নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকা দক্ষিণের দেখাদেখি এবার গৃহস্থালীর বর্জ্য সংগ্রহে টেন্ডারে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশনও। দুই সিটির এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নামতে যাচ্ছেন ঢাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ, কাউন্সিলর ও দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা দিতেই বর্জ্য সংগ্রহের কাজ টেন্ডারে পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছে সিটি করপোরেশন। এমনটা হলে কাজ হারানোর আশঙ্কা করছেন প্রায় ৮ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করেছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সংগঠন প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার (পিডব্লিউসিএসপি)। সংগঠনটি জানিয়েছে, শুরু থেকেই নগরীর বাসাবাড়ি থেকে ভ্যান সার্ভিসের মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহ করে করপোরেশনের ডাস্টবিনে পাঠাচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এর মধ্যে পিডব্লিউসিএসপি কর্মীরা বর্জ্য সংগ্রহ করে তা সরাসরি কন্টেইনারে পৌঁছে দিলেও করপোরেশনের কর্মীরা শুধু রাস্তাঘাটই পরিষ্কার করে।
তারা আরও জানান, ২০০০ সাল থেকে করপোরেশনের অনুমোদন নিয়েই সেবাটি দিয়ে যাচ্ছে পিডব্লিউসিএসপি। এজন্য প্রতি বাড়ি মাসে ৩০ টাকা করে আদায় করার অনুমতিও দেয় সিটি করপোরেশন। এই অর্থ দিয়ে কর্মীদের বেতন ও ভ্যান সার্ভিসের অন্যান্য খরচ বহন করা হতো। এখন সংগঠনটির অধীনে প্রায় ৮ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজ করছে। টেন্ডারের মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ পরিচালনা করায় এরই মধ্যে ডিএসসিসির চার হাজার কর্মী কাজ হারিয়েছে।
অপরদিকে ডিএসসিসির মতো উত্তর সিটি করপোরেশনও গতবছরের ১৭ ডিসেম্বরের বোর্ডসভায় টেন্ডারে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে তিন বছরের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হবে। গ্রেডিং পদ্ধতিতে কাজের মান যাচাই করে প্রতি বছর নবায়ন করা হবে চুক্তি। এর জন্য প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রতিটি ভাগের জন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে সিটি করপোরেশনকে দুই লাখ করে টাকা দিতে হবে। টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নগরীর পুরাতন ওয়ার্ডের প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে ১০০ টাকা ও নতুন ওয়ার্ড থেকে ৫০ টাকা করে নেবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উত্তর সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী টেন্ডারপ্রাপ্ত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সকাল ১০টা হতে বিকেল ৪টার পর্যন্ত বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করতে হবে। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে বিকেল চারটার পর বর্জ্য সংগ্রহ করা।
অবশ্য দক্ষিণ সিটির নিয়মকানুন মানছে না অনেক প্রতিষ্ঠান। ১০০ টাকার পরিবর্তে কোথাও কোথাও ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ পিডব্লিউসিএসপির।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, ‘কার্যাদেশের জামানত হিসেবে ১ থেকে ৩৬ নং (পুরাতন) ওয়ার্ডের প্রতিটি গ্রুপ কাজের জন্য চুক্তি সম্পাদন ও কার্যাদেশ প্রদানের আগে মেয়রের হিসাবে নগদ ৬ লাখ টাকা জামানত (ফেরতযোগ্য) দিতে হবে। এ ছাড়া ৩৭ থেকে ৫৪ নং ওয়ার্ডের (নতুন) প্রতিটি গ্রুপে কাজের জন্য ৩ লাখ টাকা পে অর্ডারের মাধ্যমে জমা দিতে হবে। পাশাপাশি কার্যাদেশ পাওয়ার আগে পুরাতন ওয়ার্ডের জন্য দুই লাখ ও নতুন ওয়ার্ডের জন্য এক লাখ টাকা করে সিটি করপোরেশনকে দিতে হবে।’
দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংক সলভেনসি সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সনদ ও টিন সনদসহ আরও কিছু কাগজপত্র দিতে হবে। এ ছাড়া স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, রাজস্ব কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সহকারী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার প্রত্যয়ন লাগবে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য এসব সনদপত্র সংগ্রহ খুবই কঠিন বলে মনে করছেন পিডব্লিউসিএসপি। এতে অবৈধ অর্থ লেনদেনের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
সংগঠনটি বলছে, সমাজের একেবারের নিন্ম আয়ের মানুষগুলো বর্জ্য সংগ্রহের কাজে জড়িত। তাদের এতো অর্থ ও কাগজপত্র নেই। যে কারণে তারা টেন্ডারে অংশও নিতে পারবে না। আর সিটি করপোরেশন এসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে কাউন্সিলর ও দলীয় নেতাকর্মীদের সুবিধা দিতে। এভাবে টেন্ডারে কাজ হলে কোনও পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা তাদের সংগঠন কাজ পাবে না। ফলে আরও কর্মী জীবিকা হারাবেন।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানিয়েছেন, ভ্যান সার্ভিস মালিকদের সমন্বয় করতে পিডব্লিউসিএসপিকে ফাউন্ডেশন করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তদারকির দায়িত্ব দেন ডিএনসিসির প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। সম্প্রতি আনিসুল হকের দেওয়া সেই অনুমতি নবায়ন বন্ধ রাখে ডিএনসিসি।
পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা আরও বলছেন, প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই কাউন্সিলর ও তার লোকজন তাদের ময়লা সংগ্রহ করতে দিচ্ছে না। তাদের দখলদারিত্বকে বৈধতা দিতেই এমন টেন্ডারের আয়োজন করা হয়েছে। এবার ময়লাতেও হাত দিতে চান তারা।
জানতে চাইলে পিডব্লিউসিএসপি’র সভাপতি নাহিদ আক্তার লাকী বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে রাজধানী ঢাকাতে পিডব্লিউসিএসপির কর্মীরা বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে আসছে। এই সেবায় প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কর্মী জড়িত। এরা অত্যন্ত গরিব। কিন্তু তাদের কথা বিবেচনা না করে এরই মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রতিটি ওয়ার্ডে টেন্ডার দিয়ে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরাও চাই পুরো কাজটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসুক। কিন্তু টেন্ডারে নয়। কারণ টেন্ডারে দিলে গরিব লোকগুলো অভুক্ত থাকবে। তারা এসব কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পারবে না, কাজও পাবে না। তাই টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে আমরা মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করবো।’
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস এম শফিকুর রহমান বলেন, ‘বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্জ্য সংগ্রহের কাজ টেন্ডারে দেওয়া হয়েছে। সেক্টরটিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
কাউন্সিলর ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ভ্যান সার্ভিস দখল করে নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তাদের কর্মীদের হাতে হামলার শিকারও হয়েছেন অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বর্জ্যবহনকারী ভ্যান আটক রাখারও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি সিটি করপোরেশনের কাছে একাধিকবার জানিয়েও প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের।