স্মরণ: ড. হান্নান ফিরোজ

জাতীয়

নাঈমুল ইসলাম খান : তখন দৈনিক আমাদের সময় চলছে, সাল ২০০৬, অফিস সেন্ট্রাল রোডে, ছোট ছোট দু তিনটি এপার্টমেন্ট মিলিয়ে ।
সার্কুলেশন বাড়ছে, কর্মী বাড়ছে অর্থাৎ ব্যয় বাড়ছে। আয় বাড়ছে না। বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি অনেক কম।
একসময় অর্থকষ্ট বেশ বাড়তে থাকলো। আমাদের সময়ে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নঈম নিজাম। আমাদের অর্থাভাব সম্পর্কে জানেন।
আমার জীবনে নঈম নিজামের একটি উল্লেখযোগ্য সহযোগিতার গল্প এখানেই শুরু। নঈম নিজাম একদিন আমাকে নিয়ে হাজির হলেন জনাব হান্নান ফিরোজের কাছে যিনি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভিসি ও প্রতিষ্ঠাতা। নঈমের অনুরোধে এক কথায় তিনি দৈনিক আমাদের সময়ে ত্রাণকর্তা হিসেবে যুক্ত হয়ে গেলেন। এখানে সমুদয় কৃতজ্ঞতা নঈম নিজামের প্রতি। ‘আমাদের সময়’র অফিস তাৎক্ষনিক স্থানান্তরিত হয়ে গেল বাংলা মটরে এক বহুতল ভবনে। এক ফ্লোরে এত বড় সংবাদপত্র অফিস তখন বাংলাদেশে নেই। সম্ভবত: এখনও নেই।
জনাব হান্নান ফিরোজের সাথে তারপর অনেক ঘনিষ্ঠতা। তিনি আমাকে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতায় যুক্ত করেন এবং বিভাগীয় প্রধানের মতো দায়িত্ব দেন।
এভাবেই হান্নান ভাইকে ঘনিষ্ঠভাবে জানি ও মিশি। তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি টেলিভিশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, চালাচ্ছেন, নাম এস টিভি। যতদূর জানি তার স্ত্রী আমেরিকায়, নিউ ইয়র্কে থেকে এই টেলিভিশন পরিচালনা করেন। যেখানে তাদের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিও ছিলো বলে শুনেছি। এখানে উল্লেখ্য যে, হান্নান ফিরোজ তারও আগে জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসা করেছেন।
ঢাকায় হান্নান ভাইয়ের একটি সাউন্ড স্টুডিও ছিলো, সেটি তখন চালাতেন বর্তমান গায়ক-সুরকার-সংগীত শিল্পী এবং গান-বাংলা চ্যানেলের প্রধান নির্বাহী কৌশিক হোসেন তাপস।
নঈম নিজাম ছিলেন হান্নান ফিরোজের অত্যন্ত আস্থাভাজন এবং তার সকল কাজের প্রধান পরামর্শক ।
ডা. আবদুজ জাহের ছিলেন হান্নান ফিরোজের স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা। ঘনিষ্ঠও বটে। হান্নান ভাই, আমি এবং ডা. জাহের একসাথে কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছি এবং সেই বেড়ানোটা ছিলো আনন্দপূর্ণ, বৈচিত্র্যময়। আমার জীবনে প্রথম এবং একমাত্র চলচ্চিত্র ডাবিং অভিজ্ঞতাও কলকাতায় হয়েছিলো ঐ ভ্রমণের সময়ে।
হান্নান ভাইয়ের সাথে আমি ব্যাংককেও বেড়াতে গিয়েছি। একটি আর্ন্তজাতিক শিক্ষা সংক্রান্ত এক্সিবিশনেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো ওই বেড়ানোর পাশাপাশি। সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. মুজিব।
থাইল্যান্ডে আমি কখনও ফুট মাসাজ বা বডি মাসাজ করিনি, আমার নিজস্ব ভ্রমণের সময়ে। হান্নান ভাইয়ের সাথে ব্যাংকক বেড়ানোর ফাঁকে তিনি একদিন ফুট মাসাজ করছিলেন আর আমি কিছু না করে অপেক্ষা। কিন্তু তার ২ ঘন্টার মাসাজে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা বিরক্তকর হয়ে যাচ্ছিল বলে আমি জীবনে প্রথম ৯০ মিনিটের ফুট মাসাজ করালাম।
হান্নান ভাইয়ের সাথে তুমুল সম্পর্ক ঢাকাতেও। নঈম নিজামসহ আরও কেউ কেউ থাকেন আমাদের সান্ধ্য আড্ডায়। সঙ্গে চলে রেড ওয়াইন। হান্নান ভাই রেড ওয়াইনের সাথে কোক মিশিয়ে খেতেন। অভিনব বটে আমি সেটা তার কাছ থেকে শিখেছি হান্নান ফিরোজ অত্যন্ত উদার এবং দরদী মানুষ ছিলেন। বেহিসাবীর মতো টাকা খরচ করতেন।আমাদের পেছনেও তিনি অনেক টাকা উড়িয়েছেন।
তার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোজগার ছিলো প্রচুর। সেই অর্থে তিনি সফল। কিন্তু অনেক ব্যবসাতেই তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন যেমন টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি।
একসময় তিনি দৈনিক আমাদের সময়ের ব্যাপারে, আমার জানার বাইরে কোনো কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং প্রায় বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো আমাদের সময় থেকে নিজেকে নিঃশর্ত প্রত্যাহার করে নেন।
এই সিদ্ধান্তে তার নিজের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল এই কথা বুঝিয়েও তাকে তার প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানো যায়নি। ডা. জাহেরও আমাদের এই চেষ্টায় সামিল ছিলেন।
হান্নান ভাই চলে যাওয়ায় দৈনিক আমাদের সময় যেন এক অকূল দরীয়ায় নিক্ষিপ্ত হলো। তখন পত্রিকার সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যাচ্ছে, তাই লোকশানও হচ্ছে। এমন একটি বাড়ন্ত সময়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে আমরা চরম হতাশ ।
হান্নান ভাই আমাদের সময়ে নেই বলে ভিভিআইপি সড়কের পাশে বিশাল ভবনে বিশাল অফিস ছেড়ে আমাদেরকে রাতারাতি ঢুকতে হলো চিকন গলির ভেতরে খুব ছোট্ট অফিসে। অবশ্য বাংলা মোটর সংলগ্নই। তা সত্ত্বেও অচিন্তিনীয় অনিশ্চয়তা।
এই বিপদ পরবর্তীতে আমরা কীভাবে কাটিয়ে উঠলাম এই গল্প এখানে ততোটা প্রাসঙ্গিক নয়। এখানে শুধু হান্নান ফিরোজের সাথে আমাদের সম্পর্কের স্মৃতিচারণ হচ্ছে।
আমাদের সময় পরিত্যাগ করে হান্নান ফিরোজ ভাই ‘বাংলাদেশের সময়’ নামে আরেকটা দৈনিক পত্রিকা করেছিলেন এবং সেটাও বেশ অনেকবছর চালিয়েছিলেন কিন্তু সামান্য সফলতার দেখাও পাননি। ‘আমাদের সময়’ ছেড়ে ‘বাংলাদেশের সময়’ করার পর তুলনা করে দেখলে বুঝা যায় আমাদের সময় থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের তার সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য শাপেবর হয়েছিলো।
সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে অত্যন্ত উদার হৃদয়, বন্ধু বৎসল, প্রিয়জন হান্নান ফিরোজের স্মৃতি। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাত নসীব করুন।
নাঈমুল ইসলাম খানের ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া


বিজ্ঞাপন