মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্য বিধি

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী সারাদেশ স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে কয়েকদিন ধরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে শপিংমল ও দোকানপাট খুলে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাসাপেক্ষে শুক্রবার থেকে আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শপিংমল ও দোকানপাট খোলা রাখা যাবে বলে সরকার থেকে নির্দেশনা হয়। স্বাস্থ্যবিধির ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে কতটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন দোকানিরা তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই, রক্ষা করছেন না সামাজিক দূরত্ব। জনসমাগম যেদিকে সেদিকেই ছুটছে উৎসুক জনতা।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শপিংমল ও দোকানপাটগুলোতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে খোলা রাখা নির্দেশনা দেয়া হলেও পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। ক্রেতাদের ভিড়ের সঙ্গে মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এতে করোনা সংক্রমণের হার আরো ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে মনে করছে সচেতন মহল।
রাজধানীর নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, চাঁদনি চক, বসুন্ধরা শপিংমল, মিরপুর শপিং সেন্টার, শাহ আলী মার্কেট, মুক্তবাংলা মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেট, ফরচুন শপিংমল, মৌচাক মার্কেট, ইস্টার্ন প্লাজা, গাজী ভবন শপিং সেন্টার, পলওয়েল মার্কেটসহ প্রায় সব জায়গাতেই একই চিত্র দেখা গেছে।
ক্রেতা থেকে শুরু করে বিক্রেতা- কারো মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা নেই। অনেক দোকানির মুখে মাস্ক নেই, কারও আবার থুতনির নিচে।
গাউছিয়া মার্কেটের দোকানি রিপন মিয়া বলেন, সবসময় আমরা মাস্ক পরেই থাকি। মাঝে কিছু সময়ের জন্য খুলে রাখলে হঠাৎ করে সাংবাদিকরা কখন এসে ছবি তুলে নিয়ে যায় বুঝতে পারি না।
তবে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে তৎপর দেখা গেছে ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের। ক্রেতাদের চলাফেরায় জটলা এড়াতে মার্কেটে ফাঁকা জায়গা নিশ্চিত করায় জোর দিচ্ছেন তারা।
নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেছেন, যে স্বাস্থ্যবিধি মানবে না তার দোকান বন্ধ করে দেয়া হবে।
এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকান পরিচালনার আশ্বাস দিয়ে রাজধানীর চাঁদনি চক বিজনেস ফোরামের সভাপতি নিজাম উদ্দিন বলেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি আমরা প্রতিপালন করবো। লকডাউনের কারণে গত বছরের আর্থিক ক্ষতি এখনও ব্যবসায়ীরা কাটিয়ে উঠতে পারেনি বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার আগে এই সময়ে আমাদের কেনার ধুম পরে যেতো। মার্কেট খুলে দিলেও বিক্রি তেমন নেই। দোকান সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকলে ঈদ মৌসুমে আশানুরূপ বেচাকেনায় আবারও লোকসান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো যাবে।
বসুন্ধরা শপিংমলে সপরিবারে এসেছেন অনিক হোসেন ও জান্নাত আরা দম্পতি। সঙ্গে তাদের দুই সন্তান। করোনার এই সময়েও সন্তানদের নিয়ে কেন আসছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামনে ঈদ। বাচ্চাদের কেনাকাটা করতে হবে। কখন আবার হুট করে সব বন্ধ করে দেবে, তাই আগেই আসছি। তবে আমরা স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনেই আসছি।
গাউছিয়া মার্কেটের ক্রেতা রোকসানা জামান বলেন, সবই তো চলছে, এর জন্য শপিং করতে আসছি। সরকার বন্ধ করে দিলে তখন তো আসা হবে না। সামনে ঈদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই তো দরকার হবে। পরে আবার মার্কেট বন্ধ করে দিলে সমস্যায় পড়তে হবে।
গাউছিয়া দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান বাবু বলেন, গত বছর দোকান বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ীদের অনেক লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক দোকানিদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে সব ধরনের নির্দেশনা দেয়া আছে। কেউ না মানলে দোকানের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
অনেক দোকানি মাস্ক পরছে না দেখা গেছে জানতে চাইলে কামরুল হাসান বলেন, মাস্ক অনেকেই বাইরেও পরে না। আমাদের গরীব দেশ। সবাইকে সচেতন হবে। কেউ ভুল করলে সেটা ধরিয়ে দিতে হবে।
এদিকে রাজধানীর করোনা নির্ধারিত সব হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা মিলছে না। সাধারণ শয্যাও খালি নেই অনেক হাসপাতালে। ফলে রোগীর স্বজনদের একটি শয্যার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। প্রয়োজনে রোগীকে অক্সিজেন দিতে না পারায় দু’তিনদিনের মধ্যে তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। শ্বাসকষ্টসহ তাদের কাউকে বাড়িতে ফেরত নেয়া হচ্ছে। সেখানেও তার দ্বারা পরিবারের অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছে। আবার অনেকে বাসায়, কেউ কেউ হাসপাতালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। এরপরও অধিকাংশ স্থানে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।
এছাড়া সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিদিন পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে বাড়ছে ভিড়। সকাল থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকে পরীক্ষা করাতে পারছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ডেডিকেটেড হিসাবে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাভুক্ত নয়- এমন একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, শয্যার অভাবে প্রতিদিন রোগীদের ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। দিনদিন করোনা পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়ছে।
এর আগে রোববার (৪ এপ্রিল) দেশে করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সেখানে বলা হয়, এ সময় দেশের সব শপিংমল ও দোকান বন্ধ থাকবে। তবে পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই কর্মচারীদের মধ্যে আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং কোনো ক্রেতা সশরীরে যেতে পারবে না।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু শুধু লকডাউন দিয়ে লাভ হবে না। লকডাউন দেয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের নেই। গত বছরে পারেনি আর এখনও পারবে না। মূল গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরে এবং সেটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে আজ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সেই সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা।
এবিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ‘মাস্ক পরার অভ্যেস, কোভিডমুক্ত বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে ২১ মার্চ থেকে দেশব্যাপী জনগণকে মাস্ক পরায় উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি শুরু করছে পুলিশ। চলমান কর্মসূচির লক্ষ হলো জনগণের মধ্যে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ৬৩ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯ হাজার ৫৮৪ জনে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) দেশে রেকর্ড সংখ্যক ৭৪ জনের মৃত্যু হয়।
এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৪৬২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জনে। এর আগে গত বুধবার (৭ এপ্রিল) দেশে একদিনে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬২৬ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়।
করোনাভাইরাস নিয়ে শুক্রবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।


বিজ্ঞাপন