নিজস্ব প্রতিনিধি : ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারেনি বাঙালি জাতি। স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রীরা এই দেশকে আবারো শ্মশানে পরিণত করতে চেয়েছিল। দুই দশকের এক দীর্ঘ বিভীষিকাময় সময় ছিল সেটা জাতির জন্য। অথচ, বহির্বিশ্বে কিন্তু তখনও বঙ্গবন্ধুর নামে জয়ধ্বনি দেওয়া হতো। জাতি হিসেবে আমরা কতোটা দুর্ভাগা যে, সুদূর ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রনায়করা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নাম শুনলে শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে, কিন্তু আমরাই আমাদের জাতির পিতার ইতিহাস বিকৃত করেছি। এই কুকর্মের জন্য বিদেশ-বিভূঁইয়েও বাঙালি জাতিকে অনেকবার ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিকারী যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে নিজের মুগ্ধতার কথা অকপটে বলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের তিন দশক পর, ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি কমপ্লেক্সে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেনেডি বলেন, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। খুব পপুলার স্লোগান। আমি যেন কান পাতলে আজও শুনতে পাই। মূলত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের রণাঙ্গণ পরিদর্শনে এসেছিলেন ম্যাসাচুসেটস-এর এই সিনেটর। সেসময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্পট ঘুরে দেখার সময় এই স্লোগান শোনেন তিনি। সেসময় আমেরিকার সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, মার্কিন জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন দেশটির বিরোধীদলীয় ডেমোক্রেটিক পার্টির এই নেতা। কারণ হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি মুগ্ধতার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের দেশে তোমাদের নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম চলছিল, যেটা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। কিন্তু সেটা কমিউনিস্টদের যুদ্ধ ছিল না। সে কারণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আমেরিকান জাতি তোমাদের শতভাগ সমর্থন দেয়। আমার জাতির পক্ষে সেই সময়ে তোমাদের রণাঙ্গনে গিয়ে আমি সেটা ব্যক্ত করেছিলাম। সেখান থেকে আমেরিকায় ফিরে এসে, আমাদের সিনেটে তোমাদের পক্ষে একের পর এক প্রস্তাব পাস করিয়েছিলাম। যার ফলে পাকিস্তান ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়ে।’
পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তার ধানমন্ডির বাসায় এসেছিলেন এডওয়ার্ড কেনেডি। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারে কেনেডি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বশান্তির দূত। বিশ্বশান্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু পাকিস্তানে বহু বছর ধরে সামরিক শাসন চলছে। পাকিস্তানের সামরিক শাসন এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি ক্যান্সার। তিনি আমাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় আমি এবং আমার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি যেন ভূমিকা রাখি। তাহলে এশিয়ায় শান্তি বজায় থাকবে। এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকশিত হবে এবং পারস্পরিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। তার (বঙ্গবন্ধুর) ধ্যান-জ্ঞান ছিল বাংলাদেশ ও বিশ্বশান্তি এবং তিনি ছিলেন যুদ্ধবিরোধী ও বর্ণবাদবিরোধী; যার সঙ্গে আমার আদর্শের মিল ছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তির অপচেষ্টা হয়েছে, সে ব্যাপারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এডওয়ার্ড কেনেডি। তিনি বলেন, ‘রণাঙ্গনে তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের গগনবিদারী স্লোগান শোননি? তাদের কণ্ঠে আমি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শুনেছি, তুমি তা শোননি? তুমি তো নিজেই এসবের সাক্ষী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কে ঘোষণা করেছে, কে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, কে দেশটির স্থপতি, বিশ্বের সব নেতা ও ঐতিহাসিকরা তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নামেই বিশ্ববাসী তোমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার নামেই বাঙালিকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা দিয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতের অপচেষ্টাকারীদের ব্যাপারে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু তোমাকে বলব, পৃথিবীতে দু-শ্রেণির প্রাণী আছে। মনুষ্য প্রাণী ও অমনুষ্য প্রাণী। তোমাদের বাঙালি জাতির ভাগ্য পাল্টাবে কে, যদি তোমাদের মনুষ্য জাতির মধ্যে অমনুষ্য প্রাণীর আধিপত্য প্রবল হয়ে ওঠে। যারা বিশ্বনন্দিত মহামানবসম শেখ মুজিবকে হত্যা করে অহংকার করতে পারে, তারা নরকের কীট।’