প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নেই প্রয়োজন, টাকা হলেই সনদ!

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় রাজধানী শিক্ষাঙ্গন

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, বুয়েটসহ কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাগত যোগ্যতারই প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু টাকা। আর এই টাকা হলেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিকেল কলেজের সার্টিফিকেট।
শুধু তাই নয়, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিদ্যুৎ বিল, ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ যেকোনো সার্টিফিকেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জানান, দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট হাতে লিখে দেয়া হলে এই জাল সার্টিফিকেট ব্যবসায়ীদের রোধ করা সম্ভব হবে।
রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় এসব সার্টিফিকেট কেনাবেচার মহোৎসব চলে। শুধু নীলক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নেই এই জাল সাটিফিকেট কেনাবেচার চক্রের দৌরাত্ম্য, এখন পুরো রাজধানীতেই ছড়িয়ে পড়েছে। নীলক্ষেতে দিনের চেয়ে রাতে বেশি চলছে এ অবৈধ কর্মকা-। বিভিন্ন কৌশল, প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধু এই চক্র অবৈধ কর্মকা- চালিয়েই যাচ্ছে। সেখানে জাল সার্টিফিকেট তৈরির সময় হাতেনাতে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতাররা হলেন, মো. রাকিব হাসান (২৩) ও মো. মোবারক হোসেন জনি ওরফে হৃদয় (২৫)। এসময় তাদের কাছ থেকে জাল সার্টিফিকেট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম এবং এসএসসি, এইচএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার জাল সার্টিফিকেট জব্দ করা হয়েছে। র‌্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি আবদুল্লাহ আল মামুন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে একটি সিপিইউ, একটি মনিটর, পাঁচটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, একটি রাউটার, ১৭টি শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট ও তিনটি ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরির শাপলা জল ছাপ দেয়া সাদা কাগজ। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার রাতে অভিযান চালিয়ে নীলক্ষেতের বাকুশাহ হকার্স মার্কেটের ‘ভার্সিটি মাল্টি-কালার’ নামের দোকান থেকে জাল সার্টিফিকেট তৈরির সময় তাদের গ্রেফতার করা হয়। দোকানটি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, অনার্স, ডিগ্রি, মাস্টার্স পর্যায়ের ভুয়া সার্টিফিকেট ও মার্কশিট তৈরি করে তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করত। গ্রেফতারকৃতরা র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা নিজেদের কম্পিউটারে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে ফটোশপ সফটওয়্যার ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে আসছিল। এসব জাল সার্টিফিকেট দিয়ে বিভিন্ন সরকারি ও প্রাইভেট কোম্পানির বিভিন্ন পদে চাকরির জন্য লোকজনের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে তারা তৈরি করত। তাদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৭ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-১০সদস্যরা অভিযান চালিয়ে জাল সার্টিফিকেট প্রস্তুতকারী চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন মো. মোখলেছুর রহমান (৩৭), মো. কামাল হোসেন (৩৮) ও মো. সোহরাব হোসেন (২২)। এদের কাছ থেকেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ডের জাল সার্টিফিকেট ও জাল সার্টিফিকেট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব-১০, সিপিসি-৩, লালবাগ ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। নীলক্ষেত ৩১নম্বর সিটি কর্পোরেশন মার্কেট, নীলক্ষেত ডায়ালকম ইন্টারন্যাশনাল নামক দোকানের ভেতর থেকে প্রচুর পরিমাণে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা বোর্ডের জুনিয়র দাখিল, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্স সার্টিফিকেট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ও ব্যবসা প্রশাসনের বিবিএ সার্টিফিকেট, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজসমূহের এমবিবিএস সার্টিফিকেট, প্যারা মেডিকেল বোর্ডের সার্টিফিকেট, ডেন্টাল কলেজসহ ডিপ্লোমা কলেজসমূহের যাবতীয় সার্টিফিকেট তৈরি চক্রের তিন সদস্যকে আটক করা হয়। আটককৃতদের কাছ থেকে জাল সার্টিফিকেট তৈরির কাজে ব্যবহৃত দুটি কম্পিউটার মনিটর, দুটি সিপিইউ, দুটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার মেশিন, দুটি মাউস ও দুটি কী -বোর্ড, পেন ড্রাইভসহ সফট কপি ও হার্ডকপির বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এবং পাঁচটি জাল সার্টিফিকেটের কাগজপত্রাদি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত মো. মোখলেছুর রহমানের বাবার নাম আব্দুল খালেক হাওলাদার। পটুয়াখালী জেলার বাউফলের বৌলতলী এলাকায় তাদের বাড়ি। কামরাঙ্গীরচর রনি মার্কেট ১নং গলি (বিডিআর বাড়ি) মো. বাবু মিয়ার বাসার ভাড়াটিয়া ছিল। আর গ্রেফতারকৃত মো. কামাল হোসেনের বাবার নাম মৃত আব্দুল ওহাব মিয়া। চাঁদপুর জেলার মতলবের দক্ষিণ ঘোড়াধারী এলাকায় তাদের বাড়ি। আর লালবাগ থানার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, স্টাফ কোয়ার্টারের ৫ নম্বর বাসায় তিনি থাকতেন। মো. সোহরাব হোসেনের বাবার নাম মো. সারোয়ার উদ্দিন ভুইয়া, নোয়াখালী জেলার চাটখিলের শ্রীপুর গ্রামে তাদের বাড়ি।
সূত্র জানায়, এসব জালিয়াতচক্র দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের জুনিয়র সার্টিফিকেট, উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের সার্টিফিকেট, মাদ্রাসা বোর্ডের জুনিয়র দাখিল, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স, মাস্টার্স সার্টিফিকেট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ও ব্যবসা প্রশাসনের বিবিএ সার্টিফিকেট, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজসমূহের এমবিবিএস সার্টিফিকেট, প্যারা মেডিকেল বোর্ডের সার্টিফিকেট, ডেন্টাল কলেজসমূহের সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা কলেজসমূহের যাবতীয় সার্টিফিকেট, এসএসসি ও এইচএসসিসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে আসছিল।
আর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের জাল সনদপত্র, জাল ভোটার আইডিকার্ড, জাল প্রশংসাপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের জাল দলিল ও সনদ পত্রাদি তৈরি করে ব্যবসার আড়ালে জালিয়াতি কর্মকা- চালিয়ে আসছিল চক্রটি। গ্রেফারকৃতদের বিরুদ্ধে রাজধানীর নিউ মার্কেট থানায় মামলা হয়েছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাকুশাহ মার্কেটে ফাইল নিয়ে রাতের দিকে ঢুকলেই অসাধু চক্র বলে, ‘সার্টিফিকেট লাগবে, কম টাকায় মূল সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে ইত্যাদি বলে ডাকা-ডাকিও করে। দোকানিররা আরও তাদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিস্ময়কর তথ্য জানিয়েছে। এসএসসি ও এইচএসসির সার্টিফিকেট জরুরি প্রয়োজন হলে, দুইটার জন্য তিন হাজার আর একদিন পরে হলে দুই হাজার টাকা। এই দুইটার সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরটা যদি দেন, তাহলে কত টাকা লাগবে? তখন বলা হয়, পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। পরে দরকষাকষির একপর্যায়ে তিনি প্রকৃত কাস্টমার হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেননি। একপর্যায়ে তিনি বলেন ভাই নেয়ার সময় দেখা যাবে বলেই সেখান থেকে কেটে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন বলার সঙ্গে সঙ্গেই এক দোকানদার জানান, সার্টিফিকেট ও মার্কশিট দুটোর জন্য আগে ৭হাজার টাকা লাগতো। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি চলছে। আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে আসল সার্টিফিকেটের কাগজ দিয়ে চার হাজার টাকায় সার্টিফিকেট করে দেয়া হতো। এখন অনেক সমস্যা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট, গাউসুল আজম মার্কেটে অবৈধভাবে জাল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের নথি তৈরির কাজ করে আসছে। তবে অবৈধ কর্মকান্ডের এই জায়গায় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা মাঝে মধ্যেই অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করছে। তারা আবার জামিনে এসে একই কর্মকান্ডে পুনরায় জড়িত হচ্ছে। এসব অবৈধ কর্মকান্ড দিনের চেয়ে রাতেই বেশি করা হয়। দিনে কাজের অর্ডার নিয়ে রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে চলে সার্টিফিকেট কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা। দেখতে হুবহু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের মতোই। তফাৎ শুধু একটাই, ওই সার্টিফিকেটটির বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, হল অফিস ও প্রশাসনিক ভবনে রেকর্ড থাকে না।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. খোরশেদ আলম ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।


বিজ্ঞাপন