শারমীনের রঙিন জীবনে যেন আমবস্যার রাত নেমে এসেছে। এদিকে তিন বছর বয়সী সাফরান বাবাকে খুঁজছে। মাঝে মাঝে মাকে প্রশ্ন করছেন, ‘বাবা আর আসবে না?’ এ মৃত্যু কোনোভাবে মেনে নিতে পারছেন না এএসপি করিমের স্বজনরা। তার আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীরা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেন।
মঙ্গলবার সকালে গাজীপুরে নিজ গ্রামে দাফন সম্পন্ন হয়েছে আনিসুলের। জানাজা শেষে আনিসুলের প্রতি ফুলেল শ্রদ্ধা জানান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সাধারণ মানুষ।
আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল বলেন, আনিস কিছুটা মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। সোমবার দুপুরে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে যান। কাউন্টারে যখন ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন, তখন কয়েকজন কর্মচারী তাকে দোতলায় নেন। কিছুক্ষণ পর আনিসুল অজ্ঞান হওয়ার খবর পান। সেখান থেকে তাকে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইনিস্টিউটিটে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আনিসের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ হলে হাসপাতাল থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে আদাবর থানা পুলিশ। এতে দেখা যায়, দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে টানাহেঁচড়া করে একটি রুমে ঢোকানো হয়, সেখানে হাসপাতালের ৬ কর্মচারী মিলে তাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। এরপর নীল পোশাক পরা আরো দু’জন কর্মচারী পা চেপে ধরেন। তার মাথার দিকে থাকা দু’জন কর্মচারী হাতের কনুই দিয়ে আঘাত করেন।
এ সময় হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। পরে একটি নীল কাপড়ের টুকরো দিয়ে আনিসুলের হাত বাঁধা হয়। কয়েক মিনিট পর তিনি জ্ঞান হারান। রেজাউল করিম আরো বলেন, আনিসুলের ব্লাডপ্রেসার ও হৃদরোগ ছিল। কিন্তু এ দুটির কোনোটিই মারাত্মক ছিল না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গণপিটুনিতে তার ভাই মারা গেছেন।
এদিকে ওই হাসপাতাল থেকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তা যাচাই করেছে পুলিশ। ওই ফুটেজের বর্ণনা দিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে সকাল ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে টানাহেঁচড়া করে হাসপাতালটির একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। এ সময় হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে তাঁকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। তখন নীল পোশাক পরা আরো দুজন কর্মচারী তাঁর পা চেপে ধরেন। আর মাথার দিকে থাকা দুজন কর্মচারীকে হাতের কনুই দিয়ে তাঁকে আঘাত করতে দেখা যায়। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা ছিল। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয় তখনই তাঁর শরীর নিস্তেজ ছিল। একজন কর্মচারী তখন তাঁর মুখে পানি ছিটালেও আনিসুল নড়াচড়া করছিলেন না। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রন পরা এক নারী কক্ষটিতে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষটির দরজা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৩ মিনিটের মাথায় তাঁর বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই নারী।
হাসপাতালের সমন্বয়ক ইমরান খান জানান, জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট থেকে আনিসুল হককে তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। ভর্তির পরপরই তিনি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করছিলেন। মারধর করছিলেন যাকে-তাকে। শান্ত করার জন্য তাঁকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজের বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে মারধরের বিষয়ে জানতে জাইলে তিনি বলেন, ওই সময় তিনি হাসপাতালে ছিলেন না।
রাজধানীর আদাবরের যে মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কর্মচারীদের পিটুনিতে এএসপি আনিসুল করিম নিহত হয়েছেন, সেটির কোনো লাইসেন্স নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ‘মাইন্ড এইড’ নামের ওই মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রটি এতদিন মানসিক চিকিৎসক ছাড়াই চলছিল। কোঅর্ডিনেটর, কোম্যানেজার ও ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে হাসপাতাল চালাচ্ছিল পরিচালক পর্ষদ।
তিনি বলেন, হাসপাতালটির কোনো কাগজপত্র নেই, ডাক্তার নেই। এ ধরনের হাসপাতাল চালানোর জন্য যেসব লাইসেন্স থাকা দরকার, তা নেই। মাদকদ্রব্য অধিদফতরের কোনো লাইসেন্সও তাদের নেই।
ডিসি হারুন বলেন, হাসপাতালটির পরিচালক পর্ষদ কোঅর্ডিনেটর, কোম্যানেজার ও ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে হাসপাতাল চালাচ্ছিল; যারা মেডিকেলে লেখাপড়া করেনি। আমরা সবাইকে গ্রেফতার করেছি। এখন তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। হাসপাতালটিতে একজন রোগী আছে। তিনি চলে গেলে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় মানসিক হাসপাতাল থেকে হঠাৎ করে রোগীটা কীভাবে মাইন্ড এইড হাসপাতালে চলে গেল? এ দুই হাসপাতালের সঙ্গে কোনো দালাল জড়িত আছে কিনা, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। মাইন্ড এইড হাসপাতালের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ডিসি হারুন বলেন, আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। হাসপাতালের মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তদন্তের পর বিস্তারিত সব জানানো হবে।


বিজ্ঞাপন